ব্যাংকসুদ হারের নয়–ছয় নীতি


কিছুদিন আগে প্রথম আলো পত্রিকায় একটি লেখাতে লিখেছিলাম, রাজনৈতিক দর্শন যখন অকার্যকর হয়, অর্থনৈতিক দর্শন তার পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে পারে। আজ আমি এর একটি ব্যাখ্যা দিতে চাই। আমাদের দেশের রাজনৈতিক ভঙ্গুরতার শুরু বঙ্গবন্ধুর হত্যার সময় থেকে। রাজনৈতিক দর্শন যে মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক কল্যাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তা ভূলুণ্ঠিত সেদিন থেকেই, অপরাজনৈতিক শক্তি প্রবল পরাক্রমে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রকেই কলুষিত করেছে। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাও তার ব্যতিক্রম নয়।

বিগত কয়েক বছরে ব্যাংকিং খাত থেকে যে পরিমাণ টাকা বেহাত হয়েছে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। বছরের পর বছর ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের নিয়োগ এবং তাঁদের যথেচ্ছ রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়োগ ব্যাংকগুলোকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে। সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত সঞ্চয় একান্ত নিজের মনে করে ব্যাংকের মালিকগোষ্ঠী তাদের ইচ্ছেমতো তা লুট করে যাচ্ছে। সাধারণত এই সীমাহীন ব্যর্থতার ভার সরকারের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে আমরা নৈতিকভাবে ভারমুক্ত হতে চাই। কিন্তু সরকারের সংগত সীমাবদ্ধতার কথাও আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন।

সরকার গঠন হয় নির্বাচনে বিজয়ী রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে আর নির্বাচনে জয়লাভ অনেকাংশে নির্ভর করে রাজনৈতিক কর্মীদের কর্মতৎপরতার ওপর। একটি রাজনৈতিক দল যখন সরকার গঠন করে, তখন সরকারের ভেতরে বা বাইরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজ দলের লোক নিয়োগ করে, যা রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত কাজ নয়। বিশ্বের সব দেশেই এর নজির রয়েছে। তাই রাজনৈতিক প্রয়োজনে সরকারের এমন নিয়োগ নিয়ে বাড়তি আলোচনা মূল্যবান সময়ের অপচয়। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, রাজনৈতিক অপদর্শনের শিকার ওই সব নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ যখন তাঁদের ক্ষমতার অ-সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় বা ব্যাংকের কোষাগার নিঃশেষ করে দিচ্ছেন, তখন সরকারের অসহায়ত্বের সীমা থাকে না। কিন্তু এই ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারপ্রধানের কিছু কিছু অর্থনৈতিক কৌশল প্রশংসার দাবি রাখে।

অল্প কিছুদিন হলো বর্তমান সরকার ব্যাংকিং খাতে সুদের হার বেঁধে দিয়েছে। ব্যাংকিং খাতের সঞ্চয়ী হিসাবগুলোর সুদের হার সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ ও ঋণের সুদের হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ করা হয়েছে। এ ব্যবস্থা ব্যাংকিং খাতে জড়িত ব্যক্তিবর্গের মাঝে নৈরাশ্য সৃষ্টি করেছে। ব্যাংকিং খাতের সুদের হার বিভিন্ন সরকারি সঞ্চয়পত্রের সুদের হারের চেয়ে কম হওয়ার কারণে সাধারণ জনগণ ব্যাংকে টাকা না রেখে সরকারি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন। সাধারণ অর্থনৈতিক নীতি অনুযায়ী এ ব্যবস্থা অবশ্যই কাম্য নয়। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, অর্থনৈতিক নীতি সাধারণত অনুমাননির্ভর হয়ে থাকে এবং এই অনুমানের ব্যত্যয় ঘটলে অর্থনৈতিক নীতি অনেক ক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে পড়ে।

জনগণ সঞ্চয়পত্রে টাকা বিনিয়োগ করে অধিক নিরাপদ বোধ করছেন, কারণ এর ফলে তাঁরা ব্যাংকগুলোর মালিক শ্রেণির স্বেচ্ছাচার থেকে দূরে থাকতে পারছেন। স্বল্প আয়ের মধ্যবিত্ত শ্রেণি এর ফলে একধরনের সামাজিক নিরাপত্তা উপভোগ করছে।

সরকারি সঞ্চয়পত্রের সুদ ব্যাংকিং খাতের সুদের চেয়ে কম রাখা হয় ব্যক্তি পর্যায়ে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য। কিন্তু আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের সীমাহীন অনৈতিক কার্যক্রম ও এর সঙ্গে অপরাজনৈতিক যোগাযোগ সাধারণ অর্থনৈতিক নীতির প্রয়োগের সুযোগ কমিয়ে দিয়েছে। অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণ বা প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমরা এখনো নব্য শাস্ত্রীয় (নিয়ো-ক্ল্যাসিক্যাল) অর্থনীতিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আচরণমূলক অর্থনৈতিক তত্ত্ব (বিহেভিওরাল ইকোনমিকস) বা প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব (ইনস্টিটিউশনাল ইকোনমিকস) আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে। অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে জনগণের সমন্বিত আচার–আচরণ বা দেশের প্রাতিষ্ঠানিক পরিস্থিতির বিবেচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এ কথা অনস্বীকার্য, সমন্বিত অর্থে আমাদের সংস্কৃতিতে এখনো দ্বান্দ্বিকতার প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। এই দ্বান্দ্বিক মনোভাবের বিস্তৃতি রোধে যে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা প্রয়োজন, তা আমাদের নেই। ফলে বাজারব্যবস্থা এখনো প্রতিযোগিতামূলক নয়। এতে ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতার ওপর ভিত্তি করে মূলধনের বণ্টন সম্ভব হয়ে উঠছে না। উপরন্তু, ব্যক্তিপর্যায়ের স্বেচ্ছাচারিতা ও যেকোনো বিপদে রাজনৈতিক সহযোগিতা ব্যাংকগুলোতে রাখা আমানতকে অতিমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ করে ফেলছে। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে পরিবর্তিত নীতির প্রয়োগই বেশি কার্যকর হবে। বর্তমান সরকারের ৬–৯ ব্যাংক সুদের নীতি এরই ধারাবাহিকতা বলে আমি মনে করি এবং এটিকে আমি ‘রাজনৈতিক অর্থনীতির’ একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে গণ্য করি।

বঙ্গবন্ধু–পরবর্তী বাংলাদেশে সামরিক শাসন ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশের কাঠামোগত উন্নয়ন বারবার ব্যাহত হয়েছে। অথচ কাঠামোগত উন্নয়ন ব্যক্তিপর্যায়ের বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক নীতির বাস্তবায়নে জনগণের বিভিন্ন তথ্যউপাত্ত সংবলিত তথ্যভান্ডার অত্যন্ত জরুরি। সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদের হার সরকারকে কাঠামোগত উন্নয়নে বিনিয়োগের জন্য যে অর্থায়নের প্রয়োজন তা জোগান দিতে সহায়তা করছে। পদ্মা সেতু নির্মাণ, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন বা তথ্যভান্ডার তৈরিতে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করছে। বিদেশ থেকে ঋণ না নিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে এই কাজগুলো করার ফলে দেশের অর্থ দেশেই সঞ্চালন হচ্ছে এবং ভোক্তার চাহিদা তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। ব্যাংকিং খাত থেকে হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাওয়ার চেয়ে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে একীভূত টাকা দেশের উন্নয়নমূলক কাজে খরচ করা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে লাভজনক বটে।

জনগণ সঞ্চয়পত্রে টাকা বিনিয়োগ করে অধিক নিরাপদ বোধ করছেন, কারণ এর ফলে তাঁরা ব্যাংকগুলোর মালিক শ্রেণির স্বেচ্ছাচার থেকে দূরে থাকতে পারছেন। স্বল্প আয়ের মধ্যবিত্ত শ্রেণি এর ফলে একধরনের সামাজিক নিরাপত্তা উপভোগ করছে। উপরন্তু, এই টাকা গ্রামীণ অসহায় লোকদের সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানেও কাজে লাগানো হচ্ছে। সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে অর্থায়নের ফলে সরকারের যে নিয়মিত দায়ের সৃষ্টি হচ্ছে, ব্যাংক ব্যবস্থার ঋণের সুদের হার কমিয়ে তা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। আবার বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স বা রপ্তানি আয় এই দায়কে সাময়িক নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করছে। সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতিতে ৬–৯ সুদের নীতি দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ফলপ্রসূ নীতি হিসেবেই পরিগণিত হচ্ছে।

ব্যাংকিং খাতে সুদের হার বেঁধে দেওয়া আর্থিক নিষ্পেষণের (ফিন্যান্সিয়াল রিপ্রেসন) বহিঃপ্রকাশ এবং অর্থনীতিবিদেরা এটিকে ঋণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে থাকেন। কিন্তু নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ বাজারব্যবস্থার বৈকল্য ও প্রাতিষ্ঠানিক অনগ্রসরতার পরিপ্রেক্ষিতে আর্থিক নিষ্পেষণকে সমর্থন করেছেন। নব্বইয়ের দশকে চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে আর্থিক নিষ্পেষণের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কিন্তু এ কথা মনে রাখতে হবে, অর্থনৈতিক নীতি সদা পরিবর্তনশীল। বাজারব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক নিষ্পেষণ তার কার্যকারিতা হারাবে। উচ্চ মাত্রার মুদ্রাস্ফীতি বা ব্যক্তিপর্যায়ে বিনিয়োগের অধিক সংকোচনের ফলে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের আর্থিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে।

চীনের উন্নয়নের বর্তমান শ্লথগতি এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এর পরিপ্রেক্ষিতে চীন ধীরে ধীরে আর্থিক নিষ্পেষণ থেকে বেরিয়ে আসছে। আমাদেরও দীর্ঘ মেয়াদে এই নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সরকারকে মনে রাখতে হবে ব্যক্তিপর্যায়ের বিনিয়োগ সংকোচন দেশকে একটি উদ্যোক্তাহীন দেশে পরিণত করতে পারে, আর তাতে সাধারণ মানুষ সরকারি আনুকূল্যনির্ভর হয়ে পড়তে পারে, যার নিয়ামক হবে আবার সেই দুষ্ট রাজনীতি।

ড. মোশফিক উদ্দিন যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।