বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির যুদ্ধ

বিজয়ের মাস, বিশেষ করে বিজয় দিবস, সামনে এলে আমরা একটু নড়েচড়ে বসি। সভা-সেমিনার হয়, গণমাধ্যমে অনুষ্ঠান হয়, খবরের কাগজের বিশেষ সংখ্যা বের হয়। সরকারি–আধা সরকারি আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আলোচনা-র‍্যালি ইত্যাদি হয়। এই যে একটি মাস আমরা মুক্তিযুদ্ধে ফিরে যাই, নতুন করে একে দেখি, তার একটা মূল্য আছে।

স্বাধীনতার পর চার বছর না যেতেই তো মুক্তিযুদ্ধকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা রাষ্ট্রীয়ভাবেই হয়েছে। স্বাধীনতার প্রধান নায়কদের মেরে ফেলে অপ্রধান কিছু চরিত্রকে তাঁদের জায়গায় বসানোর চেষ্টা হয়েছে; যারা একাত্তরে লাখ লাখ বাঙালি হত্যায় সক্রিয় সমর্থন দিয়েছে, তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। এটি চলেছে ২০ বছর। এই ২০ বছর অবশ্য বাঙালি একাত্তরের স্মৃতি অমলিন রাখার সংগ্রাম চালিয়ে গেছে। সরকারের নানা অপচেষ্টার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে।

প্রখ্যাত চেক লেখক মিলান কুন্ডেরা তাঁর দ্য বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং উপন্যাসে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পক্ষ থেকে ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার বিষয়টি উপস্থাপন করে লিখেছেন, ‘ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম হচ্ছে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম।’ আমরা সেই সংগ্রামকে যুদ্ধে উন্নীত করেছিলাম। ফলে আমরা সফল হয়েছিলাম। কিন্তু সফল হওয়া মানে যে একাত্তরের অকৃত্রিম বা অবিকৃত অধিষ্ঠান আমরা করতে পেরেছি, তা নয়। হয়তো মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপরম্পরার, এর নানা কুশীলব ও তাঁদের অবদানকে আমরা মূল্যায়ন করতে পেরেছি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পেছনে যেসব চিন্তাচেতনা কাজ করেছিল, সেগুলো কি আমরা পুনরুদ্ধার করতে পেরেছি? তাদের অধিষ্ঠান ঘটাতে পেরেছি? পাকিস্তানের ২৪ বছর আমরা প্রকট বৈষম্যের শিকার ছিলাম। আমরা চেয়েছি সব বৈষম্যের অবসান ঘটাতে। আমাদের শোষণ করেছে ২২টি পাকিস্তানি পরিবার। আমরা ধনীদের শোষণ ও পুঁজির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রের আদর্শকে তুলে ধরেছিলাম। পাকিস্তানিরা ছিল মুক্তবুদ্ধির চর্চার বিরুদ্ধে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিপক্ষে। আমরা চিন্তার, চিত্তের এবং মতপ্রকাশের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা চেয়েছি। এই চাওয়ার তালিকা ততটাই দীর্ঘ ছিল, যতটা দীর্ঘ ছিল পাকিস্তানিদের হাতে নিষ্পেষিত আমাদের অধিকার ও চাওয়া-পাওয়ার তালিকা।

স্বাধীনতার ৪৭ বছর পার হয়ে গেল। আমরা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শ্রেণিগত বৈষম্য কমাতে পারিনি, বরং বৈষম্য বেড়েছে। এখন বাংলাদেশে ২২ নয়, ২ হাজার ২০০ মহাজনি পরিবার গরিবদের শোষণ করে। স্বাধীন মতপ্রকাশের যেটুকু অধিকার আমরা সামরিক-আধা সামরিক শাসনের মধ্য দিয়েও ধরে রাখতে পেরেছিলাম, গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর আমলে তা অনেকটাই হারিয়েছি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে একটি কঠোর আইন এ বছর সংসদে পাস হয়েছে, যা ডেমোক্লিসের তরবারির মতো আমাদের মাথার ওপর ঝুলছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আমরা যা বুঝি, রাজনৈতিক দলগুলো তাকে একটি বায়বীয় বিষয়ে পরিণত করেছে। আমাদের কাজে-কর্মে-চিন্তায়-পরিকল্পনায়-দৈনন্দিন চর্চায় প্রয়োগযোগ্য একটি বাস্তব উত্তরাধিকার হিসেবে তাকে অবয়ব দিতে পারেনি। যদি তাই হতো, বাংলাদেশ আজ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা হিসেবে আত্মপ্রকাশের পথে অনেকখানি এগিয়ে যেত।

দুই

মুক্তিযুদ্ধকে কতভাবে যে দেখা যায়, তার একটা হিসাব নিলে অবাক হতে হয়। একে ইতিহাস আর রাজনীতির কাচের ভেতর দিয়েই প্রধানত দেখা হয়েছে, অর্থনীতি বা মনস্তত্ত্বের আলোকেও অল্পবিস্তর দেখা হয়েছে। সাহিত্যে-সংস্কৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের যে রূপটি ফুটে উঠেছে, তাতে এর ঐতিহাসিক সত্যের পাশাপাশি কল্পনার সত্যটাও উজ্জ্বল হয়েছে। এই কল্পনার সত্যটা আমাদের অনুপ্রাণিত করে। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে জন্মানো তরুণদের কাছে এই কল্পনার সত্যটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। একাত্তরেও অনেক তরুণ যুদ্ধে গিয়েছেন ইতিহাসের দিকে না তাকিয়ে; দেশমাতা ডেকেছেন, কল্পনায় একটা দোলা দিয়েছেন, সে জন্য। যারা সাহিত্য পড়েনি, সংস্কৃতির কিছু সীমাবদ্ধ অঞ্চলেই যাদের ঘোরাফেরা, তারাও এই সত্যটা গ্রহণ করেছে এবং উজ্জীবিত হয়েছে। একাত্তর নিয়ে তরুণদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে বয়স্কদের, একাত্তরে যাঁরা তরুণ ছিলেন, তাঁদের মিল অনেক সময় না-ও থাকতে পারে।

দু-তিনটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার করা যাবে। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সমুন্নত রাখার চেষ্টা করেছি, তাদের কাছে সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল ১৯৭৫ থেকে শুরু করে পরের কুড়ি বছর। আমাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ ছিল এবং এখনো আছে, একটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার, আদর্শের এবং প্রভাবের বিষয়। আমরা কষ্ট নিয়ে দেখেছি, তরুণেরা ভুল ইতিহাস পড়ছেন, বিভ্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু যত তাঁরা সক্ষমতা অর্জন করেছেন—শিক্ষা, পেশা ইত্যাদির মাধ্যমে এবং যত রাষ্ট্রের প্রচারযন্ত্রের ও উপকরণের (যাতে পাঠ্যবইও অন্তর্ভুক্ত) হাত থেকে দূরে গেছেন, তত তাঁরা মুক্তিযুদ্ধকে খুঁজে নিয়েছেন। এখন ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যতটা জায়গাজুড়ে আছে, আমাদের সময়ে বইপুস্তকেও ততটা ছিল না। এখন একজন তরুণকে যদি কেউ বলে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন অগুরুত্বপূর্ণ নেতা, তিনি মুক্তিযুদ্ধ চাননি, তিনি শুধু হাসবেন। হাসিটা শুধু প্রত্যাখ্যানের নয়, করুণারও। করুণা ওই বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টাকারীর জন্য। এই তরুণদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ একটি স্বতঃসিদ্ধ বিষয়, একে খুঁজে নিতে বেগ পাওয়ার কথা নয়।

আমার যারা একাত্তরে তরুণ ছিলাম, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটি একটি কাঠামোতে সাজানো ছিল। তাতে প্রধান ঘটনা, উপঘটনাক্রম মেনে উপস্থাপিত চরিত্ররাও। মুক্তিযুদ্ধের বইপুস্তকে তাঁরাই উপস্থিত, যাঁরা এই যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে দৃশ্যমান ছিলেন। আমরা তাঁদের নিয়ে গর্বিত। কিন্তু যে অসংখ্য কৃষক, শ্রমিক, নিরন্ন, প্রান্তিক মানুষ মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে অবদান রেখেছেন, যাঁরা দৃশ্যমান ছিলেন না, কিন্তু যাঁদের ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ নয় মাসে শেষ হতো না, তাঁদের কথা খুব কমই আছে। আমি আনন্দের সঙ্গে দেখতে পাচ্ছি, এমনকি একেবারে তরুণ যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখছেন, গবেষণা করছেন, তাঁরাও তাঁদের মনোযোগের কেন্দ্রে রেখেছেন। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাস নিয়ে তাঁরা ভাবেন, তার কল্পনার সত্য নির্মাণে এই অদৃশ্য মানুষদের একটা বড় ভূমিকা ছিল। এক তরুণ তথ্যচিত্রনির্মাতা আমাকে জানালেন, তিনি তিনটি জেলা ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংগ্রহ করেছেন। তিনি এমন চারজন মুক্তিযোদ্ধার সন্ধান পেয়েছেন, যাঁরা সীমান্ত পাড়ি দেননি। যুদ্ধ করেছেন তাঁদের যা কিছু আছে তা–ই নিয়ে। তাঁরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি এবং স্বীকৃতি পাওয়ার বিষয়টিও তাঁরা ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি। এই তরুণের মতো অসংখ্য তরুণ মুক্তিযুদ্ধকে আবিষ্কার করেছেন কাঠামোহীন প্রান্তিকতায়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁদের যে বয়ান, তাতে প্রান্তিকতার গুরুত্ব বেশি, একাত্তরে যেমন ছিল।

এই তরুণেরা গণজাগরণ মঞ্চে ছিলেন, উপস্থিত না হয়েও ছিলেন। এই তরুণেরা প্রচলিত অর্থে রাজনীতি করেন না, কিন্তু রাজনীতি বলতে একাত্তরে আমরা যা বুঝতাম, অর্থাৎ আদর্শ-লক্ষ্যের জন্য সংগ্রাম করা, মানুষের মুক্তির জন্য বিপদ জেনেও লড়াই করা, সেই রাজনীতি তাঁদেরও আমি করতে দেখি। এই তরুণদের ওপরই আমার আস্থা। এঁরা দেশে আছেন, বিদেশে আছেন; কাজে আছেন, পড়াশোনায় আছেন, কেউ কেউ হয়তো বেকার। এঁরা পরিবেশ নিয়ে ভাবেন, দেশ নিয়ে ভাবেন। এঁরা নিজেদের মতো মুক্তিযুদ্ধকে আবিষ্কার করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এঁদের অহংকার। আমার দুঃখ লাগে, যখন দেখি দেশের একটি বড় দল দীর্ঘদিন এই অহংকারের জায়গাটিতে ধস নামাতে চেষ্টা করেছে। তারা সফল হয়নি বটে, কিন্তু কেন, ঠিক কী কারণে এ কাজটি তারা করল, তার কোনো ব্যাখ্যা তারা দেয়নি।

তিন

এই বিজয়ের মাস শেষ হবে একটা নির্বাচন দিয়ে। নির্বাচনটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বছর পর প্রায় সব কটি রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে আছে—জামায়াতে ইসলামীও আছে, তবে ধানের শীষ প্রতীকে। এই মাস তিনেক আগেও একটা শঙ্কা ছিল নির্বাচন আদৌ হয় কি না, তা নিয়ে। সেই শঙ্কা দূর হলো, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট হলো। সংলাপ হলো। আমরা আশার আলো দেখলাম। আমরা শুনলাম, বিএনপি নতুনভাবে নামছে ভোটে, জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দিয়ে। আমরা ভাবলাম, হয়তো একাত্তর নিয়ে বিভ্রম তৈরির পথ থেকে দলটি সরে এসেছে, হয়তো একাত্তর নিয়ে আর কোনো বিতর্ক তৈরি হবে না, ইতিহাসকে দলটি সম্মান দেখাবে। কিন্তু দ্রুত পাল্টে গেল দৃশ্যপট। বিএনপি শুধু জামায়াতকে টেনে নিল না, তাদের হাতে শীষ তুলে দিল; অর্থাৎ যে বদলের কথা শোনা গিয়েছিল, সবই ভুল ছিল।

একটা শঙ্কা এখন দেখা দিচ্ছে আমাদের অনেকের মধ্যে—যদি ধানের শীষ এই নির্বাচনে জিতে যায়, সরকার গঠন করে, পাঠ্যপুস্তকসহ সব প্রচারযন্ত্র ও উপকরণের মালিকানা গ্রহণ করে, তাহলে কি আবার তারা তাদের সম্পাদনায় একাত্তরের যে ইতিহাস তারা জাতিকে দিয়েছিল, তার পুনরাধিষ্ঠান হবে? আবার আমাদের স্মৃতিকে যুদ্ধ করতে হবে বিস্মৃতি এবং ভুলিয়ে দেওয়ার প্রকল্পের বিরুদ্ধে?

তবে তরুণদের ওপর আমার আস্থা আছে বলে বলতে পারি, কাজটি বিএনপি সরকারের জন্য সহজ হবে না। ঐক্যফ্রন্টের নেতারা (তাঁদের কেউ কেউ তখন মন্ত্রী হবেন হয়তো) নিশ্চুপ বা অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে রাখলেও তা সম্ভব হবে না।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ