বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী?

কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যদের বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ, যুক্তরাজ্যভিত্তিক কিউএস র‍্যাঙ্কিংয়ে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পিছিয়ে থাকা, মহামারির মধ্যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অচলাবস্থা এবং এর মধ্যে আবার চতুর্থ বর্ষ ও মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের জন্য অনতিবিলম্বে পরীক্ষা আয়োজনের আকুতি—ইত্যাকার ইস্যুতে দেশের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা আবারও আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে এসেছে।

এ বাস্তবতায় পুনরায় প্রশ্ন উঠছে, প্রকৃত অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী? অথবা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে? লক্ষ করলে দেখবেন, জনপরিসরে প্রায়ই এ ধরনের প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

যেহেতু বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য মীমাংসিত কোনো বোঝাপড়ার ওপর এখনো আমরা দাঁড় করাতে পারিনি, তাই ইতিহাসের অমীমাংসিত প্রশ্নগুলোর ন্যায় বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত জিজ্ঞাসারাও ঘুরেফিরে সামনে আসছে আমাদের। অনেকেই মনে করেন, বাজারের সাম্প্রতিক চাহিদা অনুযায়ী ইনোভেশন, বিশেষায়িত গবেষণা প্রকাশনা ও কর্মসংস্থানের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ। সে অনুযায়ীই এখন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এবং বাণিজ্য সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে তুলনামূলক অনেক বেশি বিনিয়োগ করা হচ্ছে বা বিনিয়োগের তাগিদ সৃষ্টি হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার এক অতুলনীয় সমন্বয় থাকতে হবে। গবেষণালব্ধ জ্ঞান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দ্বান্দ্বিকতার মধ্য দিয়ে সুনির্দিষ্ট কাঠামোগত ভিত্তি পাবে।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কার্ডিনাল জন হেনরি নিউম্যান উচ্চশিক্ষা সম্পর্কিত কিছু প্রস্তাব হাজির করেছিলেন। ওই প্রস্তাব অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় হবে এমন একটি পরিসর, যেখানে সব স্তর থেকে আগত বিদ্যার্থীদের চিন্তা ও জ্ঞানের প্রাণোচ্ছল যোগাযোগে একটি জীবন্ত স্রোতোধারা সৃষ্টি হবে। সেখানে চেতনা ও বুদ্ধিমত্তার নিরাপদ পদচারণ নিশ্চিত হবে। জ্ঞানের সঙ্গে জ্ঞানের, চিন্তার সঙ্গে চিন্তার, ধারণার সঙ্গে ধারণার দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীর আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসা উজ্জীবিত হবে। ব্যক্তির সিদ্ধান্তগুলোকে যাচাই করে দেখা যাবে। ভুলগুলো অনায়াসে উন্মোচিত হবে। চিন্তা, সৃষ্টি ও আবিষ্কারগুলো ক্রমাগত পরিশীলিত হয়ে উঠবে। পারস্পরিক শিক্ষণের তাবৎ আয়োজন থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়ে। উল্লেখ করা দরকার, মানবসভ্যতার ইতিহাস তো এক অর্থে এই পারস্পরিক শিক্ষারই ইতিহাস। এভাবেই জ্ঞান ও প্রজ্ঞার একটি বিশুদ্ধ ও নির্মল পরিবেশ রচিত হবে, যেখানে বিদ্যার্থীরা হৃদয়ভরে নিশ্বাস নিতে পারবেন।

এদিকে নিউম্যানের আগে ১৮১০ সালে ভিলহেম ভন হামবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠানের জন্য অপরিহার্য তিনটি শর্তের কথা লিখলেন। বলে রাখা ভালো, ওই শর্তের ওপর ভিত্তি করেই বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার এক অতুলনীয় সমন্বয় থাকতে হবে। গবেষণালব্ধ জ্ঞান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দ্বান্দ্বিকতার মধ্য দিয়ে সুনির্দিষ্ট কাঠামোগত ভিত্তি পাবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে এবং সর্বোপরি, প্রশাসনিক আঙ্গিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে হবে।

অবদানের দিক থেকে চিন্তা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একান্ত গভীর ও ‘নিবিড়তম ভূমিকা’ বা ডিপার ফাংশনালিটি আছে। সে ব্যাপারে উদাসীন থেকে শুধু স্বল্পমেয়াদি কিছু বৈষয়িক প্রাপ্তির প্রসঙ্গকে আলোচনার মুখ্য বিষয় করে তুলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিগূঢ় সংস্কৃতিকে যেমন অস্বীকার করছি, তেমনি অমর্যাদাও করছি।

মূলত হামবোল্ট ও নিউম্যানের দার্শনিক চিন্তা ডানায় ভর করে ‘সফলতার’ সঙ্গেই পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হয়ে আসছিল। হাল আমলের নয়া-উদারনৈতিক বাজার দর্শন সেখানে বেশ খানিকটা ছেদ টেনে দিয়েছে, এ কথা বললে মোটেই সত্যের অপলাপ হবে না। হাজির করা হয়েছে কিউএস র‍্যাঙ্কিংসহ আরও কত মূল্যায়ন পদ্ধতি। এদিকে পৃথিবীর অনেক দেশেই জনগণের করের পয়সায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হচ্ছে। সেদিক বিবেচনায় মৌলিক প্রশ্ন জাগে, সমাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান কী হবে? অবদানের দিক থেকে চিন্তা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একান্ত গভীর ও ‘নিবিড়তম ভূমিকা’ বা ডিপার ফাংশনালিটি আছে। সে ব্যাপারে উদাসীন থেকে শুধু স্বল্পমেয়াদি কিছু বৈষয়িক প্রাপ্তির প্রসঙ্গকে আলোচনার মুখ্য বিষয় করে তুলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিগূঢ় সংস্কৃতিকে যেমন অস্বীকার করছি, তেমনি অমর্যাদাও করছি।

নয়া উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থায় রাষ্ট্রগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একধরনের অগভীর ও কেজো সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী। অর্থাৎ রাষ্ট্র তার স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল করার জন্য নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয়কে যুক্ত করতে আগ্রহী। বাংলাদেশে সেটিও কতটুকু হচ্ছে, তা নিয়ে নিশ্চিতভাবেই প্রশ্ন তোলা যায়। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী বড়জোর বিশেষায়িত গবেষণা, দক্ষ শ্রমিক উৎপাদন, ব্যবস্থাপনায় পারদর্শিতা, সাম্প্রতিক প্রযুক্তিগত উন্নতি, চলমান বৈশ্বিক যোগাযোগ ও কূটনীতিতে অবদান রাখার মতো কাজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে দেখার এবং দেখানোর তাগিদ চোখে পড়ছে সবখানে।

অথচ বিশ্ববিদ্যালয় যদি তার সেই ‘নিবিড়তম ভূমিকা’, অর্থাৎ যার জন্য এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে, পালন করতে পারে তাহলে সেসব ‘কর্মকাণ্ডের’ উপজাত হিসেবেই রাষ্ট্রগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে স্বল্পমাত্রার ওই বৈষয়িক অর্জনগুলো নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে। ‘নিবিড় ভূমিকা’ প্রসঙ্গে একসময়কার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ড্রিউ ফস্টের মন্তব্য উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেন, আগামী কয়েক দশকে ফলাফল কী হলো, সেটা যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ধর্তব্যের বিষয় নয়, তেমনি স্নাতক নিয়ে কে সেখানকার ছাত্র হিসেবে পরিচিতি পেল, সেটাও কোনো মূল্যবান ঘটনা নয়। বরং বিশ্ববিদ্যালয় মানে এমন শিক্ষা, যা পুরোটা জীবনকে অনন্ত সম্ভাবনায় বিনির্মাণ করতে পারে, এটি এমন শিক্ষা যা সহস্র বছরে মানুষের অর্জিত ঐশ্বর্যকে প্রবহমান রাখতে পারে এবং যা সুদূর আগামীকে কাঙ্ক্ষিতভাবে গড়ে তুলতেও সক্ষম।

উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নের নাম করে সেখানে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের কায়দাকানুন অনুসরণ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তা হঠকারী হিসেবে বিবেচিত হবে।

ফস্টের সেই ‘নিবিড় শিক্ষাকে’ বিশ্লেষণ করে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিখাদ ধারণা পাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে কী শিক্ষা অর্জিত হলো সেটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কীভাবে তা অর্জিত হলো সে প্রশ্নও মূল্যবান। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অনিশ্চয়তার ও অসীমতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে বিদ্যার্থীর চিন্তায় আগুন জ্বালিয়ে রাখবে বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীরা যেন তাদের সামনে হাজিরকৃত বয়ান বা বিশ্লেষণ নিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য প্রশ্ন তুলতে পারে, ভিন্ন মত দিতে পারে; যেন তথ্যের এই বিশৃঙ্খল জগতে যুক্তি খাঁটিয়ে জ্ঞানের শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে পারে। তারা নিজ থেকেই যেন সুনির্দিষ্ট সমস্যা চিহ্নিত করতে পারে এবং এর জুতসই ও সঠিক সমাধান বের করে আনতে সক্ষম হয়। তারা কোনো বিষয়ের জটিলতা বা অনিশ্চয়তা দেখে যেন বিচলিত না হয়, বরং অদম্য সাহস নিয়ে যেন প্রমাণের ভিত্তিতে সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।

কোনো বিষয়ের আপাত চেহারা দেখে বিভ্রান্ত না হয়ে আন্তশাস্ত্রীয় জ্ঞান প্রয়োগ করে সেখানকার অন্তর্নিহিত সত্য যেন খুঁজে নিতে পারে। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মবিশ্বাস, নিবিড় সৃষ্টিশীলতা, মননের নিবিষ্টতা ও নৈতিকতার গহনতা তৈরি হবে। মানুষ যে পূর্ণতার স্বপ্ন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, তা পূরণে বৈপ্লবিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়কেই মুখ্য ভূমিকা রাখতে হবে।

এই অর্জনগুলো দৃশ্যত ব্যক্তিগত মনে হলেও এটাই দীর্ঘ মেয়াদে জনকল্যাণের জন্য কাজ করবে। একটি উন্নত সমাজের নাগরিকদের মাঝে এসব গুণাবলিই সবচেয়ে বেশি কাঙ্ক্ষিত। আর এসব গুণের উপজাত হিসেবেই তৈরি হবে উদ্যোক্তা হওয়ার মতো বিচক্ষণতা, ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, নেতৃত্বের গুণাবলি, সুদূরে দেখার সক্ষমতা, দলীয় বা যৌথ কাজের স্বাচ্ছন্দ্য, মানিয়ে নেওয়ার উদারতা, কোনো বিশেষ কারিগরি দক্ষতার সঙ্গে সখ্য স্থাপনের সামর্থ্য এবং বিশেষায়িত বিষয়ে গবেষণার পারদর্শিতা। এমনটাই উঠে এসেছে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওফ্রি বোলটন ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কলিন লুকাসের যৌথ গবেষণাপত্রের আলোচনায়।

গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বনিয়াদি কাঠামোগত আয়োজন নিশ্চিত করতে হবে যেন স্বল্প ব্যয়ে ও সহজ ব্যবস্থাপনায় গবেষকেরা সংশ্লিষ্ট কাজে নিযুক্ত হতে পারেন। মানবিক ও সামাজিক বিদ্যার প্রতি মনোযোগ এবং বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিবিড় কর্মকাণ্ডের’ সঙ্গে এই বিষয় দুটো প্রত্যক্ষরূপে সম্পর্কিত। সব অনুষদে আন্তশাস্ত্রীয় জ্ঞানের আদান-প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়কে অতি-প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার জাঁতাকল থেকে মুক্ত রাখতে হবে। উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নের নাম করে সেখানে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের কায়দাকানুন অনুসরণ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তা হঠকারী হিসেবে বিবেচিত হবে। পৃথিবী অতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। পরিবর্তিত পৃথিবীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান জ্ঞানচর্চা যেন তার প্রাসঙ্গিকতার পারদ অক্ষুণ্ন রাখতে পারে, পরিশেষে সেই প্রত্যাশা রাখছি।

লেখক: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক