বৃষ্টি ঝরিবেই, বালিকারা বিবাহ করিবেই, ঘটিতে দাও...

‘বৃষ্টিকে অবশ্যই ঝরিতে হইবে, বালিকারা অবশ্যই বিবাহ করিবে, এই সমস্ত ঘটনা প্রতিরোধ-অযোগ্য, তাহাদিগকে যাইতে দাও।’ চীনারা প্রবাদ দিয়া, কবিতা দিয়া কথা কহিতে ভালোবাসে। এই যে উক্তিটি, বৃষ্টিকে অবশ্যই ঝরিতে হইবে...ইহা মাও সে তুংয়ের। প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্শাল লিন বিয়াওয়ের সহিত মাও সে তুংয়ের শত্রুতা দেখা দিল। লিনের ছেলে মাওকে হত্যা করিবার জন্য কাঁচা প্লট সাজাইল। শেষে লিন বিমানে উঠিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে পলাইতে শুরু করিলেন। চৌ এন লাই বলিলেন মাওকে, বিমানটা উড়াইয়া দিই, অর্ডার দিন। মাও তখন এই দার্শনিক প্রবাদটা বলিয়াছিলেন। বৃষ্টি ঝরিবেই, বালিকারা বিবাহ করিবেই, লিন পলাইয়া যাইবেই, যাইতে দাও। সে ১৯৭১ সালের কথা। মাও তাহার শত্রু মার্শাল লিনকে যাইতে দিয়াছিলেন কি না জানি না। কারণ, এই বিমানটি মঙ্গোলিয়ার কাছে গিয়া বিধ্বস্ত হয়! বলা হইয়া থাকে, বিমানটির তেল ফুরাইয়া গিয়াছিল।

এই প্রবাদটি অদ্য, ১৮ নভেম্বর ২০২১, প্রথম আলো কাগজটি হাতে লইয়া পাঠ করিতে করিতে মনে পড়িয়া গেল। প্রবাদটি নির্ভুলভাবে চয়ন করিবার জন্য শ্রীনাথ রাঘবনের ১৯৭১ বইটা শেলফ হইতে পাড়িয়া আনিলাম। আসলেই বৃষ্টি পড়িবেই, উহাকে পড়িতে দাও, বালিকারা বিবাহ করিবেই। তাহাদিগকে বিবাহ করিতে দাও।

মাও সে তুং কি বাল্যবিবাহের কথা কহিয়াছিলেন? আমার মনে হয় না। বড় হইলে, বিবাহের বয়স হইলে বালিকারা বিবাহ করিবে, হয়তো তাহা বলিয়াছিলেন। আমাদের দেশে আমরা নানান উন্নয়ন সূচকে ভালো করিতেছি, টিকা দিয়াছি, মাতৃমৃত্যু-শিশুমৃত্যু কমাইয়া আনিয়াছি, স্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন করিতেছি, শুধু বাল্যবিবাহ কমাইতে পারিতেছি না। কেন পারিতেছি না, তাহার নানা কারণ আছে, গবেষকেরা তাহা আমাদের জানাইতেছেন। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল জরিপে বলা হইতেছে, পারিবারিক সুনাম হারাইবার ভয়, শিশুমেয়েকে একা রাখিয়া যাইবার ভয়, যৌন হয়রানি-ধর্ষণের ভয় হইতেও বাল্যবিবাহ হয়। ইহার সহিত আছে দারিদ্র্য। একটা বালিকাকে খাওয়াইয়া-পরাইয়া স্কুলে পাঠাইয়া দিবার খরচ নির্বাহের চাইতে তাহাকে বিবাহ দিয়া দেওয়া পিতা–মাতার জন্য সহজ। যাহা হউক, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কিমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকি বলিয়াছেন, ছেলে ও মেয়েরা পরস্পরের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ বোধ করিয়া পলাইয়া বিবাহ করে, ইহা বাল্যবিবাহের একটি বড় কারণ। ব্যাখ্যাও আছে, পৃথিবীর অন্য দেশে ছেলেমেয়েরা বিবাহ না করিয়াই চাহিদা মিটাইতে পারে, বাংলাদেশে তাহা করা অসম্ভব।

আমরা এই সমস্ত কথাবার্তার মধ্যে কোনো ফোড়ন কাটিব না। কারণ, বৃষ্টি পড়িবেই, বালিকারা বিবাহ করিবেই, মাও সে তুং ক্ষমতায় থাকিবেই, লিনের প্লেন ভাঙিয়া পড়িবেই। কার্টুনিস্ট কিশোর মামলা করিয়াছিলেন নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে। গ্রেপ্তার দেখাইবার আগে তাঁহাকে ধরিয়া অজ্ঞাত স্থানে লওয়া হয়, আর তাঁহার উপরে নির্যাতন চালানো হয়, এই আছিল অভিযোগ। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন
(পিবিআই) তদন্ত করিয়াছে। তাহারা বলিয়াছে, কিশোরকে তুলিয়া লইয়া যাইবার কিংবা অজ্ঞাত স্থানে রাখিয়া নির্যাতন করিবার কোনো সাক্ষ্য ও প্রমাণ তাহারা পায় নাই। সংশ্লিষ্ট র‌্যাব কর্মকর্তাকে পিবিআই জেরা করিয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগে কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়, তাঁহাকে কোনো গোপন স্থানে লইয়া যাওয়াও হয় নাই, কোনো রকমের নির্যাতনও করা হয় নাই। পিবিআই প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, বাদী কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ দেখাইতে পারে নাই। বৃষ্টি পড়িবেই, বালিকারা বিবাহ করিবেই, লিন পলাইয়া যাইবেই, আমাদের কী বলিবার আছে।

অন্তত বাল্যবিবাহ–শিশুবিবাহ রোধ করিবার জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা কি আমরা করিব না? আমরা যদি খাওয়ার স্যালাইন জনপ্রিয় করিতে পারিয়া থাকি, যদি টিকা দিতে পারিয়া থাকি, যদি স্যানিটেশনে অগ্রগতি করিতে পারি, ইহা কেন পারিব না? প্রথম আলোর শেষ পৃষ্ঠার শিরোনাম: জনসচেতনতা ও প্রচারে কমে বাল্যবিবাহ। তাহা হইলে আসুন, প্রচার করি

রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলায় ধর্ষণ প্রমাণিত হয় নাই, আসামিরা নির্দোষ, সেই মামলার লিখিত রায়ে বিচারক আর ধর্ষণ ঘটনার ৭২ ঘণ্টার পর মামলা না লইতে পুলিশকে সুপারিশ করেন নাই। যদিও ইতিমধ্যে এই বিচারককে বিচারকার্য হইতে সরাইয়া রাখা হইয়াছে। বৃষ্টি পড়িবেই, অভিযোগ প্রমাণিত না হইলে আসামিরা ছাড়া পাইবেই, আমাদের কী করিবার আছে?

সদ্য গঠিত গণ অধিকার পরিষদের নেতা রেজা কিবরিয়া আর ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক মওলানা ভাসানীর টাঙ্গাইলের সমাধিস্থলে গেলে হামলার শিকার হন। রেজা কিবরিয়ার মাথায় ইটের আঘাতও লাগে। এই বিষয়ে ছাত্রলীগের মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক বলেন, শ্রদ্ধা জানাইতে আসিয়া রেজা কিবরিয়াদের দল ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের উপরে হামলা চালান। তখন ছাত্রলীগ তাহা প্রতিরোধ করে মাত্র। ফটোতে দেখা যাইতেছে, পুলিশের ট্রাকে আশ্রয় লইয়াছেন গণ অধিকার পরিষদের নেতারা, আর ট্রাকের দিকে আঘাত হানিতে বড় বড় লাঠি উদ্যত করা হইয়াছে...কে কাহাকে আক্রমণ করিতেছে, কে বা প্রতিরোধ করিতেছে...এই সমস্ত লইয়াও আমাদের কিছুই বলিবার নাই। কারণ, বৃষ্টি পড়িবেই, আপেল গাছ হইতে নিচেই নামিবে, বালিকারা বড় হইলে বিবাহ করিবেই, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন আগে আক্রান্ত হইবে এবং পরে প্রতিরোধ করিবে...

গতকালের প্রথম আলোর প্রধান খবর হইল: বেশি ভাড়া আদায় চলিতেছেই...যাত্রী-শ্রমিক হাতাহাতি হইতেছে, যাহা ইচ্ছা তাহা ভাড়া চাওয়া হইতেছে। আর বুয়েটের অধ্যাপক সামছুল হক বলিতেছেন, ঢাকার বিশৃঙ্খল বাসসেবার সুফল যাঁহারা পান, তাঁহারা নেতৃত্বে আছেন। তাঁহাদিগকে নিয়ন্ত্রণ করা বিআরটিএর কম্মো নহে। ঢাকার বাসমালিকেরা বা বাস ব্যবসার সুবিধাভোগীরা নেতৃত্বেও থাকিবেন, এই রূপই চলিবে, চলিতে দাও।

রাজশাহীর খবর: ইয়াবাসহ পুলিশের এএসআইকে আটক করিয়াছে বিজিবি। সাদাপোশাকে এক পুলিশ সদস্য ৪০০ ইয়াবা বড়িসহ মোটরবাইকযোগে যাইতেছিলেন। বিজিবির ক্যাম্পের পাশে তঁাহাকে থামানো হয়। ৪০০টি ইয়াবা পাওয়া গেলে তঁাহাকে আটক করা হয়! এইবার মাও সে তুংয়ের প্রবাদ কোনরূপে বলিব বুঝিতেছি না। ইয়াবা লইয়া মোটরবাইকচালকেরা যাইবেই, তাহাদিগকে যাইতে দাও, নাকি ইয়াবা পাওয়া গেলে বিজিবি আটক করিবেই, তাহাদিগকে আটক করিতে দাও!

একটি সুখবরও আছে প্রথম আলোয়। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় ঘুষ সাধায় ব্যবসায়ীকে পুলিশে দিলেন এসি ল্যান্ড। আমরা জানি, নাই নাই করিয়াও আমাদের দেশে এখনো সৎ মানুষ আছেন, সংখ্যায় অতি অল্প, কিন্তু আছেন। এসি ল্যান্ড সাখাওয়াত জামিল তাঁহাদের একজন, আমরা বিশ্বাস করি, তাঁহাকে সালাম জানাই। ঘুষদাতা ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে বড় বেশি পীড়াপীড়ি করিয়াছিলেন। এসি ল্যান্ড তাঁহাকে পুলিশে সোপর্দ করেন। এখন আশঙ্কা হইল, এই এসি ল্যান্ড প্রমাণ করিতে পারিবেন তো যে অভিযুক্ত ব্যক্তি তাঁহাকে ঘুষ সাধিতে আসিয়াছিলেন! তাহা না হইলে অভিযুক্ত কিন্তু ছাড়া পাইয়া যাইবেন!

যাহা হউক না কেন, আমরা সাধারণ নাগরিক, এই সমস্ত ভাবিয়া মাথার চুল ছিঁড়িয়া মাথায় আগেভাগে টাক ফেলিবার আমাদের প্রয়োজনটাই-বা কী! বৃষ্টি পড়িবে, বাতাস বহিবে, পাকা ফল বৃন্তচ্যুত হইবে, বালিকারা বিবাহ করিবে, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল মাঝেমধ্যে জিতিবে, বাকিগুলাতে হারিবে, তেলের দাম বাড়িবে, জিনিসপত্রের দাম কোনো দিনও কমিবে না, বাসে যাত্রী আর কন্ডাক্টর বচসা করিবে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মারামারি–খুনোখুনির জন্য বিএনপিও দায়ী থাকিবে, ঢাকার রাস্তায় ভিক্ষুকের আধিক্য হইবে...

আমাদের কিছুই করিবার নাই।

কিছুই কি করিবার নাই?

অন্তত বাল্যবিবাহ–শিশুবিবাহ রোধ করিবার জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা কি আমরা করিব না? আমরা যদি খাওয়ার স্যালাইন জনপ্রিয় করিতে পারিয়া থাকি, যদি টিকা দিতে পারিয়া থাকি, যদি স্যানিটেশনে অগ্রগতি করিতে পারি, ইহা কেন পারিব না? প্রথম আলোর শেষ পৃষ্ঠার শিরোনাম: জনসচেতনতা ও প্রচারে কমে বাল্যবিবাহ। তাহা হইলে আসুন, প্রচার করি।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে কিসিঞ্জার নিউইয়র্কে চীনের প্রতিনিধি হুয়াং হুয়াকে বলিয়াছিলেন—চীন আক্রমণ করুক ভারতকে। চীন তাহাতে রাজি হয় নাই। হুয়াং হুয়া প্রবাদ বলিয়াছিলেন। যদি পূর্বে অন্ধকার নামে তাহা হইলে পশ্চিমে আলো আসিবে, যদি উত্তরে তমসা নামে, তবে দক্ষিণে আলো আসিবে।

অদৃষ্টবাদীর মতো প্রবাদ বলা ছাড়া আর কী করিব?

আনিসুলহকপ্রথমআলোরসহযোগীসম্পাদকওসাহিত্যিক