‘বেলা শেষে’ কেন হলো ছাড়াছাড়ি

মেলিন্ডা গেটস ও বিল গেটস
ছবি: রয়টার্স

‘ওরে বুজি, শুনিছিস কি আচানক ঘটনা! এই বুড়ো বয়েসে জেনিফারের বাপ-মার নাকি ছাড়াছাড়ি অইয়ে গেইছে!’

বিল গেটস আর মেলিন্ডা গেটসের বাড়ি যদি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী বা টুঙ্গিপাড়ায় হতো, তাহলে নির্ঘাত সেখানকার কোনো না কোনো মুরব্বি স্থানীয় ‘লোকাল বিবিসি’ ওপরের কোটেশনে আটকানো ভাষায় খবরটা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সারা গ্রামে রাষ্ট্র করে দিতেন।

তারপর বিল কোন বংশের লোক এবং মেলিন্ডা কোন বাড়ির মেয়ে, তাই নিয়ে হাবিলের বাপের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে কাবিলের মায়ের বরইতলায় ব্যাপক ‘গুজুর গুজুর-ফুসুর ফুসুর’ চলত।

এর কারণ, ২৭ বছর সংসার করে তিন ছেলেমেয়ের বাবা-মা হওয়ার পর কোনো সচ্ছল, শিক্ষিত ও পরিণত বয়সের দম্পতির ডিভোর্সকে বাঙালি মানস কোনোকালেই সহজভাবে নিতে পারেনি। আজও পারে না। আর তা পারে না বলেই এ ধরনের ছাড়াছাড়ির মতো একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়েও বাঙালির কৌতূহল বিরাট।

বলা বাহুল্য হলেও লেখা দরকার, বিল আর মেলিন্ডার বাড়ি গোপালগঞ্জ বা নারায়ণগঞ্জে না হলেও তাঁদের নিয়ে গোপালগঞ্জ বা নারায়ণগঞ্জ বা সুনামগঞ্জের চায়ের দোকানে কিংবা বরইতলায় আলাপ-আলোচনা কম হয়নি। সেখানকার লোকজনও ফেসবুক যথেষ্ট গরম করেছে।

এই দম্পতির ডিভোর্স ইস্যুতে আলাপ-আলোচনার জন্য শুধু বাঙালিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। গোটা বিশ্ব মিডিয়া এই খবর বড় করে প্রচার করেছে। কারণ, এই ডিভোর্স কোনো ‘একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়’ নয়।

এই ছাড়াছাড়ির সঙ্গে ১৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের সম্পত্তি ভাগাভাগি এবং তার জেরে বিশ্বব্যাপী বহু মানুষের স্বার্থের ইস্যু জড়িয়ে আছে। এটিই এই বিচ্ছেদবিষয়ক চর্চার বড় কারণ।

ওয়াশিংটন থেকে মস্কোয়, দিল্লি থেকে ঢাকায়, গোপালপুর থেকে ফরিদপুরে এখন প্রশ্ন উঠছে, ‘বিল আর মেলিন্ডার বিশাল সম্পত্তির ভাগ কীভাবে হবে? তাঁরা কে কত পাবেন?’
অগাধ অর্থের মালিক হওয়ায় এই দুজনের বিচ্ছেদ প্রসঙ্গে বারবার সেই জাগতিক অর্থকড়িই এসে দাঁড়াচ্ছে।

এই দুজন রক্ত-মাংসের মানুষের মধ্যে যে আবেগ-অনুভূতি ও মান-অভিমানের মতো অবৈষয়িক বিমূর্ত বিষয় থাকতে পারে, সূক্ষ্ম রুচির অতি সূক্ষ্ম পার্থক্য যে তাঁদের এই বিচ্ছেদের দিকে ঠেলে আনতে পারে, তা সবকিছুকে অর্থের বিচারে মাপায় অভ্যস্ত পুঁজিবাদী সমাজ ভুলে বসে আছে।

১৯৮৭ সালে প্রথম দেখা হয়েছিল দুজনের। বিলের মাইক্রোসফট সংস্থায় সে বছরই প্রোডাক্ট ম্যানেজার পদে যোগ দিয়েছিলেন মেলিন্ডা। তারপর ৭ বছরের প্রেম শেষে ১৯৯৪ সালে বিয়ে।

এরপর একসঙ্গে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা। সিয়াটলে ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত সেই সংস্থা গত ২১ বছরে বিভিন্ন দেশকে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উন্নত করতে কোটি কোটি ডলার খরচ করেছে। তিন ছেলেমেয়ে জেনিফার, ররি ও ফোয়েবের কাছে তাঁরা আদর্শ মা-বাবা।

‘বেলা শেষে’ ছবির একটি দৃশ্যে স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

গেটস পরিবারের এই ছাড়াছাড়ি কিছুদিন আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মুক্তি পাওয়া ‘বেলা শেষে’ ছবির পটভূমিকে আরও একবার মনে করিয়ে দিয়েছে।

শিবপ্রসাদ মুখার্জি ও নন্দিতা রায় পরিচালিত ছবিতে মিস্টার মজুমদার (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) বিয়ের ৪৯ বছর পার করে এসে সিদ্ধান্ত নেন, তিনি আর তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে (স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত) সংসার করবেন না। তিনি ডিভোর্স চান। এ নিয়ে দুজন আদালত পর্যন্ত যান। এত বছর সংসার করার পর তিনি কেন ডিভোর্স চাইছেন, সেই কৌতূহলই দর্শককে গল্পের পরিণতি দেখার আশায় টেনে রেখেছে।

এই ছবিতে অবশ্য শেষ পর্যন্ত মজুমদার দম্পতির বিচ্ছেদ হয় না। বাঙালি মানস বিচ্ছেদকে সব সময়ই বেদনার অনুষঙ্গ হিসেবে দেখে এসেছে, বিবাহবিচ্ছেদকে ব্যথা ও ব্যর্থতার নিরিখে দেখতেই সে অভ্যস্ত। হয়তো এ কারণেই এই ছবির আনন্দসূচক পরিণতি হিসেবে মজুমদার দম্পতিকে পৃথক করা হয়নি।

কিন্তু বিচ্ছেদ কি সব সময়ই বেদনার? পশ্চিমা সমাজে হয়তো সর্বাংশে তা নয়। কারণ প্রৌঢ়ত্ব বা বার্ধক্যে এসে অনেক দম্পতি সেখানে বিচ্ছেদ চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন। দুই-তিন দশক পরস্পরের সান্নিধ্যে কাটিয়েও সম্পর্ককে তাঁরা আর বহন করতে পারছেন না। বিচ্ছেদ তাঁদের কাছে নিষ্কৃতি।

ফলে বিয়ে এবং বিচ্ছেদ সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণা বদলে যাচ্ছে। এ কারণেই হয়তো ‘বেলা শেষে’র মিস্টার মজুমদার ছেলেমেয়েদের সামনে ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত জানালে তাঁর স্ত্রীর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘এত দিনে মুক্তি।’

এটি হয়তো এ দেশেরও বহু পুরুষের পাশাপাশি বহু নারীরও মনের কথা। অনেক পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের আড়ালে রয়েছে একাকিত্বের আবরণ। কখনো বা নিহিত সত্য আরও করুণ। অবমাননা, উদাসীনতা অগণিত দাম্পত্যকে অসহনীয় করেছে। তাই হয়তো আরোপিত সম্পর্ক নিষ্প্রাণ কর্তব্যের ভার বহন করে প্রৌঢ়ত্বে এসে সার্থকতার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। জীবন মহার্ঘ-দিন ফুরানোর সঙ্গে সঙ্গে এই বোধ তীব্র হতে থাকে।

‘জতুগৃহ’ ছবিতে উত্তম কুমার ও অরুন্ধতি দেবী

বিল ও মেলিন্ডার বিচ্ছেদের মধ্যে যে প্রেম নেই, তা কে বলতে পারে? প্রেম নিয়েই বিচ্ছেদ হতে পারে। ‘ডিভোর্স’ কথাটা যখন বাঙালি সমাজে অতটা পরিচিত হয়ে উঠতে পারেনি, তারও বহু আগে সুবোধ ঘোষের কাহিনি থেকে তপন সিংহ বানিয়েছিলেন ‘জতুগৃহ’ ছবিটি। সেখানে বিল ও মেলিন্ডার মতো স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই সফল মানুষ। সুন্দর মানুষ।

কিন্তু ব্যক্তিত্বের সংঘাত, অন্তরের অতৃপ্তি, ছোটখাটো বিরক্তি তাঁদের দাম্পত্যকে অর্থহীন করে তুলেছিল। তাঁরা বিচ্ছেদে বাধ্য হননি। ভালোবাসা সত্ত্বেও জীবনে ভিন্ন যাত্রাপথ নির্বাচন করেছিলেন। যে সম্পর্কে দমন-পীড়ন নেই, প্রেমের অভাব ঘটেনি, সেখানেও সার্থকতর ও উন্নততর জীবনের আগ্রহ থেকে বিচ্ছেদ একটি সচেতন সিদ্ধান্ত হতে পারে। বিল ও মেলিন্ডা হয়তো সেই উন্নত পৃথক যাত্রাপথের পথিক হয়েছেন।


সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
ই-মেইল: [email protected]