ভার্চ্যুয়াল আদালত নিয়ে প্রশ্ন কেন

জনবান্ধব করার স্বার্থে ভার্চ্যুয়াল কোর্টের অবসান ঘটানো অসমীচীন হবে

কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার মার্চ মাসের ২৬ তারিখ থেকে মে মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত আদালতসহ দেশের সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট বিচারব্যবস্থা চালু রাখার ব্যাপারে দফায় দফায় ভার্চ্যুয়াল ফুলকোর্ট সভা করেন। সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক সুপ্রিম কোর্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে ভার্চ্যুয়াল আদালত প্রতিষ্ঠার অনুরোধ জানালে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ৯ মে, ২০০০ আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০ প্রণয়ন করেন। পরে জাতীয় সংসদ অধ্যাদেশটিকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে আইনে পরিণত করেন। আইনের নাম দেওয়া হয় ‘আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার আইন, ২০২০’। আইনে মোট ৬টি ধারা। আইনের প্রস্তাবনায় কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে আইনটির প্রয়োগের কথা উল্লেখ করা হয়নি। বরং আদালতকে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সাধারণ ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। এবং বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে যেভাবে একটি মামলার ক্ষেত্রে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিধানাবলি বিধৃত আছে; এই আইনটিতেও তেমন বিধান রাখা হয়েছে ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতির মাধ্যমে।

আইনের ২(ঙ) ধারায় ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতির সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতি’ অর্থ অডিও, ভিডিও বা অনুরূপ অন্য কোনো ইলেকট্রনিক পদ্ধতির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির আদালতের বিচার বিভাগীয় কার্যধারায় উপস্থিত থাকা বা অংশগ্রহণ।’ আইনের ৩ ও ৪ ধারা আইনটির প্রাণ। আর এই প্রাণ বাঁচিয়ে রাখার অক্সিজেন হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের প্র্যাকটিস নির্দেশনা। আইনের ৫ ধারায় বলা হয়েছে যে ৩ ও ৪ ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বা ক্ষেত্রমত হাইকোর্ট বিভাগ [প্রয়োজন হলে] বিশেষ বা সাধারণ প্র্যাকটিস নির্দেশনা জারি করবেন। একের পর এক প্র্যাকটিস নির্দেশনা আসতে থাকে।

গত ৩০ মে ২০২০ তারিখে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ ১০ মে ২০২০ তারিখের প্র্যাকটিস নির্দেশনার পরিধি বাড়িয়ে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে অধস্তন সব আদালত খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মে মাসেই হাইকোর্ট বিভাগ ভার্চ্যুয়াল মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা হচ্ছে কি না এবং কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে কি না, সে বিষয়ে তদারকি করার জন্য কমিটি গঠনের জন্য সার্কুলার জারি করেন। এভাবে মে-জুন ২০২০ সময়টি হাইকোর্ট বিভাগ অধস্তন আদালতসমূহকে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যম ব্যবহার করে বিচারকার্য পরিচালনায় অভ্যস্ত করাতে থাকেন। ইউনিসেফ এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছে যে ভার্চ্যুয়াল কোর্ট সিস্টেম বাংলাদেশে কোভিড-১৯–এর সংক্রমণ ঠেকাতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। ওই নিবন্ধে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে ভার্চ্যুয়াল আদালত ব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশের আদালতসমূহে এবং কয়েদখানাগুলোতে মানুষের ভিড় কমেছে।

কিন্তু জুন মাসে প্রায় সারা দেশের আইনজীবীরা বিশেষ করে সিনিয়র আইনজীবীদের একটি অংশ ভার্চ্যুয়াল আদালত পদ্ধতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তাঁরা কোনো কোনো জেলায় আদালত বয়কট করেছেন। কোনো কোনো জেলায় জেলা ও দায়রা জজ মহোদয়কে লিখিতভাবে ভার্চ্যুয়াল কোর্টে শুনানির বিরোধিতা করে আগের নিয়মে কোর্ট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে চান। এমনকি তাঁরা আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০ যাতে সংসদে আইনে পরিণত করা না হয়, সে জন্যও এ–সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি পাঠান। আবার সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন ৮ জুলাই বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি বরাবর চিঠি পাঠান স্বাভাবিকভাবে আদালত খুলে দেওয়ার জন্য। হয়তো আইনজীবীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আইনমন্ত্রী ওই একই তারিখে ঘোষণা দেন যে আগামী সপ্তাহ থেকে নিয়মিত আদালত চালু হবে। আশ্চর্যজনকভাবে দুই ঘোষণার পাশাপাশি সমান্তরালভাবে ৯ জুলাই আইন পাস হলো।

অন্যদিকে আইনটির ০৫ ধারার বাস্তবায়ন সুপ্রিম কোর্টের অনুভূতির ওপর যথেষ্ট নির্ভরশীল। অনুভূতি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। তাই মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগও মনে হয় আইনজীবীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভার্চ্যুয়াল আদালত ব্যবস্থার পরিধি বাড়িয়ে নেওয়ার পরিবর্তে কোভিড-১৯ মহামারির ঝুঁকির মাঝেও শারীরিক উপস্থিতিতেই আদালত খুলে দেওয়ার সার্কুলার জারি করা শুরু করেন। এমনই পরিস্থিতিতে ১৮ জুলাই হাইকোর্ট সার্কুলারে নির্দেশ দিলেন দেওয়ানি মোকদ্দমা বা মামলায় জরুরি বিষয়সমূহ শারীরিক উপস্থিতিতেই নিষ্পত্তি করতে হবে। সর্বশেষ ৩০ জুলাই হাইকোর্ট নির্দেশ দিলেন শারীরিক উপস্থিতিতে আদালত চালাতে হবে। কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগ এবং আপিল বিভাগ এখনো ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমেই বিচারকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা অনুসারে সারা দেশে অধস্তন আদালতগুলো স্বাস্থ্যঝুঁকির মাঝেই বিচারকার্য শুরু করেছেন। আদালতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য হাইকোর্ট প্রতিটি জেলার গণপূর্ত বরাবর চিঠি পাঠান। কিন্তু গণপূর্তের প্রকৌশলীরা এসব কাজ করে চলেছেন স্বাভাবিক অন্যান্য কাজের মতো করে। ফলে দেশের প্রায় সব আদালত ঝুঁকির মধ্যে কাজ করছেন। এর ফলে সারা দেশে বিচারক, আদালতের স্টাফ, আইনজীবী, মুহুরিসহ সাধারণ মানুষের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে গেছে। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন আইন ও বিচার বিভাগ পরিচালিত করোনা মনিটরিং ডেস্কের ২৪ আগস্ট পর্যন্ত পরিসংখ্যান বলছে, কোভিড-১৯–এ সুপ্রিম কোর্টসহ অধস্তন আদালতে ১০৫ জন বিচারক এবং ৩৪৬ জন কর্মচারী আক্রান্ত হয়েছেন এবং আইনজীবী মারা গেছেন ১০০ জনের বেশি। সাধারণ বিচারপ্রার্থী জনগণ আদালতে যাওয়া–আসার কারণে কী পরিমাণে আক্রান্ত হয়েছেন, তার হিসাব নেই। সুতরাং এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে স্বাস্থ্যগত দিক থেকে প্রস্তুতি ছাড়াই বিচার বিভাগ চালু করার ফল আদতে ভালো হয়নি।

তাহলে বর্তমান পরিস্থিতিতে ভার্চ্যুয়াল আদালতের ভবিষ্যৎ কী? বাংলাদেশের বিচার বিভাগ তাত্ত্বিকভাবে সরকারের তিন অঙ্গের অন্যতম একটি পিলার হলেও তাঁকে নিজের ভাবমূর্তি নিয়ে টিকে থাকার জন্য নানা রকম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। মাজদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এখনো অধরা এবং অসম্পূর্ণ হয়ে আছে। বিচারকদের রাষ্ট্রীয় পদক্রম যথা অর্ডার অব প্রিসিডেন্সবিষয়ক মামলা এখনো মহামান্য আপিল বিভাগে পড়ে আছে।

সারা দেশে প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা বিশেষ করে বিসিএসের (প্রশাসন ক্যাডার) কর্মকর্তাদের যেরূপ সুযোগ–সুবিধা প্রদান করা হয়, বিচারকদের তা প্রদান করা হচ্ছে না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কোনো প্রাধিকারবিষয়ক সার্কুলার জারি করে কর্মকর্তাদের সুযোগ–সুবিধার কথা উল্লেখ করলে তা যে বিচার বিভাগের জন্যও প্রযোজ্য [বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরি, নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা বিধান এবং চাকরির অন্যান্য শর্তাবলি) বিধিমালা, ২০০৭–এর বিধি ৯ অনুসারে সেটা সংশ্লিষ্টদের বোঝানো যায় না। তাঁরা বলেন, বিচারকেরা আলাদা। তাঁদের হাইকোর্ট আছে, নিজস্ব মন্ত্রণালয় আছে। তাঁদের সুযোগ–সুবিধা ওখান থেকেই আসবে।

এই আলোচনার প্রেক্ষাপটে অনুধাবন করা যায় বিচার বিভাগ কতটা কোণঠাসা অবস্থায় আছে। ফলে যদি বিচার বিভাগ নিজের কী দরকার, তা স্পষ্টভাবে সরকারকে বোঝাতে না পারেন বা যা পেয়েছেন, তা যদি ধরে না রাখতে পারেন তাহলে বিচার বিভাগ আরও কোণঠাসা হয়ে পড়বেন।

সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে পুলিশকে মানবিক এবং জেলা প্রশাসনসহ ডাক্তারদের করোনাযোদ্ধা বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। করোনাকালে বিচারকদের যে দুর্বিসহ অবস্থার মধ্যে বিচারকাজ চালাতে হচ্ছে, সে জন্য তাঁদেরও এ রকম উপাধি প্রয়োজন ছিল। কোনো আর্থিক প্রণোদনার জন্য নয়, তা হলো মানসিক প্রণোদনার জন্য। বাংলাদেশের আদালতসমূহ আস্তে আস্তে যে অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতার দিকে যাচ্ছে, তাতে ভার্চ্যুয়াল কোর্টের বিকল্প এখন কিছুই হতে পারে না। বাংলাদেশের মানুষের ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিচার বিভাগ আরও গোছালো, জনবান্ধব করার স্বার্থে ভার্চ্যুয়াল কোর্টের অবসান ঘটানো অসমীচীন হবে।

মো. ফরিদুজ্জামান: সহকারী জজ, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঝিনাইদহ।