ভালো ভাবুন, ভালো থাকুন

রোশেতো শহরের বন্ধুবৎসল, আড্ডাপ্রিয়, সুখী মানুষেরা

রোশেতো আমেরিকার পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের ছোট্ট এক শহর। পাহাড়ের নিচে। লোকবসতি নেই বললেই চলে। উনিশ শতকের শেষের দিকে ইউরোপজুড়ে বড় ধরনের আর্থিক মন্দা নেমে এসেছিল। কাজকর্ম ছিল না। ইউরোপ থেকে দলে দলে মানুষ পাড়ি জমাচ্ছিল আমেরিকায়।

এ রকমই একদল লোক ইতালির প্রত্যন্ত এক গ্রাম থেকে ভাগ্যান্বেষণে এসে বসত গড়ে রোশেতো শহরে। খনিতে শ্রমিকের কাজ। পাথর তোলা। হাড়ভাঙা খাটুনি। তাতে কী, কাজ আছে বলেই তো খাবার আছে। ভালো থাকার এই খবর আস্তে আস্তে পৌঁছে গেল ইতালির সেই প্রত্যন্ত গ্রামে। রোশেতো শহরে বাড়তে থাকল ইতালি থেকে আসা অভিবাসী মানুষের সংখ্যা। কাজও জুটে গেল, সেই একই। অর্থাৎ, খনিতে পাথর তোলা।

পাহাড়ের গা ঘেঁষে নতুন নতুন বাড়ি উঠতে থাকল। আমেরিকার অন্য শহর বা গ্রামের মতো দূরে দূরে নয়। পাথরের দেয়াল, ওপরে টালির ছাদ। ইউরোপীয় ধাঁচের বাড়ি। ঢিল ছোড়া দূরত্বে। সবাই একে অপরের পরিচিত। জাহাজে একসঙ্গে সাগর পাড়ি। নতুন দেশে এসে দূরে থাকবেন কেন।

গড়ে উঠল দোকান। রেস্তোরাঁ। পড়ে থাকা জমি পরিষ্কার করে শুরু হলো ইতালীয়দের পছন্দের সবজি আর ফলের চাষ। তাদের পোশাকপ্রীতি অনেক আগে থেকেই। গড়ে উঠল জামাকাপড় বানানোর ছোট ছোট দোকান। তৈরি হলো গির্জা, স্কুল আর পার্ক। শহরের ভাষাও ইতালিয়ান। পাশের শহরে অভিবাসী ইংরেজদের বাস। তার পাশে জার্মানদের। যে যার যার মতো থাকে। তিন শহরের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ তেমন একটা নেই।

স্টুয়ার্ট উলফ পেশায় চিকিৎসক। রোশেতো শহরে চিকিৎসকদের এক সম্মেলনে যোগ দিতে এলেন। সম্মেলন শেষে আড্ডা দিচ্ছিলেন। স্থানীয় এক চিকিৎসক বললেন, ‘জানো, প্রায় দুই যুগ ধরে এখানে কাজ করছি। কিন্তু ৬৫ বছরের নিচে যাঁদের বয়স, তাঁদের একজনের শরীরেও এখন পর্যন্ত হার্টের রোগ দেখিনি।’

১৯৫০–এর দশকে আমেরিকাজুড়ে হৃদরোগ ছড়িয়ে পড়েছিল মহামারির মতো। কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ তখনো আবিষ্কৃত হয়নি। আমেরিকায় তখন ৬৫ বছরের কমবয়সীদের মৃত্যুর একটা বড় কারণ ছিল হার্টের বিভিন্ন রোগ।

স্টুয়ার্ট স্থানীয় চিকিৎসকের দেওয়া এ তথ্য একদমই বিশ্বাস করলেন না। কিন্তু অত্যন্ত উৎসাহী হয়ে উঠলেন সত্যটা জানার জন্য। সত্য জানার একটাই উপায়, গবেষণা করা। যেমন ভাবা তেমন কাজ। বেশ কিছু টাকাও জোগাড় হলো তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ আর বিভিন্ন পরীক্ষা করার জন্য। স্টুয়ার্ট গিয়ে শহরের মেয়রকে বললেন, ‘তোমার শহরে চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক বড় রহস্য লুকিয়ে আছে।’

শহরের সবচেয়ে বড় কমিউনিটি সেন্টারটি মেয়র গবেষণার কাজে ব্যবহার করার অনুমতি দিলেন। টাকা আর পরিকাঠামো হলেই তো হবে না; সঙ্গে দরকার প্রশিক্ষিত গবেষকদের। শিক্ষার্থী চিকিৎসকেরা রাজি হলেন। শুরু হলো গবেষণা। পৌরসভা থেকে জোগাড় করা হলো অতীতের মৃত্যুসনদ। শহরের সব মানুষের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করা হলো। মাপা হলো ব্লাড প্রেশার। ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম বা ইসিজিও হলো।

তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে স্টুয়ার্ট হতভম্ব। শহরে ৫৫ বছরের নিচে হার্ট অ্যাটাকে কোনো লোক মারা যায়নি গত দুই যুগে। ৬৫ বছরের ওপরে হার্টের রোগে মৃত্যুহার গোটা আমেরিকার মৃত্যুহারের অর্ধেক। আত্মহত্যায় মৃতের সংখ্যা শূন্য। নেই নেশাগ্রস্ত লোক। মদ্যপান পরিমিত। নেই পেটের আলসার। শহরের কেউই সরকারি অর্থসহায়তা নেয় না। অধিকাংশ মৃত্যুই বার্ধক্যজনিত স্বাভাবিক মৃত্যু।

তাহলে কি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস? ইতালি থেকে আসা অভিবাসী আর তাদের পরবর্তী প্রজন্ম নিশ্চয়ই জলপাই তেল দিয়ে খাবার রাঁধে। পাতলা রুটির ওপর সামান্য টমেটো আর পেঁয়াজ দিয়ে তৈরি পিৎজা খায়। দেখা গেল এ ধারণাও ভুল। অভিবাসী আর তাদের পরবর্তী প্রজন্ম খাদ্যাভ্যাস অনেকটা আমেরিকার অন্য জায়গার মতো করে ফেলেছে। সাধারণ তেল। মোটা রুটি আর মাংস দিয়ে তৈরি পিৎজা। প্রতিদিন বিস্কুট আর সঙ্গে দুধ দেওয়া কফি।

প্রতিদিন সকালে উঠে কয়েক মাইল হাঁটা বা যোগাসন? না। তাহলে নিশ্চয়ই ইতালির ওই গ্রাম থেকে আসা অভিবাসীদের শরীরে এমন কোনো জিন আছে, যা কিনা তাদের হার্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখছে। গবেষক দল আমেরিকাজুড়ে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা ওই গ্রাম থেকে আসা অভিবাসীদের খুঁজে বের করলেন। করা হলো স্বাস্থ্য পরীক্ষা। দেখা গেল, তাদের স্বাস্থ্য অন্য আমেরিকানদের মতোই।

পাহাড়ঘেরা ছবির মতো এই শহরের পরিবেশ কি তাহলে ভালো স্বাস্থ্যের কারণ?
কীভাবে তা প্রমাণ করা যাবে? আশপাশে দুটি শহরেও একই রকমের আবহাওয়া। দেখা যাক ওখানে মানুষের হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুহার কেমন? দুটি শহরে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হার রোশেতো থেকে অন্তত তিন গুণ বেশি। খাদ্যাভ্যাস, শরীরচর্চা, জিন, এমনকি শহরের পরিবেশও নয়। তাহলে আসলে কী কারণে এই শহরের মানুষের হার্টের স্বাস্থ্য এত ভালো, হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুহার এত কম?

গবেষকেরা অত্যন্ত বিভ্রান্ত। শেষ চেষ্টা হিসেবে তারা শহরে এসে থাকতে শুরু করলেন শহরবাসীর জীবনচর্চা কাছ থেকে দেখবেন বলে। কী দেখতে পেলেন? বলছি। তার আগে আপনাকে একটু আপনার অতীতে নিয়ে যাব। আপনি যে পাড়ায় বড় হয়েছেন, সেই পাড়ার কথা ভাবুন। ছোটবেলার কথা। বাড়ির সামনে ছুটির দিনে, বিকেলে বা অবসরে লোকে আড্ডা দিচ্ছে। কেউ দাবা খেলছে, কেউবা ক্যারম। হেঁটে যাওয়া মানুষ একে অপরকে থামিয়ে ডাকছে, নাম ধরে। কেমন আছ? পাড়ার দোকানিও সবার নাম জানে। চায়ের দোকান হলো কমিউনিটি সেন্টার। জানালা দিয়ে ভেসে আসছে রেডিওর আওয়াজ বা সুরেলা গলায় রেওয়াজ করছেন কোনো সুন্দরী। সুরেলা সুন্দরী নাও হতে পারে।

ঠিক এ রকম একটি চিত্র গবেষকেরা পেয়েছিলেন। দলবদ্ধভাবে থাকা। একে অন্যের খোঁজ নেওয়া। প্রয়োজনে এগিয়ে যাওয়া। অবসর সময় কাটানো। নিজেকে ব্যস্ত রাখা। আর কিছু ভালো বন্ধু। নিয়ম করে তারা আড্ডা দেয়। একে অন্যের খোঁজ নেয়। অহেতুক দুশ্চিন্তা করে না।

ইতালির গ্রাম থেকে আসা মানুষ রোশেতো শহরে এমন এক সামাজিক আর পারিবারিক কাঠামো তৈরি করেছিলেন, যা কিনা মানুষকে ইতিবাচক হতে সাহায্য করেছিল। স্টুয়ার্ট উলফের এই গবেষণাপদ্ধতি আর ফলাফল গবেষণার মানদণ্ডের বিচারে প্রশ্নের বাইরে নয়। পক্ষে–বিপক্ষে লেখা হয়েছে একাধিক প্রবন্ধ। তৈরি হয়েছে অসংখ্য প্রামাণ্যচিত্র। দেরিতে হলেও কাজের স্বীকৃতি মিলেছে।

সাম্প্রতিক কিছু গবেষণাতেও একই রকম ফলাফল দেখা গেছে। জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন, যারা ইতিবাচক চিন্তা করে এবং আশাবাদী, তাদের হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা হতাশ বা নেতিবাচক চিন্তা করা মানুষের থেকে কম। তবে এ ব্যাপারে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলেসের বিজ্ঞানীরা বলছেন, যারা ইতিবাচক বা আশাবাদী, অকারণে দীর্ঘ সময় ধরে দুশ্চিন্তা কম করে, তাদের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা, অর্থাৎ ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া ঢুকলে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নেতিবাচক, হতাশ দীর্ঘ সময় ধরে অকারণে দুশ্চিন্তা করা ব্যক্তিদের থেকে বেশি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্বল্প সময়ের দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থায় কোনো প্রভাব ফেলে না। স্বল্প সময়ের উদ্বেগ সাধারণ জীবনযাপনের অংশ।

আমাদের ভাবনার ধরন ঠিক কীভাবে আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে তার বিস্তারিত এখনো জানা যায়নি।

এটা বিজ্ঞানের নতুন শাখা—সাইকোনিউরোইমিউনোলজি। কঠিন শব্দ। মনে রাখার দরকার নেই। এই করোনাকালে আশা হারানো চলবে না। ভালো থাকতে হলে ভালো ভাবতে হবে। সম্ভব হলে অন্যের ভালো করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।

ড. সুব্রত বোস প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট
[email protected]