ভারতের মসজিদ ও পাকিস্তানের মন্দির

বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার ঘাতটা আসলে পড়েছিল ভারতীয় সংবিধানের ওপর

আবার বাবরি মসজিদের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যমে। ভারতের অযোধ্যার এই মসজিদের (এখন এর অস্তিত্ব নেই) নাম উচ্চারণমাত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের সেই দৃশ্য। ‘করসেবক’ নামে অভিহিত হিংসায় উন্মত্ত মানুষ গাঁইতি-শাবল-হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলছে একটি স্থাপনা। আঘাতটা সেদিন পড়েছিল আসলে ভারতীয় সংবিধানের ওপর। ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমান সেদিন হয়তো গভীর বেদনায় উপলব্ধি করেছিল, যতই আইন ও কাগজপত্রের বিধিবিধান দিয়ে সমতা ও নিরাপত্তার কথা বলা হোক, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেই সংখ্যালঘুর জীবনটাই আসলে একটা অভিশাপ।

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনার প্রভাব পড়েছিল উপমহাদেশজুড়ে। ১৯৯০ সালে একবার এই মসজিদের ওপর উগ্রবাদী হিন্দুদের হামলা এবং ১৯৯২ সালে এটি ধূলিসাৎ করার চেষ্টায় তাদের ‘সাফল্যে’ ভারতে ভয়াবহ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়েছিল। ১৯৯২ সালে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, যার অধিকাংশ সংখ্যালঘু মুসলমান। ওই ঘটনার প্রভাব পড়েছিল পাকিস্তান ও বাংলাদেশেও।

১৯৯০ সালে এ দেশে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল। পতনোন্মুখ সরকারের মন্ত্রী-সাংসদ ও উচ্চ পদে আসীন ব্যক্তিরা নিজেদের পিঠ বাঁচাতে ভারতের বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাটিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন। এ দেশেও যাতে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে আপাতত সরকারবিরোধী আন্দোলনকে অন্য খাতে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়, তার সব চেষ্টাই করেছিলেন তাঁরা; সাময়িকভাবে সফল হয়েছিলেন। বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ, নির্যাতন, বাড়িঘর লুণ্ঠন ও আরও বড় কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তারা নিজেদের অসহায়ত্ব প্রত্যক্ষ করে অশ্রুসিক্ত চোখে। কেউবা আজন্ম আবাস ছেড়ে দেশান্তরি হয়। পাকিস্তানের অবস্থাও সম্ভবত এর চেয়ে ভালো কিছু নয়। কারণ, সেখানে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে এখন আঙুলে গোনার মতো।

‘এখানে তুমি সংখ্যালঘু, ওখানে তুমি জমজমাট’—এই নিয়তি-নির্ধারিত বাস্তবতাই যেন মেনে নিতে শিখে গেছি আমরা। কিন্তু এর মধ্যে হঠাৎ ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনাগুলো যেন মানুষ ও মানবতা শব্দগুলোর ওপর আমাদের কিছুটা আস্থা ফিরিয়ে আনে। কিছুটা আশা ও আশ্বাস জাগিয়ে দেয় মনে। বাবরি মসজিদের পরিবর্তে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় (ইন্দো-ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট) অযোধ্যার সোহাভাল তফসিলের ধন্নিপুর গ্রামে সরকার প্রদত্ত পাঁচ একর জমির ওপর যে মসজিদ নির্মাণ করতে যাচ্ছে, তার নকশা প্রকাশ করা হয়েছে সম্প্রতি। এ যেন হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীর ওপর এক পশলা শান্তির বারিধারা।

নকশা অনুযায়ী, মসজিদটি হবে গোলাকৃতির, সেখানে একসঙ্গে দুই হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। মসজিদ কমপ্লেক্সে থাকবে ৩০০ শয্যার একটি হাসপাতাল, সেখানে সম্প্রদায়নির্বিশেষে যেকোনো অসুস্থ মানুষ চিকিৎসা পাবে। মসজিদ কমপ্লেক্সেই চালু করা হবে একটি কমিউনিটি কিচেন, সেখানে আশপাশের এলাকার গরিব-অনাহারী মানুষকে দুই বেলা বিনা মূল্যে ভালো মানের খাবার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। সবচেয়ে বড় কথা, সেখানে মানুষকে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-শিখ-খ্রিষ্টান এই পরিচয়ে ভাগ করা হবে না। তাদের একটাই পরিচয়, তারা ক্ষুধার্ত, তারা মানুষ। মসজিদ কমপ্লেক্সে একটি লাইব্রেরি ও একটি জাদুঘর স্থাপনেরও পরিকল্পনা রয়েছে। মোদ্দা কথা, মেধা ও মননের চর্চা এবং ধর্মের মধ্যে মানবতার যে মহান বাণী, তাকে ছাড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যেই প্রণীত হয়েছে এই মসজিদের নকশা।

অনেক হিংসা-বিদ্বেষ, অনেক দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতার বিষয় ছিল বাবরি মসজিদকে ঘিরে। কিন্তু সেই সহিংস অতীত ভুলে নতুন করে যাত্রা শুরু করতে চান মসজিদ নির্মাণের উদ্যোক্তারা। মসজিদটি ভেঙে ফেলার পর প্রায় ২৭ বছর মামলা চলার পর রায় ঘোষণা করেন সুপ্রিম কোর্ট। বিতর্কিত স্থানে রামমন্দির নির্মাণের আদেশ দেন আদালত, একই সঙ্গে অযোধ্যায় বিকল্প কোনো স্থানে মসজিদ নির্মাণের জন্য পাঁচ একর জমি বরাদ্দের আদেশ দেন সরকারকে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই রায়ে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন মুসলমানরা। একধরনের পরাজয়ের বোধও কাজ করছিল তাঁদের মনে।

গত ৩০ ডিসেম্বর পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়ার শতবর্ষী একটি হিন্দু মন্দিরে হামলা চালিয়ে ধ্বংস করে উগ্রপন্থীরা

কিন্তু ইন্দো-ইসলামিক কালচারাল ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক ও মসজিদের স্থপতি দুজনেই বলেছেন, এই কমপ্লেক্স নির্মাণের সময় তাঁরা আর পেছনের দিকে ফিরে তাকাতে চাইছেন না। অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের যে ‘বিশাল কর্মযজ্ঞ’ চলছে, তার সঙ্গে নিজেদের নির্মাণ প্রকল্পের তুলনাও করতে চাইছেন না। এই মসজিদের নাম এখনো ঠিক করা হয়নি। তবে কোনো রাজা-বাদশাহর নামে এর নামকরণ হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে ট্রাস্ট। সবচেয়ে বড় কথা, এ বছর ২৬ জানুয়ারি মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কারণ, সাত দশক আগে এই দিনে ভারতের সংবিধান কার্যকর হয়েছিল। এই সংবিধান বহুত্ববাদের ওপর নির্ভর করে প্রণীত, যা হবে এই মসজিদের ভিত্তি।

এখানে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক একটি ঘটনার উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। গত ৩০ ডিসেম্বর পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়ার শতবর্ষী একটি হিন্দু মন্দিরে হামলা চালিয়ে ধ্বংস করে উগ্রপন্থীরা। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এর বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ারও সাহস করেনি। কিন্তু সে দেশের প্রধান বিচারপতি এই দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে যে ভূমিকা রেখেছেন, তা নিঃসন্দেহে অনন্যসাধারণ। স্বপ্রণোদিত হয়ে তিনি সুয়োমোটো জারি করেন। ৪ জানুয়ারির মধ্যে পাখতুনের চিফ সেক্রেটারি ও আইজিপিকে রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশ দেন। ৪ জানুয়ারি শুনানির দিন পুলিশ প্রশাসন নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে। পুলিশ সুপারসহ সেখানে কর্তব্যরত ৯২ জন পুলিশকে বরখাস্ত করা হয়। মন্দির ভাঙার কাজে উসকানি দেওয়ার জন্য জনৈক মাওলানা শরিফ ও তাঁর অনুসারীদের দায়ী করে তাঁদেরই মন্দির সংস্কারের নির্দেশ দেওয়া হয়। মন্দির ভাঙার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করার নির্দেশও দেন আদালত।

উপমহাদেশজুড়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ-বিদ্বেষের ঘটনাবলির তুলনায় এই দু-একটা ঘটনা হয়তো সংখ্যায় খুবই কম। কিন্তু এই উদার মানবতাবাদই তো শেষ পর্যন্ত জ্বালিয়ে রাখে আশার আলো।


বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক

[email protected]