বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ঐক্য ও সমন্বয়ের দায়িত্ব কার?

‘কলস যত বড়ই হউক না, সামান্য ফুটা হইলেই তাহার দ্বারা আর কোনো কাজ পাওয়া যায় না। তখন যাহা তোমাকে ভাসাইয়া রাখে তাহাই তোমাকে ডুবায়।’ প্রথম আলোয় ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি অধ্যাপক মো. রহমত উল্লাহর সাক্ষাৎকার পড়ার পর রবীন্দ্রনাথের উক্তিটি মনে এসে গেল। এ সাক্ষাৎকারের কথাগুলো প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমার মতো অনেকেরই ভাবনার উদ্রেক ঘটিয়েছে, সন্দেহ নেই। কারণ, এতে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয় বজায় রাখার আবশ্যকতাসহ আরও যেসব বিষয় প্রকাশ পেয়েছে, তাতে শতবর্ষী এ বিশ্ববিদ্যালয়টির ফুটোগুলো দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি এবং মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ‘গৃহীত কার্যক্রমসমূহের’ মধ্যে চমৎকার একটি বিষয় দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সেখানে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ‘গবেষণার ক্ষেত্র সম্প্রসারণের লক্ষ্যে’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার প্ল্যান প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি বলছিলেন গবেষণার জন্য অর্থসংকটের কথা। অপর দিকে গত বছরের ৪ অক্টোবর প্রথম আলোয় প্রকাশিত মাননীয় উপাচার্যের বক্তব্যে জানা গিয়েছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬০টি গবেষণাকেন্দ্র আছে। এত বিপুলসংখ্যক গবেষণাকেন্দ্র বিশ্বের অনেক সুখ্যাতিসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও নেই। এতগুলো গবেষণাকেন্দ্র এ পর্যন্ত কী প্রসব করেছে, তা প্রশ্নের দাবি রাখে বৈকি। আর এতগুলো গবেষণাকেন্দ্র বিদ্যমান থাকার পরও গবেষণার ক্ষেত্র সম্প্রসারণের জন্য মাস্টারপ্ল্যানের প্রয়োজন কেন হবে, সেটিও ভেবে দেখা উচিত। অর্থসংকটই যদি এখানে গবেষণা পরিচালনার প্রতিবন্ধকতা হয়, তাহলে গবেষণার ক্ষেত্র সম্প্রসারণেরই-বা যৌক্তিকতা কী?

মুক্তচিন্তার লালনক্ষেত্রে বিচরণ আর রাজনৈতিক চিন্তার শৃঙ্খলে বাস করা যে এক নয়, তা আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখলে বুঝতে বাকি থাকে না। অবশ্য রাজনৈতিক প্রভাবকে পুরোনো সমস্যা হিসেবে অভিহিত করার মাধ্যমে শিক্ষক সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি মহোদয় কি একে ‘সমাধানের চেষ্টা করে লাভ নেই’ গোছের কিছু বোঝাতে চাইলেন কি না, তা বোঝা গেল না। সাত বছর ধরে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভকারী নির্দিষ্ট রঙের দল এ প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতায় থাকা এবং এরপরের নির্বাচনেও বিজয়মুকুট লাভ করা সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দের কাছে যদি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়, পেশাদারি মনোভাব ও শিক্ষকতাকে অগ্রাধিকার না দিয়ে সেখানে রাজনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তোলাও স্বাভাবিক নয় কি? সেটিই তো আজ হয়েছে। তাহলে কেন এ নিয়ে আক্ষেপ?

সভাপতি মহোদয় একটি কথা বেশ খাসা বলেছেন: ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মানোন্নয়নের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শাসন করতেই যেন বেশি আগ্রহী।’ সত্য বটে। আর এ কারণেই সম্ভবত সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয় রক্ষা হয় না। এর উদাহরণ গত বছর বাংলাদেশে করোনার যাত্রা শুরুর কয়েক মাসের মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে পাঠদান আরম্ভ করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদানে বিরত থাকা। এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখির পর কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসেছে। তাতে অপচয় ঘটেছে শিক্ষার্থীদের মূল্যবান সময়ের। এহেন পরিস্থিতিতে সমন্বয় করার দায়িত্ব কি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ছিল না?

শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির মাঠে যাঁরা বছরের পর বছর বিজয়ী হচ্ছেন, তাঁরাও কি কখনো ভেবেছেন রিসার্চ এথিকস বোর্ড বা গবেষণার নৈতিক বিষয়াবলি অনুমোদনের জন্য একখানা বোর্ড বা দায়িত্বশীল কিছু মানুষ থাকা আবশ্যক?

যেসব ধারণার বশবর্তী হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অনলাইনে ক্লাস করতে দিতে অনাগ্রহী ছিল, তার একটি হলো অনলাইনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নকল প্রবণতা বাড়বে। অথচ ওপেন বুক এক্সামের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর নকল প্রবণতার হার কমানো ও মাথা খাঁটিয়ে উত্তর লেখার যে একটা বন্দোবস্ত করা যেতে পারে, তা কর্তৃপক্ষ মানতে নারাজ। নাকি এতে সনাতন পদ্ধতির বাইরে গিয়ে শিক্ষককে দক্ষতার সঙ্গে প্রশ্ন প্রণয়নের জন্য একটু চিন্তা করতে হয় বলে এ ব্যবস্থায় অনীহা? অবশ্য এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে সনাতন পরীক্ষাপদ্ধতিতেই বা নকল প্রবণতার রোধ কতখানি ঠেকানো গিয়েছে, সে প্রশ্ন অবধারিতভাবে চলে আসে।

আরও যেসব প্রশ্ন অনিবার্যভাবে আসে, সেগুলো হলো: দেশের কয়টা বিশ্ববিদ্যালয় নিজ থেকে বা কেন্দ্রীয়ভাবে গবেষণা এথিকস বোর্ড প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে? শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির মাঠে যাঁরা বছরের পর বছর বিজয়ী হচ্ছেন, তাঁরাও কি কখনো ভেবেছেন রিসার্চ এথিকস বোর্ড বা গবেষণার নৈতিক বিষয়াবলি অনুমোদনের জন্য একখানা বোর্ড বা দায়িত্বশীল কিছু মানুষ থাকা আবশ্যক? শিক্ষার মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অবহেলার আরও একটি উদাহরণ হলো শিক্ষা-সহায়ক কোর্স চালু না করা। একজন শিক্ষার্থী তাঁর লেখার মান উন্নত করা, বিশ্লেষণ করতে জানা, রেফারেন্সিং জানা—এসব জ্ঞান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন না, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে এগুলো শেখেন। এগুলো তাঁর শিক্ষা ও গবেষণাকে এগিয়ে নিতে সহায়ক। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কি পেরেছে পাঠ্যক্রমের বাইরে শিক্ষার্থীদের জন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্রি কিছু কোর্স চালুর বিধান করতে, যেখানে শিক্ষার্থীরা এগুলো স্নাতকের শুরুর দিকেই শিখবেন এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রয়োগ করবেন?

১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আজ একে বলা হয় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। অবশ্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আচরণের কারণেই একে যাঁরা সরকারি বলছেন, তাঁদের কাছে এমনটি বলা যৌক্তিক মনে হয়েছে। যেমন শিক্ষক সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি মহোদয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দুভাগে বিভক্ত করেছেন—সরকারি ও বেসরকারি। আর এই বিভাজনের কারণেই ঐক্য ও সমন্বয়ের অভাব সৃষ্টি হয়েছে এই দুই শ্রেণির বিশ্ববিদ্যালয়ে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ‘সরকারি’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল পাঠদানের জন্য নয়, আলোচনা-ওয়েবিনারেও আমন্ত্রিত। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য এ আমন্ত্রণ হয় নিষিদ্ধ কিংবা সীমিত। ধারণা করার কারণ নেই, এতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ক্ষতি হচ্ছে কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ কোনো লাভ হচ্ছে। জ্ঞান যেহেতু বিনিময় করলে বাড়ে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজেই পিছিয়ে যাচ্ছে। তা শিক্ষার মান উন্নত করার ক্ষেত্রেই হোক, কিংবা হোক গবেষণায় এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে।

১০০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জনের তালিকার দিকে তাকালে গর্ব করার মতো বিশেষ কিছু দেখা যায় না। বাগাড়ম্বরে কালক্ষেপণ না করে আরও পিছিয়ে পড়ার আগে শিক্ষার মানে অবনতি ঠেকানো ও গবেষণায় উৎসাহ দেওয়ার সময় এখনই। আর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনেরও প্রো-অ্যাকটিভ হওয়া প্রয়োজন ‘সরকারি’-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ও মৌলিক নীতিমালা ও কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় ঘটানো, যা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ‘শাসক’ মূর্তির বিলোপ ঘটিয়ে শিক্ষা ও গবেষণার মান বাড়ানোর অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে এবং যা জ্ঞান অর্জন ও সত্য অনুসন্ধানের পথ তৈরি করবে। যেমনটি বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘আমাদের শিক্ষার মধ্যে এমন একটি সম্পদ থাকা চাই যা কেবল আমাদের তথ্য দেয় না, সত্য দেয়; যা কেবল ইন্ধন দেয় না, অগ্নি দেয়।’ জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞান বিতরণের পথ থেকে শিক্ষাকে যখন বাণিজ্যিকীকরণের পথে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন সেখানে তথ্য বা সত্য কিংবা ইন্ধন বা অগ্নি—কোনোটিরই সন্ধান মেলে না। এটি রোধে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা ও গবেষণা নিয়ে কর্তৃপক্ষ ভাববে কি?

ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর পিস স্টাডিজের সমন্বয়কারী