বেস্টসেলার বইয়ের তালিকা যা বলে যায়

বই বিক্রির অনলাইন শপ ‘রকমারি’ গত এক বছরে তাদের সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে, যাকে বলে বেস্টসেলার তালিকা। সেই তালিকা দেখে অনেকেরই চোখ ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে অনেকেই নানা রকম মন্তব্য করছেন। কিন্তু বাস্তবতা সম্ভবত এটাই। এই তালিকা থেকে এটা স্পষ্ট, মননচর্চায় জাতির বিশেষ আগ্রহ আর নেই। কারণ, তালিকায় স্থান পাওয়া বেশির ভাগ বই মানুষের বিভিন্ন কাজে লাগে, এমন প্রকৃতির। অর্থাৎ আত্মউন্নয়ন-বিষয়ক। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বেস্টসেলারের তালিকায় ধর্মীয় বইয়ের প্রাধান্য।

এখন অনেকেই বলতে পারেন, রকমারির এই তালিকা দেশের সামগ্রিক বই বাজারের চিত্র কতটা প্রতিফলিত করে। এটা ঠিক, রকমারির মাধ্যমেই দেশের সব বই বিক্রি হয় না, এর বাইরেও বাজার আছে, কিন্তু এই তালিকা বাজারের প্রকৃত চিত্র প্রতিফলিত করে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। তবে এটা ঠিক, রকমারি বইয়ের শ্রেণিকরণ করেনি—সব বই এক কাতারে রেখেছে।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের বেশ কয়েকটি বড় বইয়ের দোকান ঘুরে জানার চেষ্টা করি, কোন ধরনের বই বেশি বিক্রি হয়। নিজের গরজেই কাজটা করি। ভেবেছিলাম, একটি প্রতিবেদন করব, কিন্তু শেষমেশ আর করা হয়নি। যাহোক, সেখানেও কিন্তু এই চিত্র খুঁজে পাই। শাহবাগের পাঠক সমাবেশ কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, সেখানে এখন বাংলা ও ইংরেজি বইয়ের বিক্রির অনুপাত প্রায় সমান। আর বিক্রীত বইয়ের মধ্যে আত্মউন্নয়ন প্রকৃতির বইয়ের কাটতি সবচেয়ে বেশি।

বাস্তবতা হলো, ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে মানুষের এখন কাজের চাপে দম ফেলবার ফুরসত পাওয়া কঠিন। ফলে তাঁদের হাতে মননচর্চার সময় খুব কম বা নেই বললেই চলে। ফলে এই শ্রেণির মানুষ যত বই কেনেন, তার বেশির ভাগই ক্যারিয়ার উন্নয়নকেন্দ্রিক। এ ছাড়া সামগ্রিকভাবে নিজের কাজে লাগে, এমন কিছুর প্রতি মানুষ আগ্রহী হচ্ছে। নিছক মননচর্চার জন্য বই পড়ার অভ্যাস একরকম হারিয়েই গেছে।

দেশে বিদেশি বইয়ের কাটতি বাড়ছে। বইমেলাকেন্দ্রিক উন্মাদনার মাঝে এটাই এখন সত্য, পাঠকদের বড় একটি অংশ এখন মূলত বিদেশি বই পড়ছেন, যদিও প্রতিবছর শুধু বইমেলায় প্রায় চার হাজার বই বের হচ্ছে। পড়ুয়া মানুষদের একটি শ্রেণির অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি, মধ্যবিত্তের ইংরেজি মাধ্যমে পড়া, মানসম্মত দেশি বইয়ের অভাব—ইংরেজি বইয়ের কাটতি বৃদ্ধির পেছনে এসব মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এই বাস্তবতার নিরিখেও রকমারির এই বেস্টসেলারের তালিকা মিলিয়ে নেওয়া দরকার।

ব্যাপারটা হলো, দেশের নীতিপ্রণেতা, গবেষক ও একাডেমিকদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, তাঁদের সিংহভাগই এখন দেশে প্রকাশিত বাংলা বই পড়েন না। কাজের জন্য তাঁদের বিদেশি বইয়ের দ্বারস্থ হতে হয়। এমনকি তাঁরা সাহিত্যও পড়ছেন ইংরেজি ভাষায় রচিত। কারণ হিসেবে তাঁরা মূলত মানসম্মত বইয়ের অভাবকে দায়ী করেন।

দেশে এখন বই বিক্রির বেশ কিছু ফেসবুক পেজ গড়ে উঠেছে। এরা মূলত ইংরেজি বই বিক্রি করে থাকে। বিদেশি বেস্টসেলার বা বিখ্যাত লেখকদের বই কেনার জন্যই মানুষ এসব পেজে ঢুঁ মারছে, যেসব বই সাধারণত আজিজ সুপার মার্কেটের দোকানে পাওয়া যায় না।

বিদেশি বইয়ের আরেকটি অনানুষ্ঠানিক বাজার হচ্ছে নীলক্ষেত। বিদেশি পাইরেটেড বই সেখানে তো সস্তায় মেলেই, তার সঙ্গে বিগত কয়েক বছরে পিডিএফ বই কম্পিউটার প্রিন্টারে ছাপিয়ে বই আকারে বাঁধাই করার চল শুরু হয়েছে। গাউসুল আজম মার্কেটের নকশী ফটোস্ট্যাটের স্বত্বাধিকারী মো. সোবহানের ভাষ্যমতে, তিনি মাসে অন্তত ৬০-৭০টি বই পিডিএফ থেকে প্রিন্ট করেন। আবার অনেকে মাসে ২০০টি পর্যন্ত বই বিক্রি করে থাকেন। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এসব বইয়ের ক্রেতা। দামি দামি বিদেশি বই এই প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত সস্তায় পাওয়া যায়। শুধু ছাত্র-শিক্ষকেরাই নন, আরও অনেকেই এই প্রক্রিয়ায় বই ছাপিয়ে নিচ্ছেন। মূলত পাঠ্যবই বাংলায় অনুবাদ না হওয়ার কারণে ছাত্র-শিক্ষক-গবেষকেরা এভাবে ইংরেজি বই কিনছেন।

এই যখন অবস্থা, তখন অনেকেই মনে করেন, দেশে পর্যাপ্ত সৃজনশীল উদ্যোগের অভাব আছে। তাঁদের মত, লেখক-প্রকাশকের অভাব নেই, আছে উদ্যোগের অভাব। পাবলিক লাইব্রেরি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের কাজ তো সারা বছর সৃজনশীল চর্চা জারি রাখা। পড়ুয়া সমাজ তৈরিতে এদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করার কথা, কিন্তু বাস্তবে তার বিশেষ কিছু দেখা যায় না। আরেকটি ব্যাপার হলো, বই প্রকাশ বলতে আমরা মূলত সাহিত্যের বই প্রকাশ বলে মনে করি। কিন্তু শুধু সাহিত্য দিয়ে বিশ্বায়ন যুগের পাঠকদের আকৃষ্ট করা কঠিন। সে জন্য অর্থনীতি-সমাজবিজ্ঞান-রাজনীতি ও বিজ্ঞানের বই বাংলা ভাষায় আরও বেশি বেশি প্রকাশিত হওয়া উচিত। দেশের অর্থনীতিবিদদের অনেক ভালো কাজ আছে। কিন্তু সেগুলো মূলত ইংরেজি ভাষায় রচিত। সে কারণে যাঁরা ইংরেজিতে সাবলীল নন, তাঁরা সেগুলো পড়তে পারছেন না।

দেশের বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম পড়ুয়া মানুষেরা যখন ক্যারিয়ার উন্নয়নে জোর দিচ্ছেন, তখন মাদ্রাসার ছাত্ররা বাংলা ভাষায় রচিত বিভিন্ন ধরনের বই পড়ছেন। সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই বলছেন, শুধু ধর্মীয় বই নয়, মাদ্রাসার ছাত্ররা এখন বিভিন্ন ধরনের বই পড়ছেন। এই প্রবণতার আর্থসামাজিক কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, এঁরা জানেন, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য ওয়াজ মাহফিলে বক্তৃতা করা খুবই কার্যকর মাধ্যম। গত কয়েক বছরে ওয়াজ মাহফিল করে অনেকে জনপ্রিয় হয়েছেন, তাঁদের এই সাফল্য অন্যদের অনুপ্রাণিত করছে বলেই ধরে নেওয়া যায়। ফলে বাংলা ভাষাটা ভালোভাবে জানা দরকার, বিভিন্ন বিষয়ে জানাশোনাও বাড়ানো দরকার। অনেক মাদ্রাসাছাত্র লেখালেখিতেও আসছেন।

বোঝা যাচ্ছে, সমাজের যে অংশটি এত দিন বঞ্চিত ছিল, তারা এখন নানাভাবে উঠে আসার চেষ্টা করছে। প্রথাগত মধ্যবিত্তের দৃষ্টির আড়ালেই এটি ঘটছে বলে বোঝা যাচ্ছে। অন্যদিকে মধ্যবিত্তের আরও ওপরে ওঠার প্রয়াসে ইংরেজির পেছনে ছোটা, এই দুই স্রোত আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে, নীতিপ্রণেতাদের তা নিয়ে সুদূরপ্রসারী চিন্তা করার সময় এসেছে বলেই মনে হয়।

প্রতীক বর্ধন সাংবাদিক