ব্রিটিশ নির্বাচন: ঔপনিবেশিকতার দায় নিয়ে বিতর্ক

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার দায়গুলোর উত্তরাধিকার আগের নির্বাচনগুলোতে কখনো আলোচনায় ওঠেনি। ছবি: রয়টার্স
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার দায়গুলোর উত্তরাধিকার আগের নির্বাচনগুলোতে কখনো আলোচনায় ওঠেনি। ছবি: রয়টার্স

গত শতাব্দীর শেষ তিন দশকে ভারত মহাসাগরে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি দিয়াগো গার্সিয়ার বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়নি, বাঙালি তরুণদের মধ্যে এমন সংখ্যা খুবই কম। আমাদের সীমান্তের দুই পারেই বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বামপন্থী রাজনীতির প্রভাব ছিল ব্যাপক। সুতরাং, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের অংশ হিসেবে ‘হাত গুটাও মার্কিন, ফুরিয়ে গেছে তোদের দিন’ স্লোগানে তখনকার দিনগুলোতে ক্যাম্পাসগুলো উত্তপ্ত থাকত। সেই দিয়াগো গার্সিয়া আবারও ফিরে এসেছে সংবাদ শিরোনামে। দিয়াগো গার্সিয়া যেসব দ্বীপপুঞ্জের অন্যতম, সেই চাগোস আইল্যান্ডসের মালিকানার প্রশ্নটি ব্রিটিশ সাধারণ নির্বাচনে হঠাৎ করেই আলোচনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের যে অবশিষ্টাংশ এখনো টিকে আছে তার অবসায়ন-বি–উপনিবেশায়নের প্রশ্নটি ফিরে এসেছে নির্বাচনের বিচার্য বিষয়সূচিতে। 

গত শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ছিল চাগোস দ্বীপপুঞ্জ থেকে ব্রিটিশদের সরে আসার জন্য জাতিসংঘের নির্ধারিত সময়সীমার শেষ দিন। কিন্তু ব্রিটেন জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া এই সময়সীমা মানেনি। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন বলেছেন, তিনি ইতিহাসের ভুলগুলোর একটি শুধরে দেবেন। তিনি বলেছেন, চাগোস দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দাদের নিজের মাটিতে ফিরে যাওয়ার অধিকার রয়েছে এবং তাদের সেই অধিকার আদায়ের আন্দোলনে আমি অতীতে সমর্থন করেছি। চাগোসের বাসিন্দাদের প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে, তা নিন্দনীয়। 

অন্য কোনো দলের নেতা অবশ্য এই প্রশ্নের মুখে পড়েননি। এর সম্ভাব্য ব্যাখ্যা অবশ্য পাওয়া যাবে লেবার পার্টির নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোয়। লেবার পার্টি ২১ নভেম্বর প্রকাশিত তার ম্যানিফেস্টোয় ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক অতীতকে পর্যালোচনার অঙ্গীকার করেছে। সন্দেহ নেই লেবার পার্টি এবং তার মানবতাবাদী নেতা জেরেমি করবিন এতে চরম সাহসিকতার প্রমাণ রেখেছেন। শুধু তা-ই নয়, মঙ্গলবার তাঁর দল বলেছে যে তারা নির্বাচিত হলে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ঔপনিবেশিক আমলের অন্যায়গুলোর বিষয়েও শেখানো হবে। দাসব্যবস্থার যে রেশ থেকে গেছে, তা মোকাবিলার জন্যই এই ইতিহাস শেখানো প্রয়োজন। তবে নির্বাচনে তার প্রভাব কতটা নেতিবাচক বা ইতিবাচক হবে, তা বলা মুশকিল। 

চাগোস দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে ব্রিটেনের সঙ্গে মরিশাসের বিরোধ অর্ধশতাব্দীর বেশি পুরোনো। এই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য মরিশাস আন্তর্জাতিক বিচার আদালত, ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস, আইসিজের শরণাপন্ন হলে আদালত ব্রিটেনের বিরুদ্ধেই রায় দিয়েছিলেন। চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি আদালত তাঁর রায়ে ব্রিটিশ দখলদারিকে অবৈধ অভিহিত করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চাগোসের নিয়ন্ত্রণ মরিশাসের কাছে হস্তান্তরের পরামর্শ দিয়েছিলেন। আইসিজে বলেছে যে ১৯৬৫ সালে মরিশাসের কাছ থেকে চাগোসের দ্বীপগুলোকে বিচ্ছিন্ন করার সময় সেখানকার বাসিন্দাদের মতামত নেওয়া হয়নি। 

১৯৬৮ সালে ব্রিটেন মরিশাসকে স্বাধীনতা দেওয়ার সময়ে চাগোসের মূল্য হিসেবে ৪০ লাখ পাউন্ড দিয়েছিল। তারপর এগুলো ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান ওশান টেরিটোরি (বিআইওটি) ঘোষণা করে সেখানে ইঙ্গ-মার্কিন সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার জন্য সেখানকার প্রায় দেড় হাজার বাসিন্দাকে বিভিন্ন দেশে স্থানান্তর করে। ১৯৭১ সালে ব্রিটেন দিয়াগো গার্সিয়া যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইজারা দেয়, যা ২০৩৬ সাল পর্যন্ত বহাল থাকার কথা। আইসিজেতে মরিশাস দাবি করেছিল যে তাদের ভয় দেখিয়ে চাগোস নিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং তা ছিল জাতিসংঘের ১৯৬০ সালে গৃহীত বি–উপনিবেশায়নবিষয়ক প্রস্তাবের লঙ্ঘন।

আইসিজের রায় বাস্তবায়নের বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করে বিরোধে লিপ্ত সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সদিচ্ছার ওপর। আন্তর্জাতিক আদালতে ব্রিটেন দাবি করেছিল যে ওই দ্বীপপুঞ্জের সার্বভৌমত্ব নির্ধারণের এখতিয়ার আদালতের নেই। রায় বাস্তবায়নে তাই ব্রিটিশ সরকার মোটেও আগ্রহী নয়। বিষয়টি তাই জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত হলে গত মে মাসে ব্রিটেনকে ছয় মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে প্রস্তাব পাস হয়েছিল। প্রস্তাবের পক্ষে ১১৬টি দেশ এবং বিপক্ষে মাত্র ৬টি দেশ ভোট দেয়। ওই সময়সীমার মধ্যে রায় বাস্তবায়ন না করায় মরিশাসের পক্ষে আদালতে প্রতিনিধিত্ব করা ব্রিটিশ আইন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ফিলিপ স্যান্ডস ব্রিটেনের সমালোচনা করে বলেছেন, এটি হচ্ছে আইন উপেক্ষা করা এবং তা ঔপনিবেশিক মানসিকতা বজায় রাখারই প্রতিফলন। আইসিজের রায় বাস্তবায়ন না করার কারণে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির মতো ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা জাতিসংঘের থাকলেও তা ঘটার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। কেননা, ব্রিটেন নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এবং তার ভেটো ক্ষমতা রয়েছে। 

লেবার পার্টিতে জেরেমি করবিন যে কট্টর বামপন্থার প্রতিনিধিত্ব করেন তা সবারই জানা। কিন্তু তাঁর দল লেবার পার্টি তাঁর মতো এতটা কট্টর নীতি অনুসরণের পক্ষে নয়। বরং তাঁর পূর্বসূরি নেতারা টনি ব্লেয়ার ও গর্ডন ব্রাউন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি অনুশীলন করে এসেছেন। ‘আগে বোমা মারো, পরে আলোচনা’ নীতির বিরুদ্ধে করবিনের শান্তিবাদী অবস্থান ব্রিটিশ ভোটারদের মধ্যেও খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও করবিন ঔপনিবেশিক আমলের ভুলগুলো শোধরানোর উদ্যোগ নিয়েছেন অতীত পর্যালোচনার কথা বলে যে নির্বাচনী ঝুঁকি নিয়েছেন, তা বিস্ময়কর। 

ঔপনিবেশিকতার দায়গুলোর উত্তরাধিকার এর আগের নির্বাচনগুলোতে কখনো আলোচনায়ও ওঠেনি। এবারও তা নিয়ে যে খুব একটা তোলপাড় হচ্ছে তা নয়। তবে ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদের কথিত শ্রেষ্ঠত্ব পুনরুদ্ধারের পণ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনকে বের করে নেওয়ার জিহাদ যিনি শুরু করেছিলেন, সেই নাইজেল ফারাজ করবিনের রাজনৈতিক অঙ্গীকারে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি বলেছেন, অতীতে মনোযোগী হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। ফারাজ দাবি করেছেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য অন্য ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর মতো সামরিক হস্তক্ষেপের বদলে ঘুষের ওপর নির্ভর করেছিল। লেবার পার্টির আনুষ্ঠানিক ম্যানিফেস্টো ঘোষণার আগেই (সম্ভবত আগাম তথ্যের ভিত্তিতে) ১৯ নভেম্বর লন্ডনের কাছে পিটারবরায় এক নির্বাচনী সভায় নাইজেল ফারাজ বলেছেন, ৩০০ বছর আগে মানুষ কী করেছে তার জন্য আমাকে ক্ষমা চাইতে হবে বলে আমি মনে করি না। তাঁর আরেক সতীর্থ ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট পার্টির সদস্য ক্লেয়ার ফক্স বলেছেন, ঔপনিবেশিক অতীতের নজর দিয়ে করবিন চান মানুষ যেন ব্রিটিশ হিসেবে অপরাধবোধে ভোগে। 

ঔপনিবেশিক আমলের হত্যা, লুণ্ঠন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধের বিষয়গুলো নিয়ে ব্রিটেনে সময়ে সময়ে যে আলোচনা হয় না, তা নয়। তবে প্রধানত আফ্রিকা এবং ক্যারিবীয় দেশগুলোর তরফ থেকে বিভিন্ন সময়ে ঔপনিবেশিক আমলের অন্যায়-অপরাধের প্রতিকার দাবির মুখেই সেসব আলোচনা হয়ে থাকে। ভারতের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের বিষয়েও তেমনটি ঘটেছে। ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে এ জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশের নজিরও আছে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ তথা সেই আমলের বাংলায় সংঘটিত অপরাধ ও অগণিত মৃত্যুর জন্য কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার দাবি ওঠেনি। 

জেরেমি করবিন লেবার পার্টির নেতা হয়েছেন দৈবচক্রে। গতবারের মতো এবারের নির্বাচনেও সব জনমত সমীক্ষায় তিনি পিছিয়ে আছেন এবং রাজনীতির পণ্ডিতেরা তাঁর বিজয়ের কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও যে এককভাবে সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেন, এমনটাও কেউ ভাবছেন না। এ রকম অবস্থায় গত পার্লামেন্টের তৃতীয় প্রধান দল, স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি এবং আরও দু-একটা ছোট দলের সমর্থনে তাঁর ডাউনিং স্ট্রিটে পৌঁছে যাওয়া একেবারে অসম্ভব কিছু নয়। করবিন প্রধানমন্ত্রী হলে বি–উপনিবেশায়নের ধারা সম্পাদনের অংশ হিসেবে অতীতের পাপের দায় মেটানোর মতো কিছু ইতিবাচক ব্যবস্থা আশা করা বোধ হয় অযৌক্তিক নয়। 

কামাল আহমেদ সাংবাদিক