ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বেড়ায় অজস্র ফুটো ধরা চোখ

বেড়ার ফুটোয় চোখ রেখে ঘরের ভেতরের কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছেন একজন বয়স্ক নারী—এমন একটা গ্রামীণ জীবনঘনিষ্ঠ ছবি ফেসবুকের নিউজফিডে মাঝে মাঝে আসে। এই কায়দার ছিদ্রান্বেষণকে দক্ষিণ বঙ্গীয় খাস বাংলায় বলে ‘ফুটো ধরা’।শতাব্দীপ্রাচীন এই ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিটি এখন বিলীয়মান। ‘ফুটো ধরে’ জেনে নেওয়া আরেকজনের গোপন খবরে রং চড়িয়ে অসম্ভব দ্রুততায় কান থেকে কানে সম্প্রচার করে দেওয়া এই সব লোকজন আদতে একেকজন লোকাল হুইসেল ব্লোয়ার। ‘সত্যের সন্ধানে নির্ভীক’ এই সব ‘অনুসন্ধানী প্রতিবেদকদের’ এলাকাবাসী ‘বিবিসি’ বলে ডাকে।

যখন পাকা ঘরবাড়ি বা ইটের দেয়াল খুব বেশি ছিল না, সেই টিন, চাটাই বা হোগলার বেড়ার যুগে ফুটো ধরে এই ‘বিবিসি’-দের ‘সংবাদ সংগ্রহ’ করতে বেশি দেখা যেত। সে সময় এই জিনিস এতটাই বিদিত ও স্বীকৃত ছিল যে, এর মধ্যে খুব একটা অন্যায় খোঁজা হতো না। কারণ কোনো ব্যক্তির একান্ত বিষয় বা গোপনীয় কিছু যে থাকতে পারে, সেই চিন্তাকেই পাত্তা দেওয়া হতো না।

সময় বদলেছে। গ্রামগঞ্জে ‘বিবিসি’-দের এখন আগের মতো দেখা যায় না। টিন, বাঁশ বা হোগলার বেড়ার মতো ফুটো ধরাও উঠে যাচ্ছে। কিন্তু ফুটো ধরা উঠলেও তার কনসেপ্ট ঠিকই আছে। শুধু আছে না, সেই কনসেপ্টে নানা মাত্রা যোগ হয়েছে। লোকাল ‘বিবিসিরা’ এখন ক্যামেরা, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের মতো প্রযুক্তির বদৌলতে একটি বিশ্বায়িত চেহারা নিয়ে ফুটো ধরে বসে আছে। সমানে ব্যক্তিগত কথোপকথনের রেকর্ড, একান্ত গোপনীয় ছবি বা ভিডিওচিত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অনুমতি ছাড়াই ইন্টারনেটে ফাঁস হচ্ছে। ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্য পাবলিক প্রোপার্টি হয়ে উঠছে।

সাধারণ মানুষ অন্যের ব্যক্তিগত তথ্য তো প্রকাশ করছেই, টেলিভিশন চ্যানেলগুলো পর্যন্ত সে সব কথোপকথনের রেকর্ড বা ছবি সম্প্রচার করে যাচ্ছে। ‘সংশ্লিষ্ট অডিও টেপ বা ভিডিও টেপ আমাদের হাতে এসেছে’—বলেই সেই টেপ প্রচার করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ‘আমাদের হাতে’ কীভাবে আসল, আর আসল বলেই তা প্রচার করে দেওয়া আইনত ঠিক হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে কারও কোনো মাথা ব্যথা নেই। ব্যক্তির গোপন তথ্য ফাঁস করার বিষয়ে সংবিধানে যে মানা করা আছে তা কেউ গায়ে মাখছেন না। ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য ভরা কনটেন্ট বা আধেয় শেষ পর্যন্ত পাবলিক প্রোপার্টি হয়ে যাচ্ছে। সেই প্রোপার্টি ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব বা অন্য কোনো 'হাটবাজারে' কেনা-বেচা চলছে। লাইক, শেয়ার, কমেন্ট ও ভিউ টাইমের বিপরীতে কনটেন্ট আপলোডারের অ্যাকাউন্টে ডলার যোগ হচ্ছে। আর যার ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়ে যাচ্ছে, তাঁর ক্ষতির কথা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।

সাধারণ মানুষ অন্যের ব্যক্তিগত তথ্য তো প্রকাশ করছেই, টেলিভিশন চ্যানেলগুলো পর্যন্ত সে সব কথোপকথনের রেকর্ড বা ছবি সম্প্রচার করে যাচ্ছে। ‘সংশ্লিষ্ট অডিও টেপ বা ভিডিও টেপ আমাদের হাতে এসেছে’—বলেই সেই টেপ প্রচার করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ‘আমাদের হাতে’ কীভাবে আসল, আর আসল বলেই তা প্রচার করে দেওয়া আইনত ঠিক হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে কারও কোনো মাথা ব্যথা নেই। ব্যক্তির গোপন তথ্য ফাঁস করার বিষয়ে সংবিধানে যে মানা করা আছে তা কেউ গায়ে মাখছেন না।

এই লেখা শুরু করার আগে অন্তত দশ জনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘ভাই, “প্রাইভেসি” কথাটার মানে কী?’ অর্থের মূল ভাবটা মোটামুটি ঠিক রেখে একেক জন একেক রকম জবাব দিচ্ছিলেন। একজন বললেন, ‘ব্যক্তিগত গোপনীয়তা’, একজন বললেন, ‘একান্ত বিষয়’, একজন বললেন, ‘একান্ত নিভৃতি’, একজন বললেন, ‘একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়’, একজন বললেন, ‘ব্যক্তিগত তথ্যে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ’। অর্থাৎ এক শব্দে জবাব না দিয়ে তাঁরা লম্বা কথা খরচা করে ‘প্রাইভেসির’ মানে বোঝাচ্ছিলেন। যখন বললাম, একের বেশি শব্দ ব্যবহার না করে আক্ষরিক প্রতিশব্দ বলুন; “ইনফরমেশন” মানে যেমন “তথ্য”, ঠিক তেমনি এক কথায় বলতে হবে, “প্রাইভেসি” মানে কী? এবার দেখা গেল, সবাই মাথা চুলকাচ্ছেন। ‘প্রাইভেসির’ মোক্ষম বাংলা শব্দ মিলছে না। ‘নিভৃতি’ কিছুটা কাছাকাছি গেলেও ‘প্রাইভেসি’র লাগসই শাব্দিক দ্যোতনা তাতে পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া যাচ্ছে না, কারণ ‘প্রাইভেসি’ যে মানুষের রোজকার জীবনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা আমাদের সমাজ এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। আর তা পারেনি বলেই যখন-তখন মোবাইল ফোনে অমুক কোম্পানির তমুক অফার আসছে; তমুক কোম্পানির অমুক পণ্য কিনলে অমুক পণ্য ফ্রির বিজ্ঞাপনী এসএমএস আসছে।
মাঝে মাঝে তুমুল ব্যস্ত সময়ে মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। ধরলে অপর প্রান্ত থেকে অমুক ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের গগণবিস্তারি সুবিধার লিস্ট পড়ে শোনানো হয়।

ব্যক্তিগত ফোন নম্বর ওইসব কোম্পানির কাছে কারা দিল, এটি যে একজন মানুষের ব্যক্তিগত নিভৃতির অধিকারের লঙ্ঘন— এসব নিয়ে কারও মনে প্রশ্ন আসে না। টেলিফোন নম্বরের মতো ব্যক্তিগত তথ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া যে কাউকে দেওয়া যায় না, ইচ্ছে হলেই কাউকে যখন খুশি ফোন করে বা এসএমএস দিয়ে পণ্যের বিজ্ঞাপন যে দেওয়া যায় না, তা বোঝার মতো জনমানস এখনও তৈরি হয়নি।

এই রকমের একটা বাস্তবতার মধ্য দিয়ে আজ ২৮ জানুয়ারি দেশে আন্তর্জাতিক তথ্য সুরক্ষা দিবস পালন করা হচ্ছে। ব্যক্তির নিভৃতি বা গোপনীয়তার মূল্য কত হতে পারে তা গত বছর বিশ্বের সবচেয়ে দাপটশালী বিপণন প্রতিষ্ঠান আমাজনকে ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার করায় ৮৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার জরিমানা করার পর বোঝা গেছে। গ্রাহকদের গোপনীয় তথ্যের অপব্যবহার করায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের তথ্য সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ ‘সিএনপিডি’ আমাজনকে ওই জরিমানা করেছিল।

বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো তাদের ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে যে, তারা ভোক্তাদের তথ্য শুধুমাত্র পরিষেবা আরও উন্নত করার জন্য ব্যবহার করবে এবং অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সেই তথ্য ব্যবহার থেকে তারা স্বেচ্ছায় বিরত থাকবে। কিন্তু আমাজন ও ফেসবুকের মতো সংস্থাও ব্যক্তিগত তথ্য তৃতীয় কোনো পক্ষের কাছে বিক্রি করে থাকে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের তথ্য বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করে ‘ক্যামব্রিজ-অ্যানালিটিকা’ নামের একটি সংস্থা আমেরিকার নির্বাচনে প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থন বাড়ানোর চেষ্টা করেছিল।

অতি উদ্বেগের কথা, বাংলাদেশের কোনো আইনে নাগরিকের তথ্য সুরক্ষার বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ব্যক্তি কোন তথ্যটি দেবেন, বা ব্যক্তির কাছে কতটা তথ্য চাওয়া যায়, সেই বোধই আমাদের তৈরি হয়নি। ফলে ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা হুমকিতে আছে।

ডিজিটাল যুগে বিভিন্ন জায়গায় তথ্য চাওয়া হয়। কিন্তু সে সব তথ্য সুরক্ষিত থাকবে কিনা, তা নিশ্চিত করে জানানো হয় না। যে কোনও জায়গায় জাতীয় পরিচয়পত্র, মেডিকেল রিপোর্ট চাওয়া হয়। ভাড়াটিয়া তথ্য ফরমের নামে যাবতীয় তথ্য নেওয়া হয়। কিন্তু ব্যক্তির সেই তথ্য কীভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে তার জবাব নেই।

আমাদের সংবিধানের ৪৩ (খ) অনুচ্ছেদে প্রাইভেসি রাইটস বা ব্যক্তির তথ্য সুরক্ষা ও গোপনীয়তা মৌলিক মানবাধিকার বলে স্বীকৃত। অনুমতি ছাড়া কারও ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে নানা আন্তর্জাতিক সনদে উল্লেখ আছে। কিন্তু কাজীর গরুর মতো তা গোয়ালে না থেকে কেতাবে জাবর কেটে যাচ্ছে। জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, মেডিকেল রিপোর্ট, ফোন নম্বর, রক্তের গ্রুপ—এসব কিছুই ব্যক্তিগত তথ্য। এই সব তথ্যের রক্ষণাবেক্ষণে কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। এই সব তথ্য সুরক্ষায় আমাদের যে বেড়া আছে, তাতে অগণিত ফুটো আছে। সেই ফুটোর বাইরে অগণিত ‘বিবিসি’ চোখ পেতে বসে আছে। সে কারণে ফুটোগুলো বন্ধ করুন।

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক [email protected]