বিশ্ববিদ্যালয়-সংস্কারের শুভসূচনা হোক

গত কয়েক মাসের অপরাধ-অনাচার-অঘটন আর ধরাকে সরা জ্ঞান করার ঘটনা ঘটেছে এন্তার ও বিস্তর। দেশ ঠিকঠাকমতো চলছে না বললে খুব একটা বাড়িয়ে বলা হবে না।

ক্যাসিনোকেন্দ্রিক শত শত কোটি টাকার অপরাধমূলক কার্যক্রম আর তথাকথিত রাজনৈতিক নেতাদের এহেন কর্মকাণ্ডের বয়ানে হকচকিয়ে যায়নি, এমন মানুষের সংখ্যা নিশ্চয়ই আঙুলে গুনে শেষ করা যাবে। বেশ কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দুর্নীতি, অনিয়মসংক্রান্ত রিপোর্টে ঘনঘন স্থান পাচ্ছে। পেঁয়াজ নিয়ে যখন তুলকালাম শুরু হলো, তখন শুরুতে ভেবেছিলাম দাম হয়তো গিয়ে ঠেকবে কেজি ১৫০ টাকায়। সবজান্তার মতো চেম্বারে সহকর্মীদের বড়াই করে ঘোষণা দিয়েছিলাম, দাম হবে ১৫০ টাকা কেজি। লাড্ডু বুঝেছিলাম।

বুয়েটের ছাত্র আবরারের হত্যাকাণ্ডের পর যে ভয়াবহ নৃশংসতার চিত্র দিনের পর দিন ফুটে উঠল, তাতে আমাদের নিজেদের বর্বরতায় আমরাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম।

বহুদিন ধরে বিবিসি, সিএনএনের মতো সংবাদমাধ্যমে মেক্সিকো, গুয়াতেমালা ইত্যাদি দক্ষিণ আমেরিকার দেশ; নাইজেরিয়া, সুদান গোছের আফ্রিকার দেশ; সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানের মতো মুসলিম উম্মাহর দেশসহ ডজন ডজন দেশে ‘ওয়ার লর্ড’-এর কথা জেনেছি। ওয়ার লর্ডরা তাদের এলাকার জন্য আইন ও চাঁদা বেঁধে দেয় এবং সে আইন ও চাঁদা প্রয়োগ করে। আর কেউ তাদের অমান্য করলে রকেটের গতিতে পাঠিয়ে দেয় পরলোকে। ইদানীং বুঝলাম, আমাদের কিছু কিছু কাউন্সিলর ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাও শুধু যে ভিনদেশি ওয়ার লর্ডদের রঙিন জীবনবৃত্তান্ত শুনে ক্ষান্ত হননি, তাঁরাও সে পথে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোচ্ছিলেন। নিজ নিজ এলাকায় দশটা-বিশটা-তিরিশটা বাড়ির ‘মালিকানা’ হাসিল করে ফেলেছেন। কিছু শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছিল। মাদক ও অস্ত্র মামলা করা হয়েছে। ৫-১০ জনের জেল-জরিমানা হচ্ছে। পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমছে। তথাকথিত অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতৃত্বে কিছু কিছু পরিবর্তনও এসেছে।

তবে আশায় বুক বাঁধছি সম্পূর্ণ অন্য কারণে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য কিছু নির্দেশনা বা পরামর্শ দিয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে আমাদের ভালো-মন্দের আঁতুড়ঘর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমরা অনেক গর্ব করি, কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন জঞ্জাল-আবর্জনায় ভরে যায়, তখন তা সহজেই ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। তাই আবর্জনা সরানোর কাজ শুরু হওয়ার দরকার ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই। দেরিতে হলেও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সে কাজ শুরু করেছে। আর ১৪ ডিসেম্বর প্রথম আলো রিপোর্ট করেছে যে ‘বন্ধের পথে সান্ধ্য কোর্স’ অর্থাৎ ঢাকা, জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে সান্ধ্য কোর্স বন্ধের উদ্যোগ নিচ্ছে। রিপোর্ট পড়ে হতবাক হয়ে জানলাম যে একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ৪১টি বিভাগে ৮০টি সান্ধ্য কোর্স চালু আছে!

২.
অধমের কপাল মন্দ। চারটি দেশের চার ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। ঢাকায় পাবলিক প্রাইভেট মিলিয়ে বিভিন্ন সময় পড়িয়েছি বা পড়াচ্ছি বহু বছর ধরে।

গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষের দিকে বেশ কিছুকাল আমেরিকার বোস্টন শহরে বসবাস ছিল। নগরবাসীর সংখ্যার দিক দিয়ে বোস্টন আমেরিকার মধ্যম গোছের শহর। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বড় শহর থেকে বেশি। এমআইটি আর হার্ভার্ডের দূরত্ব এক কিলোমিটারের মতো, যেমন ঢাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর বুয়েট। তবে ছোট্ট একটা পার্থক্য আছে। গুগল চাচা বলে, কমবেশি গত ৬০ বছরে প্রাক্তন ছাত্র (অর্থাৎ, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছেন) এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করছেন—এই দুই জাত মিলিয়ে সর্বমোট ১৬০ জন বিভিন্ন ডিসিপ্লিনে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এঁদের মধ্যে শিক্ষকের সংখ্যা ৫৬ জন। এমআইটির পঞ্চাশোর্ধ্ব শিক্ষক নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এসে ২০১৯-এর হিসাব দেখলে দেখা যায়, অর্থনীতিতে যে তিনজন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁর দুজন এমআইটির শিক্ষক আর একজন হার্ভার্ডের। চিকিৎসাশাস্ত্রে ২০১৯-এ যাঁরা নোবেল পেয়েছেন, তাঁদের একজন হার্ভার্ডের। স্মৃতিভ্রম হচ্ছে না সেই ভরসায় বলি, ১৯৮৭ সালে যখন বোস্টনে ছিলাম, তখন এমআইটির বায়োলজি বিভাগে পাঁচজন নোবেল পুরস্কার পাওয়া মানুষ শিক্ষকতা করতেন। ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোতে যাইনি কিন্তু জানি, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে এযাবৎ ৩৩ জন শিক্ষক অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। প্রায়ই ঠাট্টা করে বলি, অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়ে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপক পদের জন্য দরখাস্ত করলেই যে আপনাকে নিয়োগ প্রদান করা হবে, তার গ্যারান্টি এই অধম দিতে পারবে না।

সিকি শতাব্দী আগে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে যে শিক্ষকের অধীনে পিএইচডি করেছিলাম, তিনি ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার আইনের শিক্ষক। তখন তাঁর বয়স ৪০-এর কিছু বেশি ছিল। যেহেতু দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক আইন পড়াতেন, সেই সুবাদে উর্দু, হিন্দি, গুজরাটি, তামিলসহ বোধ হয় ছয়টি দক্ষিণ এশীয় ভাষা জানতেন। প্রথম সাক্ষাতেই বলেছিলেন, ‘আমি বাবা বাংলা জানি না।’ কোনো লেখা দেখালে তাঁর পছন্দ হলে বলতেন, ‘শাহদীন চালেগা।’ আরও গোটা চারেক ইউরোপীয় ভাষা জানতেন। শেষতক অধ্যাপকের পদ পেয়েছিলেন ২০০৫ সালের দিকে।

৩.
বছর পাঁচেক আগে প্রথম আলোর একটা লেখাতে গোসসা করে লিখেছিলাম, ‘যত দূর মনে পড়ে, আজকাল যাঁরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেন, তাঁদের অনেকেই প্রাথমিক বিদ্যালয় আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পার্থক্যটা ঠিকমতো বুঝতে পারেন না।’ যে কারণে লিখেছিলাম সেটা হলো এই যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রধান দায়িত্ব ও কাজ হলো ছাত্রছাত্রীদের পাঠদান। সারা দিন তাঁরা ক্লাস করবেন, ছাত্রছাত্রীদের পড়াবেন আর তাঁরা যা পড়াবেন ছাত্রছাত্রীরা সেটাই শিখবে। অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রধান কাজ জ্ঞান তৈরি। পুরোনো জিনিস নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করা, প্রচলিত ধারণাগুলোকে প্রশ্ন করা, নতুন উত্তর তালাশ করা। যেসব দেশে পাঁচ শ থেকে হাজার বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে, সেসব দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক একটা বা দুটো বিষয়ের বেশি ‘কোর্স’ নেন না। সপ্তাহে বড়জোর চার ঘণ্টা ক্লাস করেন। বাকি সময়টা তাঁরা ব্যয় করেন পড়াশোনা আর গবেষণা করে। ফল লেখালেখি, প্রকাশনা ইত্যাদি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদেরও বুঝতে হবে যে তাঁদের জ্ঞান অর্জনের শতকরা ৮০ শতাংশ নির্ভর করে নিজের চেষ্টার ওপর। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাঁদের শুধু পথ বাতলে দেবেন। কোন বিষয়ে কী বই, কী প্রবন্ধ আনুষঙ্গিক, কোন ইতিহাস, কোন দর্শন পড়তে হবে, তার একটা ফিরিস্তি দিয়ে (রিডিং লিস্ট) সাহায্য করা।

সান্ধ্য কোর্সগুলোর আধিক্য থেকে এটা স্পষ্ট যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক শুধু পড়াতেই ব্যস্ত। নিজেদের পড়াশোনা করা বা গবেষণাতে তাঁদের সময়ও নেই, হয়তো উৎসাহও কম। এতে অবশ্য বেশ কিছু শিক্ষকের অর্থযোগও আছে। অর্থ উপার্জন বহু কায়দায় হতে পারে। বলা বাহুল্য,অর্থ উপার্জন মোক্ষ হলে কেব্‌ল ব্যবসা, ঝুট ব্যবসা আর আজকাল ঢাকার ওয়ার্ড কমিশনারের সাগরেদ হয়ে দুই-চার বছরে ঢাকায় দুই-চারটা ফ্ল্যাটের মালিকও নাকি হওয়া যায়। বাস-ট্রাক, ঠিকাদারি-কন্ট্রাক্টরি ইত্যাদিসহ অর্থযোগের পন্থা অগণিত অবারিত।

সান্ধ্য কোর্সের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষকদের অটো পদোন্নতি বন্ধ করতে হবে। অটো পদোন্নতি সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে আছে বলে আমাদের জানা নেই। এই অটো পদোন্নতি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বারোটা বাজানোর আরেকটা কারণ।

অনেকেই নিশ্চয় বলবেন যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্য কোর্সগুলো বন্ধ হলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো লাভবান হবে। ওইগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা বাড়বে। শিক্ষার মান উন্নত করতে হলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বহুলাংশে কমিয়ে আনতে হবে। আইনগতভাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, কিন্তু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেকটিই অত্যন্ত লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বলা বাহুল্য, লাভের ক্রিম খাচ্ছেন মালিকেরা। তাই প্রায়ই বলা হয়, দেশে বেকারদের মধ্যে এই সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সার্টিফিকেট নামক একটা সুন্দর ঝকঝকে তকতকে ভালো ছাপার কাগজধারীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। দোষ ছাত্রছাত্রীদের নয়। দেশের মুরব্বিদের ভ্রান্ত চিন্তা ও পদক্ষেপে বেকারত্বের খেসারত দিচ্ছেন এই সব ছাত্রছাত্রী। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের অর্জিত অর্থের কতটুকু শিক্ষা ও গবেষণায় ব্যয় করছে আর কতটুকু বিভিন্ন ছুতোয় পকেটস্থ হচ্ছে, সেদিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে আজ হোক কাল হোক নজর দিতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঠিক হলে দেশ ঠিক হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খারাপ অথচ দেশের উন্নতি হয়েছে, এমন কোনো দেশের উদাহরণ অধমের জানা নেই।

ড. শাহদীন মালিক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক