বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এ কেমন চেহারা

সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মিছিল
সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মিছিল

কোটা সংস্কার আন্দোলন দমনের জন্য গত কয়েক মাসে সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা সবার জানা। এই সব ঘটনার সঙ্গে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের ক্যাম্পাস ত্যাগের ঘটনা। ফেসবুকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের 

সমর্থনে লেখার ‘অভিযোগে’ ছাত্রলীগের কর্মীদের হুমকির মুখে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাইদুল ইসলাম সপরিবার ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। আরেকজন শিক্ষক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের খন্দকার আলী আর রাজীর বিরুদ্ধে চালানো হচ্ছে প্রচারণা, তাঁকে ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে। ছাত্রলীগ এই দুই শিক্ষকের চাকরিচ্যুতিও চেয়েছে।

কোটা আন্দোলনের এক নেতা তারেক রহমান দুই দিন নিখোঁজ থাকার পর ফিরে এসেছেন। পরিবার সূত্রে বলা হচ্ছে, তিনি এখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এই সব ঘটনাই ঘটছে যখন সরকারের পক্ষ থেকে সচিব পর্যায়ে একটি কমিটি করা হয়েছে এবং কমিটির জন্য বরাদ্দকৃত ১৫ কার্যদিবস শেষে প্রতিবেদন দেওয়ার বিষয় যদি ঠিক থাকে, তবে খুব শিগগির তার সুপারিশ পাওয়ার কথা।

গত এপ্রিল মাস থেকে সংঘটিত ঘটনাবলির প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা এবং আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীদের প্রতি
দমনমূলক আচরণগুলো উদ্বেগজনক হলেও অভাবনীয় নয়। আমরা দেখেছি যে এই আন্দোলনের কর্মীদের সমাবেশে উপর্যুপরি হামলা হয়েছে,
তাঁদের ওপর অত্যাচার ও নিপীড়নের ঘটনার ধারাবাহিকতায় নেতাদের আটক করা হয়েছে, রিমান্ডে পাঠানো হয়েছে।

রিমান্ডের সময় গোয়েন্দা অফিসে আনা হলে রাশেদ খান তাঁর মায়ের কাছে মিনতি করে বলেছেন, ‘তোমরা একটা সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের কাছে বলো, আমাকে যেন আর না মারে।’ একজন নেতা ফারুক হোসেনকে ‘পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার’ ঘটনার পর দুই দিন পর্যন্ত তাঁর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। ডিবি পরিচয়ে রাতের বেলা তুলে নেওয়ার ১৪ ঘণ্টা পরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক সুহেলকে গ্রেপ্তারের কথা স্বীকার করেছে পুলিশ।

কোটা সংস্কার নিয়ে সম্প্রতি আদালতের ‘রায়ের’ বিষয়টি সামনে এসেছে। বলা হচ্ছে, আদালতের রায়ের কারণে মুক্তিযোদ্ধার কোটা বাতিলের সুযোগ নেই। তাতে আদালত অবমাননা হতে পারে। অথচ আমরা দেখছি, কোটা আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রেই আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করার ঘটনা ঘটছে। তা ছাড়া, ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্ট ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশনা বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করে দিয়ে বলেছিলেন, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ হবে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়; জিজ্ঞাসাবাদের নামে কাউকে নির্যাতন করতে পারবে না পুলিশ। কিন্তু তার ব্যত্যয়ই এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এমনকি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

কোটা নিয়ে আদালতের রায়ের প্রসঙ্গটি আলোচনায় এসেছে কোটা সংস্কার প্রশ্নে গঠিত সচিব কমিটি গঠন এবং এমনকি ওই কমিটির প্রথম বৈঠকেরও বেশ পরে। আদালতের রায়ের প্রসঙ্গ সামনে চলে আসায় সচিব কমিটি কোটা সংস্কারের প্রশ্নে আর কতটা পরিবর্তনের সুপারিশ দিতে পারবে, সেটাই এখন প্রশ্ন। কেননা, ৫৬ শতাংশের ৩০ শতাংশ যদি কোনোভাবেই স্পর্শ না করা যায়, তবে যা বাকি থাকে তা খুব বেশি নয়। কেননা, সংবিধানে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, প্রতিবন্ধী, বিভিন্ন ধরনের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে যে ধরনের নির্দেশনা আছে, সেগুলোকে ধর্তব্যের মধ্যে নিলে এ কমিটির জন্য এখন পুরো কোটা পদ্ধতি বিষয়ে একটি সর্বাত্মক বা কম্প্রিহেনসিভ সুপারিশ দেওয়া কতটা সম্ভব হবে, সেটা ভাবার বিষয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ কমিটির সুপারিশের জায়গা যেন অনেকটাই সীমিত হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও আমরা নিশ্চয় কমিটির প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করব। এ কমিটি গঠনের একটা দিক ইতিবাচক, স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সরকার মেনে নিয়েছে যে সংস্কারের বিষয়কে আর এড়ানো যাবে না।

সরকারের তরফে ও সরকারি দলের নেতারা এ বিষয়ে কথা বলছেন, তাঁদের যুক্তি দিচ্ছেন; কিন্তু অন্যরা এ বিষয়ে তাঁদের মত প্রকাশের চেষ্টা করলেই যে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন, হেনস্তার শিকার হচ্ছেন, সেটাই আমরা দেখতে পাচ্ছি। কোটা সংস্কারের দাবির সমর্থক অভিভাবকদের সমাবেশে এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপরে একাধিকবার হামলা হয়েছে। গোড়াতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ কাজে নিয়োজিত করা হলেও এখন দৃশ্যত তার ‘দায়িত্ব’ অর্পণ করা হয়েছে সরকারি ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে। এ কাজ যে তাঁরা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পাদন করছেন, তা গণমাধ্যমের দিকে তাকালেই জানা যায়।
ঢাকায় রোববারের ঘটনা এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা তার সর্বশেষ প্রমাণ। এই সব ঘটনার সঙ্গে কার্যত প্রত্যক্ষভাবেই যুক্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন। এই প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আসীন ব্যক্তিরা, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যেরা এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তদের ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের তত্ত্ব আবিষ্কার করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর একপর্যায়ে বলেছেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা তিন দিন পরেও তিনি জানতে পারেননি।

রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক যখন সরকারি ছাত্রসংগঠনের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছেন, তখন প্রক্টর এর দায় শিক্ষকদের ওপরই চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এই বলে যে, ‘সমাবেশ বা নিরাপত্তার জন্য অনুমতি নিচ্ছেন না, আমাদের অবহিতও করছেন না।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের লাঞ্ছনা এবং শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার পর ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক আমাদের জানিয়েছেন যে ছাত্রলীগের কমিটি না থাকায় আক্রমণকারীরা ছাত্রলীগের কর্মী, তা বলা যাবে না। অথচ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের ক্ষেত্রে বিভাগীয় প্রধান স্বীকার করেছেন, ছাত্রলীগের নেতারা তাঁর কাছে গেছেন এবং ছাত্রলীগের নেতারাও সাংবাদিকদের কাছে এ নিয়ে কোনো রাখঢাক করেননি যে তাঁরা মাইদুল ইসলামকে ‘প্রতিরোধ’ করাকে দায়িত্ব মনে করেছেন। চট্টগ্রামে যে সংগঠনের কর্মীরা প্রকাশ্যে ‘প্রতিরোধ’ করছেন, সেই সংগঠনের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা ‘কমিটিই নেই’ বলে ঢাকায় কিছুই করছেন না, ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের এই বক্তব্য হাস্যকর বলেই মনে হয়।

সরকার ও সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের এই সব হামলা সত্ত্বেও কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে আটক ব্যক্তিদের মুক্তির দাবি, তাঁদের ওপর নির্যাতন বন্ধের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা তাঁদের প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছেন। শিক্ষকদের মধ্য থেকে অনেকেই শিক্ষার্থীদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন এবং নাগরিকের অধিকারের প্রশ্নে সরব হচ্ছেন। একই সঙ্গে এই সব প্রতিবাদ ও কর্মসূচির সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যে চেহারা প্রকাশিত হচ্ছে, তা অত্যন্ত ভয়াবহ।

দলীয় রাজনীতির বিবেচনায় সরকার-সমর্থক শিক্ষকেরা এবং প্রশাসনের সঙ্গে যুক্তরা কী ধরনের আচরণ করেন, আমরা তার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম, এই ধরনের আচরণ অনেক দিন ধরেই চালু আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাবলি প্রমাণ দিচ্ছে যে শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করার ক্ষেত্রেও প্রশাসন এবং শিক্ষক সমিতিগুলো এখন সম্পূর্ণ ব্যর্থ।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর