ব্যবসা থেকে বেরোনোর পথ লাগবে

বাংলাদেশে যদিও ঋণ নিতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়, তবে ভালো একটি ব্যবসা হলে এবং ব্যাংক ব্যবস্থাপক বা কর্মকর্তাকে ব্যবসার ভবিষ্যৎ বোঝাতে পারলে আপনি আগে হোক কিংবা পরে হোক ঋণ পাবেন। আর যদি ব্যাংক ব্যবস্থাপক বা পরিচালক পর্যায়ে বন্ধুত্বমূলক পরিচিতি থাকে, তাহলে অনেক তাড়াতাড়িও ঋণ পেয়ে যেতে পারেন। কিন্তু আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরের কারণে কিংবা যাকে আমরা বলি ‘অ্যাক্ট অব গড’-এর কারণে যদি আপনার ঋণ মন্দ হয়ে যায়, ব্যবসায় যেকোনো কারণে যদি আপনি পিছিয়ে পড়েন, অন্য বেশির ভাগ দেশের মতো আমাদের দেশে কিন্তু আপনাকে দেউলিয়া ঘোষণা করে ব্যবসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ কেউ করে দেবে না। যুক্তরাষ্ট্রের মতো চ্যাপটার ১১, চ্যাপটার ৭ বা ১৩-এর কথা এখানে আপনি শুনবেন না। আপনার মন্দ ঋণ নিয়ে ব্যাংক ভুগবে, আপনি ভুগবেন, এমনকি ভুগবে আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। বৈশ্বিক বা স্থানীয় পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, আপনি দায়মুক্তি পাবেন না বা ব্যবসা থেকে বেরোতে পারবেন না।
দেশে খেলাপি ঋণ ঊর্ধ্বমুখী। খেলাপি সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বিস্তার লাভ করেছে অনেক বেশি। শুধু ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি নয়, অনেক বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানও আজকাল ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে অনীহ। কেউ কেউ হয়তো বৈশ্বিক বা স্থানীয় ব্যবসায়িক পরিবেশের কারণে ঋণ ফেরত দিতেও পারছেন না। আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণের রাশ টানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্টরা, এমনকি ব্যবসায়ী নেতারাও দেউলিয়া আইনের প্রয়োগ চাইছেন। কিন্তু বিদ্যমান আইনে রয়েছে কিছু সীমাবদ্ধতা। এ আইনে শুধু ব্যক্তি বা ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের দেউলিয়া ঘোষণার বিধান থাকলেও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের দেউলিয়া ঘোষণার বিধান নেই। ফলে, করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছে আটকে থাকা ঋণ আদায় করা যাচ্ছে না।

উল্লেখ্য, অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে কোম্পানির কাঠামোয় পরিবর্তন আসায় প্রাধান্য বাড়ছে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান-কোম্পানির চেয়ে করপোরেট ধরনের বড় বড় কোম্পানির। এসব প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে অসমর্থ হলেও পাওনাদারের দায় মেটানোর এখতিয়ার বর্তমান আইনে অনুপস্থিত। এ জন্য দেউলিয়া আইন সংশোধন করে ‘করপোরেট দেউলিয়াত্ব’ নামে নতুন একটা অনুচ্ছেদ সংযোজনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে যেসব করপোরেট প্রতিষ্ঠান অনেকটা ইচ্ছা করেই ঋণ পরিশোধ করছে না, পাওনাদারের দায় মেটাচ্ছে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে। নিঃসন্দেহে এটি একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে বিধানটি দ্রুত সংযোজন এবং এর কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করা করা গেলে করপোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এটি বড় ভূমিকা রাখবে বৈকি।
তবে এটাও লক্ষণীয়, আর্থিক অবস্থা খারাপ হলে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের একেবারেই যবনিকা ঘটে। আর্থিকভাবে বিপর্যয়ে পড়ে সেসব প্রতিষ্ঠানকে একেবারে বন্ধ না করে পুনরায় চালু করার বিধান বিভিন্ন দেশে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। দেশটিতে কোনো প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার আগে পাওনাদারদের সঙ্গে ঋণ পরিশোধের বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি বা ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ নিতে পারে। এ সুবিধা নিয়ে আদালতের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যবসায়ে ফিরিয়ে আনার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। আদালত প্রদত্ত সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটিকে পুনর্গঠন করতে না পারলে তারা দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার জন্য পুনরায় আদালতে আবেদন করতে পারে।

বিদ্যমান দেউলিয়া আইন অনুযায়ী দেউলিয়া ব্যক্তি নির্বাচনে অযোগ্য হওয়াসহ কিছু নাগরিক অধিকার হারান। কিন্তু দেউলিয়া আদালতে ব্যাংকগুলো কয়েক হাজার মামলা করলেও এর নিষ্পত্তি হচ্ছে না। কাউকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হচ্ছে না। এতে আইনের কার্যকারিতা বা সুফল প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

এ ধরনের আইনগত সুবিধা নিয়ে দেশটিতে মন্দাকালে বিপর্যস্ত বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের ঘুরে দাঁড়ানোর নজির আছে। এটি প্রাতিষ্ঠানিক স্থায়িত্ব এবং কর্মসংস্থান উভয় দিক থেকেই ফলদায়ক বিবেচিত। প্রতিষ্ঠান ভাঙা সহজ, কিন্তু গড়া কঠিন। যেকোনো প্রতিষ্ঠানের প্রস্থানের জন্য একটি মধ্যবর্তী আইনগত পরিসর থাকলে সেটি কাজে লাগিয়ে পরবর্তী সময়ে ভালো কিছু করা সম্ভব। সুতরাং সংগত কারণেই দীর্ঘদিন ধরে দেউলিয়া আইনে এ ধরনের একটি বিধান সংযোজনের কথাও বলছেন অনেকে। সংশোধিত আইনে এই বিধানও সংযুক্ত করার খবর মিলছে। ফলে কয়েকজন পাওনাদার একসঙ্গে হয়ে অবসায়িত প্রতিষ্ঠানটি পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নিতে পারবেন। প্রতিষ্ঠান বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক ও সুরক্ষা কবচ হতে পারে। অধুনা এ ধরনের আইনি বিধান বা কাঠামো অনেক ক্ষতিগ্রস্ত বা ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন দেশে আবার ব্যবসায় ফিরে আসতে সুযোগ করে দিয়েছে।

বিদ্যমান দেউলিয়া আইন অনুযায়ী দেউলিয়া ব্যক্তি নির্বাচনে অযোগ্য হওয়াসহ কিছু নাগরিক অধিকার হারান। কিন্তু দেউলিয়া আদালতে ব্যাংকগুলো কয়েক হাজার মামলা করলেও এর নিষ্পত্তি হচ্ছে না। কাউকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হচ্ছে না। এতে আইনের কার্যকারিতা বা সুফল প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। নতুন সংশোধনীতে দেউলিয়া আইনের ৯৪ ধারা সংশোধনেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুন আইনে দেউলিয়া ঘোষিত ব্যক্তির পাসপোর্ট জব্দকরণ বা বাতিল করা হবে, বিদেশভ্রমণে নিষেধাজ্ঞাসহ রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেওয়া হবে না। কোম্পানির পরিচালক কিংবা ক্লাবের সদস্যপদ গ্রহণ এবং গাড়ি কেনায়ও অযোগ্য ঘোষণা করা হবে। এ ছাড়া একাধিক ব্যাংক হিসাব পরিচালনার ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে। সুতরাং বলা যায়, শাস্তির বিধান আরও সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট হচ্ছে। এতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কঠোর সংকেত প্রদান এবং খেলাপি ঋণ হ্রাস করা অনেকটা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ইতিমধ্যে বিশ্ব অনেক দূর এগোলেও বাংলাদেশে এখনো পুরোনো দেউলিয়া আইনের সংশোধন না হওয়ায় এটি যুগোপযোগিতা হারিয়েছে। ফলে, এর দুর্বলতাগুলোও জোরালোভাবে উঠে এসেছে। যুগের চাহিদা মেটাতে অনেক দেশই পরিবর্তিত বাস্তবতায় দেউলিয়া আইনে এরই মধ্যে পরিবর্তন এনেছে। এ প্রেক্ষাপটে অন্যান্য দেশের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে আমাদেরও এ আইন সংশোধন করতে হবে। এদিকে বিশ্বব্যাংকের ব্যবসার পরিবেশ সহজীকরণে বিবেচ্য একটি সূচক হলো দেউলিয়া নিষ্পত্তি। আইনটি যুগোপযোগী করা হলে ব্যবসার পরিবেশ সহজীকরণ সূচকে আমাদের অবস্থান আগের চেয়ে উন্নতিরও আশা করছেন সংশ্লিষ্ট অংশীজন।
দুর্বল দেউলিয়া আদালত ও মামলা নিষ্পত্তিতে কোনো সময়সীমা নির্ধারণ না থাকার পাশাপাশি অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কারণে দেউলিয়া আইনটি এখনো কার্যকর করা যায়নি। এ অবস্থায় ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে পাওনাদারদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে দেউলিয়া আদালতে শরণাপন্ন হওয়ার সুযোগ অর্থঋণ আদালত আইনে রাখতে যাচ্ছে সরকার। অর্থঋণ আদালতের চূড়ান্ত রায়ের ৯০ দিনের মধ্যে ঋণগ্রহীতাকে অর্থ পরিশোধ করতে হয়। কোনো ঋণগ্রহীতা তা না করলে ওই রায় দেউলিয়া আদালতে পাঠাবেন অর্থঋণ আদালত। তার পরিপ্রেক্ষিতে দেউলিয়া আদালত ঋণগ্রহীতাকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে পারবেন। এ জন্য অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ সংশোধনের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দুটি আইনের সমন্বয় নিশ্চিত করা গেলে প্রয়োগজনিত দুর্বলতা ও জটিলতা অনেকখানিই অবসান হবে।
বিভিন্ন দেশের আইন পর্যালোচনা করে এবং অংশীজনদের মতামত নিয়ে একটি যুগোপযোগী দেউলিয়া আইন প্রণয়ন করা অতীব জরুরি। যুক্তরাজ্য, বিশেষভাবে পার্শ্ববর্তী ভারতে এই আইন (ব্যবসা পুনর্গঠন নির্দেশনা) যুগোপযোগী করার ফলে সুফল মিলছে। জানামতে, আমাদের প্রাগ্রসর ব্যবসায়ী মহলের বেশ কয়েকজন এটি নিয়ে সরকার ও আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন। যত দ্রুত এটি প্রণয়ন করা হবে, আমাদের জন্য ততই মঙ্গল। আইনানুযায়ী ব্যাংকের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নতুনভাবে পুনর্গঠিত বা স্বীকৃত দায় নিষ্পন্ন করে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার অধিকার ব্যবসায়ীর ন্যায়সংগত দাবির মধ্যে পড়ে।

মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক।