ব্যাংকঋণের ছদ্ম ব্যয় ও আমানতকারীদের দুর্ভোগ

বাণিজ্যিক ব্যাংকের মুনাফার প্রধানতম খাত হওয়ার কথা নিট সুদ আয় বা স্প্রেড। এটি ব্যাংকের মোট সুদ আয় এবং মোট সুদ ব্যয়ের পার্থক্য। বাণিজ্যিক ব্যাংক আরও নানাবিধ উৎস থেকে মুনাফা করতে পারে, যেমন: বিভিন্ন চার্জ, ফি, কমিশন ইত্যাদি। মুনাফার প্রধানতম খাত নিট সুদ আয় ধার্য এবং তা অর্জনের ক্ষেত্রে ব্যাংক ব্যবস্থাপকেরা সতর্ক থাকেন। ব্যাংক ব্যবস্থাপনার মূলনীতিতে তাই যেকোনো অবস্থাতেই ব্যাংকের নিট সুদ আয় বা স্প্রেড যাতে অক্ষুণ্ন থাকে, তা আলোচিত হয়।
ব্যাংক অন্যান্য ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে উচ্চ সুদে ঋণদান করতে পারলে তাদের নিট সুদ আয় বেড়ে যাবে। নিট সুদ আয় বৃদ্ধিকে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার অন্যতম সফলতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ঋণ প্রদানের সময় ঋণগ্রহীতার ঋণের উদ্দেশ্য, বিবেচ্য কাগজপত্র পরীক্ষণ করে ঋণের পরিমাণ, মেয়াদকাল এবং প্রযোজ্য সুদের হার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। সাধারণ ঋণগ্রহীতারা এত কিছু জিজ্ঞাস্যে না গিয়ে ঋণের কিস্তি কত হবে, তা শুনতে চান। সাধারণত, মাসিক কিস্তি কত হবে এবং তা মাসের কত তারিখে প্রদেয়, এসব তথ্য নিয়ে ঋণগ্রহীতা ব্যাংক থেকে বিদায় হন।

ঋণ গ্রহণকালে সংশ্লিষ্ট অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ঋণগ্রহীতা সেভাবে হয়তো খেয়াল করেন না। যেমন ব্যাংক থেকে যে সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে, তা সরল সুদ (যে ক্ষেত্রে শুধু মূল ঋণের ওপর সুদ ধরা হয়), না চক্রবৃদ্ধি হার সুদ (যে ক্ষেত্রে আসলের ওপর সুদ এবং সুদের ওপরও সুদ ধরা হয়), গৃহীত ঋণ প্রক্রিয়াকরণ চার্জ, হিসাব খোলা এবং তা সচল রাখার জন্য বার্ষিক খরচ, সরকারি শুল্ক, কর ইত্যাদি। অনেক সময় ঋণগ্রহীতা মেয়াদ পূর্তির আগেই ঋণ পরিশোধ করতে চাইলে ব্যাংক কর্তৃক ধার্যকৃত পেনাল্টি ও অন্যান্য খরচের কথা ঋণ গ্রহণকালে অনেক ঋণগ্রহীতাই বিবেচনায় নেন না। সে ক্ষেত্রে ঋণ গ্রহণ কালে গ্রহীতার ঋণের প্রয়োজনীয়তার মাত্রা বিবেচ্য। খুব বেশি প্রয়োজন হলে ঋণগ্রহীতা এসব তথ্য-উপাত্ত খুব বেশি বিবেচনা করেন না। আবার অর্থায়নসংশ্লিষ্ট জ্ঞান বা ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসির অভাবে অনেক ঋণগ্রহীতা শুধু ঋণের কিস্তির হিসাব করেই ঋণ গ্রহণ করেন। এসব বিবেচনায় গৃহীত ঋণের নামিক সুদ (নমিনাল ইন্টারেস্ট) ও প্রকৃত সুদ (রিয়াল ইন্টারেস্ট) হারে পার্থক্য দেখা দেয়। ঋণ মেয়াদান্তে বা মেয়াদপূর্বে পরিশোধের ক্ষেত্রে ব্যাংক ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে অনেক সময় ভুল-বোঝাবুঝি ও অসন্তুষ্টি দেখা দেয়। বাস্তবিক কিছু নিদর্শন আলোচনা করা যেতে পারে।

যেমন ইউনুস মিয়া (ছদ্মনাম) একজন উঠতি খামারি। প্রচণ্ড পরিশ্রমী ইউনুস তাঁর খামারের প্রয়োজনে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ২০ লাখ টাকার ঋণ গ্রহণ করেন। পাঁচ বছর মেয়াদি সেই ঋণে সুদহার বলা হয়েছিল ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। মাসিক কিস্তি ধরা হয় ৪২ হাজার ৯০০ টাকা। পরে সরকারঘোষিত সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ করা হলে তাঁর ঋণের কিস্তি কমে প্রায় ৪২ হাজার টাকায় দাঁড়ায়। করোনা মহামারি সময় সরকারঘোষিত বিভিন্ন প্যাকেজের আওতায় অন্য অনেকের মতো ইউনুসও বিলম্বে ঋণ পরিশোধের সুবিধা গ্রহণ করেন। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে তিনি আবার ঋণের কিস্তি দেওয়া শুরু করেন। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত তিনি ২৮ কিস্তি ঋণ পরিশোধ করেছেন।

করোনার সময়ে ইউনুস মিয়ার ভাষ্যমতে ব্যবসার অনেক খরচ কমে যায়। অনলাইনে প্রচুর চাহিদা মিটিয়ে তাঁর হাতে বেশ নগদ টাকা জমা হয়। করোনার সময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করার সুবিধা এবং ভালো ব্যবসা করার কারণে এখন তিনি ঋণ পুরোপুরি পরিশোধ করতে চান। তাঁর মতে, মাসিক কিস্তি দেওয়া থেকে একবারে ঋণ পরিশোধ করলে ব্যবসায় আরও বেশি মনোযোগী হওয়া যাবে। জমানো টাকা অন্য কোথাও খাটানোর সুযোগ না থাকায় তিনি ব্যাংকঋণ পরিশোধের উদ্যোগ নেন। ইউনুস মিয়া ব্যাংকে হাজির হয়ে তাঁর সংকল্পের কথা জানান। ব্যাংক ব্যবস্থাপক হিসাব করে বলেন, এ মুহূর্তে একবারে ঋণ পরিশোধ করলে ইউনুস মিয়াকে সর্বমোট ১৩ লাখ ১০ হাজার টাকা দিতে হবে। ব্যাংক ব্যবস্থাপক তাঁকে এও জানান, পূর্ণ মেয়াদে কিস্তিতে পরিশোধ করলে সর্বমোট পরিশোধ করতে হবে প্রায় ১৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা।

সরল ব্যবসায়ী ইউনুস সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না তিনি কী করবেন। মেয়াদ পূর্তির প্রায় আড়াই বছর আগে এককালীন পরিশোধে মোট প্রদেয় ১৩ লাখ ১০ হাজার টাকা আর মাসে মাসে কিস্তিতে ঋণ পরিশোধে মোট প্রদেয় প্রায় ১৩ লাখ ৩০ হাজার টাকার মধ্যে কোন বিকল্পটি তাঁর জন্য সুবিধার হবে, ইউনুস মিয়া তা নিয়ে ভাবছেন। সত্যি বলতে, ইউনুস মিয়াদের মতো এ রকম সরল ও সৎ উদ্যোক্তারা ব্যাংক হিসাবের এত মারপ্যাঁচ বোঝেন না। প্রকৃত হিসাবে ইউনুস মিয়ার ঋণে প্রকাশ্য ব্যয়ের সঙ্গে অনেক ছদ্ম ব্যয় রয়েছে। ঋণ গ্রহণকালে ব্যাংক শতকরা ২ ভাগ প্রক্রিয়াকরণ চার্জ কেটে রাখে। সঙ্গে হিসাব খোলার জন্য প্রথমেই তাঁকে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা জমা দিতে হয়। বার্ষিক হিসাব পরিচালনা খরচ খাতে ব্যাংক তাঁর কাছ থেকে প্রতিবছর তিন হাজার টাকা কেটে নেয়। হিসাববিবরণীর জন্য নেয় আলাদা টাকা। উল্লেখ্য, ব্যাংক ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম কিস্তি নেয়, কিন্তু ইউনুস মিয়ার ঋণ মঞ্জুর হয়েছিল সেই মাসেরই শেষের দিকে। সেদিক থেকে ইউনুস মিয়া পুরো পাঁচ বছর ঋণ মেয়াদ পাননি।

দেখা যায়, ইউনুস মিয়া প্রায় ১৯ লাখ ২৫ হাজার টাকার মতো ঋণ উত্তোলনের সুযোগ পেয়েছিলেন। অর্থায়নের সূত্র প্রয়োগ করে দেখা যায়, বর্তমানে ঋণ পরিশোধ করলে ইউনুস মিয়ার ঋণে প্রকৃত সুদের হার দাঁড়ায় প্রায় ৯ দশমিক ৮ শতাংশ, যা নামিক বা নমিনাল সুদের হারের চেয়ে যথেষ্ট বেশি। এর প্রধান কারণ ব্যাংকের মাত্রাতিরিক্ত ছদ্ম ব্যয়।

মেয়াদি আমানতের ক্ষেত্রে ব্যাংকের নীতি ও আচরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। মেয়াদ পূর্তির আগেই ঋণ পরিশোধে ব্যাংকের আচরণ যেভাবে ব্যাংকের সুবিধা নিশ্চিত করে, মেয়াদ পূর্তির আগে মেয়াদি আমানত উত্তোলনের ক্ষেত্রে আমানতকারীর স্বার্থ প্রকৃতই ক্ষুণ্ন হয়। উদাহরণস্বরূপ শামিমার (ছদ্মনাম) কথাই ধরা যাক। শামিমা গড়পড়তা বেতনে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। পাশাপাশি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ করছেন। ছোট বোনের পড়াশোনা ও অসুস্থ বাবার চিকিৎসার খরচ শামিমাকেই দেখতে হয়। ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কথা ভেবে তিনি প্রতি মাসে বেতনের একটি অংশ সঞ্চয়ের সিদ্ধান্ত নেন। সুধীজনের পরামর্শে একটি বেসরকারি ব্যাংকে মাসে ১০ হাজার টাকা জমা শর্তে মেয়াদি আমানত (ফিক্সড ডিপোজিট) খোলেন।

এ দেশে করোনা শুরুর কিছু আগে শামিমার বাবার অসুখ বেড়ে যায়। ডাক্তারের পরামর্শে শামিমা তাঁর বাবাকে ভারতের কলকাতায় নিয়ে যেতে চান। মোটা অঙ্কের টাকা দরকার হয়। সাতপাঁচ ভেবে তিনি মেয়াদি আমানত ভেঙে টাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নেন। শামিমা আশা করেছিলেন যে মেয়াদের প্রায় অর্ধেক সময় পার হয়েছে বিধায় ভবিষ্যৎ মূল্যের অর্ধেক না পেলেও কাছাকাছি পরিমাণ অর্থ তিনি পাবেন। আশা নিয়ে ব্যাংকে হাজির হলেন। ব্যাংক থেকে জানানো হলো যে টাকা উত্তোলন করতে পারবেন, কিন্তু সুদ পাবেন না। এমনকি বিভিন্ন কর ও চার্জ কর্তন করে জমাকৃত আসল থেকেও কিছু টাকা কাটা যাবে। নিরুপায় শামিমা সে শর্তেই রাজি হয়ে ডিপোজিট ভেঙে ফেলেন। টাকা হাতে ভাবতে থাকেন, অন্তত যে সময়ের জন্য তাঁর আমানত খাটানো হয়েছিল, তার ওপর অল্প কিছু হলেও সুদ পেতে পারতেন কি না!

ওপরের বর্ণিত বাস্তবিক উদাহরণ থেকে দেখা যায়, আমানতকারী থেকে শুরু করে গ্রাহক পর্যায়ে অনেকেই ব্যাংকের আমানত ও ঋণনীতির দ্বারা নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত ভাবেন। ব্যাংক অবশ্যই একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান। টিকে থাকার প্রয়োজনে ব্যাংকের মুনাফা করতেই হয়। ব্যাংকের মুনাফার ভিত্তি কিন্তু এসব আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতাই। ওপরে উল্লেখিত উদাহরণের যুক্তি খণ্ডাতে ব্যাংক হয়তো তাদের বাঁধাধরা নিয়মের কথাই বলবে। কিন্তু বোঝা উচিত বাঁধাধরা নিয়ম সেগুলো ব্যাংকেরই সৃষ্টি।

আবার এসবের ব্যত্যয়ও লক্ষণীয়। কোনো ঋণগ্রহীতা যখন দেউলিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়েন বা ঋণ পরিশোধে অক্ষম হন, তখন সেই ঋণ আদায়ে ব্যাংক অনেক খরচ করে, আদালতে মামলা করে। ঋণগ্রহীতা ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচিত হলে তাঁর ঋণ শ্রেণীকরণ করে, অনেক সময় ব্যাংক মক্কেলকে নীতি-পরামর্শ দিয়ে উপকারও করে থাকে। এসব ক্ষেত্রে ব্যাংক যে ব্যয় করে, সেগুলো ব্যাংকের স্বার্থ বলেই বিবেচিত হয়। প্রশ্ন হলো, একজন ঝুঁকিপূর্ণ ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে ঋণ আদায়ে ব্যাংক নানামুখী খরচ করে থাকে অথচ যাঁরা সৎ সাহসী ঋণগ্রহীতা, যাঁরা মেয়াদ পূর্তির আগেই সুদে-আসলে পূর্ণ ঋণ পরিশোধ করতে চান, তাঁদের ক্ষেত্রে ব্যাংক কি এতটুকু নমনীয় হতে পারে না?

প্রকৃত অর্থে ব্যাংকের উচিত ইউনুস মিয়াদের মতো সৎ ব্যবসায়ীদের উৎসাহ দেওয়া, পারলে পুরস্কৃত করা। সেসব না করে উল্টো নিয়মনীতির বেড়াজাল দেখিয়ে এসব আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের চার্জ, ফি ইত্যাদি ছদ্ম খরচ আদায় করা কতটুকু যুক্তিসংগত, তা সংশ্লিষ্ট মহলের ভেবে দেখা উচিত।


ড. শহীদুল জাহীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষক।