বৃদ্ধাশ্রম এখন সময়ের দাবি

কুষ্টিয়ার বাজিতপুর গ্রামের এক কৃষকের চার মেয়ে, এক ছেলে। ছেলের বাড়িতে বৃদ্ধ বাবার ঠাঁই হয়নি। মেয়েরা পালা করে তাঁকে রাখতেন। ব্যাপারটা জামাইদের পছন্দ হতো না। সেজ মেয়ের বাড়িতে এক রাতে খাবারের জন্য অনেকক্ষণ বসে থেকেও শেষ পর্যন্ত কেউ খাবার দিয়ে গেল না দেখে বৃদ্ধ ট্রেনে চেপে ঢাকায় চলে এলেন। এক হিতাকাঙ্ক্ষী তাঁকে বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে গেলেন। সেখানে তিনি শান্তিতে আছেন। 

আমাদের গড় আয়ু বেড়ে এখন ৭২ বছর ৩ মাস ১৮ দিন। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ প্রবীণ। সামাজিক-পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধির ফলে তাঁদের জন্য ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। প্রথম আলোর এক গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রবীণেরা একাকিত্ব ও দারিদ্র্যে অসহায় এবং সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবারে বিভিন্ন পর্যায়ে বৈষম্যের শিকার। প্রবীণহিতৈষী সংঘের মহাসচিব বলেন, প্রবীণ নারীর চেয়ে প্রবীণ পুরুষ সামলানো সহজ; যেমন বৃদ্ধাশ্রমে, তেমনি বাড়িতেও। এ সমাজব্যবস্থায় নারী শৈশবে পিতার, যৌবনে স্বামীর, বার্ধক্যে পুত্রের আশ্রিতা। তাই বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দারা নারী-পুরুষনির্বিশেষে পুত্রের ঘাড়ে দোষ চাপান। আবার বলা হয়, পুত্ররা তো ভালোই ছিল, তাদের প্ররোচিত করে তাদের স্ত্রীরা। 

নারীরা সন্তান জন্ম দেন, লালনপালন করেন। তাই আবেগটাও পিতার চেয়ে মাতারই অধিক। উপায়ান্তর না দেখে মায়েরা স্বেচ্ছায় হোমে যান। এমন কিছু নারীকে জানি, যাঁরা স্বাধীনচেতা। তাঁরা সন্তানদের মধ্যে ঝামেলা-যন্ত্রণার কারণ হতে চান না। পুত্র-পুত্রবধূ বা কন্যা-জামাতাদের নিজস্ব জীবনযাপনকে সম্মান দেখিয়ে নিজের মতো একান্ত জীবন খুঁজে নেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রবীণ নারী অধ্যাপক বলছিলেন, ‘নাতিদের নিয়ে মাঝেমধ্যে কদিন সময় কাটাতে ভালো লাগে। একটানা পেলে মানুষ করার ক্ষমতা আর নেই।’ কিন্তু কজন নানি-দাদি কর্মজীবী ছেলে-বউ, মেয়ে-জামাইয়ের মুখের ওপর বলে দিতে পারেন ‘আর পারব না বাপু, এই বেলা নিজেদের মতো করে খাও’। 

ইউরোপ-আমেরিকায় ভিসা পাওয়া কঠিন। কিন্তু প্রসবাসন্ন কন্যা-পুত্রবধূর আবেদন উন্নত বিশ্বের মানবিক সরকার অগ্রাহ্য করতে পারে না। ভিসা পেয়ে নাতি-পুতির মুখ দেখতে গিয়ে আটকে যান প্রবীণেরা। পিচ্চিরা বড় হয়, প্রবীণেরা হন আরও প্রবীণ। তখন বাস্তবতার চাপ এমন হয় যে হয় নিজভূমে ফিরতে হয়, না হলে সমগোত্রীয়দের পাশে বৃদ্ধাশ্রমে। ফেসবুকের কল্যাণে জানা গেল, লন্ডনবাসী সন্তানসন্ততিদের বিমুখতায় এক বয়সী নারী দেশে ফিরে আশ্রয় নিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমে। তিনি এখন ভালো আছেন বলে জানিয়েছেন। 

সংগতি ও সহনীয় পরিবেশ থাকার পরও যে সন্তানেরা মমতাময় জনক-জননীকে দূরে ঠেলে দেয়, তাদেরও কি একদিন একই পরিণতি হতে পারে না? যেসব প্রবীণের আর্থিক সংগতি আছে বা নেই কিন্তু মর্যাদাবোধ ও ক্ষমতার লড়াইয়ে না যাওয়ার মানসিকতা আছে, তাদের জন্য প্রবীণনিবাস উপযুক্ত আনন্দাশ্রম। উন্নত বিশ্বে সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রবীণ নিবাসগুলো নানা সুযোগ-সুবিধাপূর্ণ ও আরামদায়ক। ছোট পরিবারের যুগে এসে এখন আমাদের দেশের গ্রামের বাড়িতে অনেক প্রবীণ একা। কারণ, তাঁদের সন্তানেরা শহরে থাকে। আবার শহরের অনেক ফ্ল্যাটের রেলিং ধরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকেন বৃদ্ধ বাসিন্দারা, কারণ তাঁদের পুত্র-কন্যারা বিদেশে। যঁাদের সংগতি আছে, তাঁরা দেশের ভেতরে-বাইরে মাঝেমধ্যে ঘুরে বেড়ান, যাঁদের নেই, তাঁদের কেবলই অপেক্ষা। বেশি বয়স্কদের সেবাযত্ন করার জন্য অবস্থাপন্ন সন্তানেরা লোক রেখে দেন। এসব লোকের কেউ কেউ অর্থসম্পদের লোভে নিরাপত্তাহীন বৃদ্ধদের নির্যাতন করে, হত্যার ঘটনাও একেবারে বিরল নয়। 

অনেক আগে যখন আমাদের দেশের যৌথ পরিবারের হই–হুল্লোড়ের মধ্যে শুনতাম বিদেশে নাকি বুড়ো হলে মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসে, তখন ওসব দেশের লোকদের প্রতি ঘৃণা ও করুণা হতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। এখন বৃদ্ধাশ্রম বা প্রবীণনিবাস সময়ের দাবি। কিছুদিন আগে ভারত ভ্রমণে গিয়ে দেখলাম উন্নত বিশ্বের ওল্ড হোম বা নার্সিং হোম থেকে আসা বয়স্ক পর্যটকেরা প্রাণবন্ত, উৎসবমুখর। আমাদের দেশেও বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে আতঙ্ক বা ছুঁতমার্গের দিন শেষ হয়ে আসছে। কিছুদিন পর প্রবীণনিবাস প্রবীণদের কাছে ঈপ্সিত হয়ে উঠবে বলেও অনেকে বিশ্বাস করেন। কারণ, নিবাসগুলো যত দিন যাচ্ছে, ততই চাহিদাভিত্তিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে হাজির হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের আদলে নিরাপত্তা, চিকিৎসা, বইপড়া, বিনোদন, ঘুরে বেড়ানো—সবই থাকছে এখানে। 

সরকারি সেবা কার্যক্রমে প্রবীণদের প্রবেশগম্যতা সীমিত। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় দেশের ছয়টি বিভাগীয় সদরে প্রবীণনিবাস আছে বলে মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি জানান। প্রতিটিতে ৫০ জনের থাকার ব্যবস্থা আছে। প্রবীণদের জন্য সর্বজনীন পেনশন ভাতায়ও সীমাবদ্ধতা আছে। প্রবীণদের সম্পদ হিসেবে ভাবতে হবে। তাঁদের শারীরিক সক্ষমতা সীমিত হয়ে এলেও অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান দিয়ে তরুণদের সমৃদ্ধ করতে পারেন। সরকারি-বেসরকারি-ব্যক্তিক—সব পর্যায় থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। একবার ফ্লাইট মিস হওয়াতে শিকাগো এয়ারপোর্টে রাত কাটাতে হয়েছিল। অনেক রাতে দেখলাম, এক অশীতিপর নারী জানালার কাচ মুছে বেড়াচ্ছেন। বেশ সচল। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর এক কোম্পানি তাঁকে কাজ দিয়েছে। তিনি এখন একা। এ বছরের উপার্জনটা তিনি কম্বোডিয়া ভ্রমণের জন্য জমাচ্ছেন বললেন। 

 বিশেষজ্ঞরা বলেন, জনসংখ্যার যে জনমিতির সুবিধা এখন বাংলাদেশে আছে, তা ৩০ থেকে ৩৫ বছর পর আর থাকবে না। এই প্রবীণদের কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা এখন থেকেই ভাবতে হবে। ভাতা দেওয়ার পরিবর্তে কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ ফাউন্ডেশন গঠনের পরামর্শ দেন তঁারা। জন্মহার কমাতে কমাতে চীন-জাপানকে এখন বৃদ্ধদের দেশ বলে বিবেচনা করা হয়। চীনে প্রতি ১০ জনে ১ জন বৃদ্ধ। জাপানে মোট জনসংখ্যার শতকরা ৩৩ ভাগ বৃদ্ধ। আমরা প্রবীণদের ভালো রাখতে চাই। তার জন্য সরকারিভাবেও প্রয়োজন ব্যাপক কর্মসূচি। 

উম্মে মুসলিমা সাহিত্যকর্মী