বীথি রানীর পোড়া বেনারসির গল্প

রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তিতে আগুনে পুড়ে গেছে বাসিন্দাদের সর্বস্ব। সব হারিয়ে নিঃস্ব মানুষেরা বাক্‌রুদ্ধ। পুড়ে যাওয়া ভিটায় বসে ভবিষ্যৎ শঙ্কায় মফিজ উদ্দিন ও কাজল। ২৪ নভেম্বর সকালে
ছবি: সাজিদ হোসেন

শাঁখা পরা দুটি হাতে মেয়েটি কী যেন খুঁজছে। পোড়া মাটিতে হাঁটু গেড়ে শিশুটিও খুঁজছে। ভেজা গায়ের পুরুষেরাও খুঁজছে। বীথি রানীর বিয়ের শাঁখা দুটি পোড়েনি, পুড়েছে বিয়ের বেনারসি। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া তানিয়া বইয়ের ছড়াগুলো ভোলেনি, গল্পগুলো ঠিকঠাক আবার বলতে পারবে সে; কিন্তু যে বইগুলো তাকে এসব শেখাল, বস্তির আগুনে সব পুড়ে গেছে। বীথি রানী একা নন, তানিয়াও একা নয়। তাদের মতো সবারই সবকিছু পুড়ে গেছে।

রাজধানী ঢাকায় গত সোমবার রাত থেকে গতকাল মঙ্গলবার মধ্যরাত পর্যন্ত তিন স্থানে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে মহাখালীর সাততলা বস্তি, মোহাম্মদপুরের বিহারিপট্টি ও মিরপুরের কালশী বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন বাউনিয়াবাদের বস্তির আগুনের ঘটনা। ছয় বছর আগে এই কালশীর বিহারি বস্তিতে পরিকল্পিতভাবে দেওয়া আগুনে এক পরিবারের সবাই মারা গিয়েছিল। এক বৃদ্ধা তখন চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘গুলি খায়া কা হাম। হামাদের জন্য কানুন নাই সাহারা নাই?’ না, বস্তিবাসীদের জন্য কোনো আইন নেই, আশ্রয় নেই।

এই যে বিয়ের স্মৃতিস্বরূপ বেনারসি শাড়ি, এই যে তানিয়ার পড়ালেখার বইগুলো, এই যে সন্তানের মাথার ওপর একটা ছাদের জন্য হাহাকার—সচ্ছল মানুষদের আবেগের সঙ্গে বস্তির ঊনমানুষদের আবেগের কী টনটনে মিল। কিন্তু তাদের পরিণতি কখনো হয় না তো এক।

গ্রামের ভিটা অভাবের আগুনে না পুড়লে কেউ শহরের বস্তিতে আসে না। বস্তির ঘরগুলোতে আগুন লাগালে তাদের আর যাওয়ার জায়গা থাকে না। আগুন লাগলে পালানোই নিয়ম। সেই আদিম অরণ্যের প্রথম মানুষেরাও দাবানলের তাড়ায় একসঙ্গে পালাত। কিন্তু বস্তিবাসীরা পালায় না। এক হাতে সন্তান আর আরেক হাতে যা নিতে পারা যায়, তা নিয়ে তারা দৌড়ে আগুনের আওতার বাইরে আসে। কিন্তু পালায় না। একসঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়ে আগুন নেভানোয় ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেরিতে হলেও একসময় দমকল বাহিনী আসে। আগুন নিভলে পরে দেখা যায়, দিন এনে দিনে খাওয়া আয় নিংড়ে তিল তিল করে দাঁড় করানো তাদের সংসারের অর্ধেকটা পোড়া ছাই, বাকি অর্ধেকটা দমকলের ছিটানো পানিতে ভেজা। সেই ভেজা ছাইয়ের মধ্যে দেখা যায় নারীদের, পুরুষদের, শিশুদের। কিছু বেঁচে গেল কি না, কোনো জিনিস বা কোনো স্মৃতি দগ্ধ হওয়া থেকে বাঁচল কি না—খুঁজতে থাকে।

সমস্যাটা এখানেই। তাদের সংসারগুলোও মানুষেরই সংসার, তাদের জীবনটাও মানুষেরই জীবন। তাদের বিয়ের শাড়ি, বাচ্চার পড়ার বই, গেরস্তালি জিনিসপত্র—সবকিছুতেই নিদারুণ মানবিক চিহ্ন। একসঙ্গে সব পুড়িয়ে দিতে পারে যারা, তারা হয়তো মানুষ নয়। মানুষের চেয়ে বেশি কিছু। তারা হয়তো রূপকথার ড্রাগন, যার নিশ্বাসের আগুনে জনপদ পুড়ে যায়। যেমন আরাকানের রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পোড়ানো হয়েছে আর তারা নাফ নদীতে বঙ্গোপসাগরের স্রোতে নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছে। এমন ঘটনাও আছে, মা–বাবা আসতে পারেনি, কিন্তু বাচ্চাকে তুলে দিয়েছে শরণার্থীদের নৌকায়। কোনো মা তার সন্তানকে পানিতে ভাসায় না, যদি না মাটির চেয়ে অকূল দরিয়া তার কাছে নিরাপদ মনে না হয়। কোনো গ্রামবাসী শহরের বস্তিতে আসে না, যদি গ্রামের অর্থনীতি তাদের উগড়ে দেয় শহরের পথে। কেউই বস্তির ৭ ফুট বাই ৭ ফুট ঘরে ৭–৮ জনের পরিবার নিয়ে থাকে না, যদি না রাষ্ট্র–সরকার তাদের ‘বাতিল মাল’ বলে গণ্য না করে! তাদের বসবাস সামাজিক নো–ম্যানসল্যান্ডে, বঞ্চনার না–মানুষী জমিনে।

নো–ম্যানস ল্যান্ডে রাষ্ট্রের আইন ও এখতিয়ার খাটে না। বস্তি হলো সেই নিমানুষি জমিন, যেখানকার অধিবাসীদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সেবা দেয় না, কিন্তু যাদের সস্তা শ্রমের সেবা নগরের সচ্ছল মানুষেরা উপভোগ করে। যাকে বলা হয় ইনফর্মাল ইকোনমি, আমাদের অর্থনীতিতে তার অবদান ৪০ শতাংশ। এর অর্থ এই অর্থনীতিতে ৪০ ভাগ মূল্য যোগ করে যারা, সেই অর্থনীতি তাদের জন্য ৫ শতাংশও খরচ করে, তাদের সঙ্গে বেইমানি করে। ইউনিসেফের হিসাবে ঢাকার ৫ হাজার বস্তিতে বাস করে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ, এদের বড় একটি অংশ নারী ও শিশু। এরাই ঢাকার অনেক কিছু সচল ও পরিষ্কার রাখে, উন্নয়নের শ্রমশক্তির জোগান দেয়, ঘর–গেরস্তালির মূল শ্রমশক্তিও এরাই। এদের ছাড়া ঢাকা কেন, দেশও চলতে পারবে না।

অর্থনীতিবেদরা তাই অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিকে অনেক গুরুত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সাড়া কম। যদি এই বস্তিবাসীদের শ্রম আমাদের দরকার হয়, যদি আমাদের দেশি নিত্যপ্রয়োজনীয় ও মনিহারি পণ্যের বড় একটা অংশের ক্রেতা তারা হয়, এভাবে যদি তারা অর্থনীতির একটা বড় জোগানদাতা হয়, তাহলে তাদের জন্য কেন আবাসন থাকবে না? সার্বক্ষণিক আগুন আর উচ্ছেদের ভয় নিয়ে কেন বস্তির জীবন কাটবে? কেন উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরও বস্তি উচ্ছেদ হয়? কেন একের পর এক আগুন লাগার ঘটনার কোনো সুরাহা হয় না?

প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা। এসব প্রশ্নের মূলের প্রশ্ন একটাই: ঢাকা কাদের শহর? এই ৪০ লাখ বস্তিবাসীর শহর যদি তা হতো, তাহলে আরও এক কোটি মধ্যবিত্তের জন্যও এই শহর আরও মানবিক হতে পারত। এই রাজধানী গরিবের নয় বলেই বীথি রানীর পোড়া বেনারসি, কালশীর সলমা জরির কারিগর বদরুদ্দীনের ঘর কিংবা তানিয়ার পাঠ্যবই অকাতরে পুড়ে যায়, আর মধ্যবিত্ত সেসবের দর্শক হয়।

যখন পুড়ছে না, তখনো বস্তির জীবন এক যুদ্ধ। সেটা কমই খবর হয়। বাংলাদেশিদের প্রাণশক্তির পরিচয় পেতে তাই গুলশান-বনানীতে গিয়ে লাভ নেই, যেতে হবে বস্তিতে বস্তিতে। বড় বস্তি মানে বারবার আগুনে পোড়ার ইতিহাস। এবং বারবার আগুনকে পরাজিত করে আবার জীবনের খুঁটি পোঁতার ইতিহাস।

ফারুক ওয়াসিফ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও লেখক।

[email protected]