ভিউ চাই, ভিউ

কয়েক দিন আগে ফেসবুকে একটি বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে যায় আমার। বিজ্ঞাপনটিতে চাইল্ড মোটিভেশনাল স্পিকার বা শিশু অনুপ্রেরণা প্রদানকারী বক্তা তৈরির কোর্স অফার করা হয়েছে। বাংলাদেশের শিশুদের কত শতাংশ ফেসবুক ব্যবহার করে, সে–সংক্রান্ত কোনো পরিসংখ্যান আছে বলে আমার জানা নেই। তবে বিজ্ঞাপনের ভাষায় বুঝলাম, যে বয়সী শিশুদের এই কোর্সটির জন্য টার্গেট করা হয়েছে, তাদের ফেসবুক ব্যবহার করার সম্ভাবনা খুবই কম। তার মানে দাঁড়াচ্ছে বিজ্ঞাপনটির মাধ্যমে আকৃষ্ট করা হয়েছে শিশুর মা-বাবা কিংবা অভিভাবকদের, যারা শিশুকে মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবে তৈরি করতে উৎসাহিত হতে পারেন। এত দিন পর্যন্ত শিশুদের সুবক্তা বানানোর জন্য আবৃত্তি, গল্পপাঠ কিংবা বিতর্ক শেখানোর নানা আয়োজন লক্ষ করেছি। কিন্তু মোটিভেশনাল স্পিকার বানানোর এই ধরনের আয়োজন এর আগে আর চোখে পড়েনি। ইদানীং জনপ্রিয় হয়ে ওঠা মোটিভেশনাল স্পিকাররা নাকি অনেকের মধ্যে তাদের মতো বক্তা হয়ে ওঠার স্বপ্ন জাগাচ্ছেন। বিষয়টি যে শুধু অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তা কিন্তু নয়। লাইক, ভিউ আর সাবস্ক্রাইবের বদৌলতে মোটিভেশনাল স্পিকিং পেশা হিসেবেও দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সঙ্গে অল্প সময়ে জনপ্রিয়তা লাভের হাতছানি তো আছেই। তাই বিষয়টি কতটা অন্যের মধ্যে অনুপ্রেরণা জাগানোর তাগিদ থেকে আর কতটা নিজেকে জনপ্রিয় করে তোলার আকুতি থেকে, তা নিয়ে সন্দেহ জাগে।

২.

অনলাইনে ফুড ভ্লগারদের আধিক্য বেড়ে চলেছে বিশ্বের সর্বত্র। বাংলাদেশও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে এই সব ভিডিও। বেশিরভাগ ভিডিওতে প্রায়ই অস্বাস্থ্যকর, অতিরিক্ত ও অতিরঞ্জিত ভোজনের দৃশ্য দেখিয়ে দর্শকদের আকৃষ্ট করা হয়। ফুড ভ্লগারদের অতিরঞ্জিত খাওয়ার শব্দ, ঠোঁটের দুপাশ বেয়ে খাবার গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য, কিংবা অতিরিক্ত ঝালে আর্তচিৎকারের শব্দের মাঝে যে কী প্রশান্তি, তা একমাত্র তাঁদের ফলোয়াররাই বলতে পারবেন। তবে দিন দিন বেড়ে চলেছে এসব ফুড ভ্লগারদের ফলোয়ারের সংখ্যা। অনেকেই আজকাল নেমে পড়েছেন ফুড ভ্লগিংয়ের পেশায়। এভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে, লোক দেখিয়ে খাওয়ার উদ্দেশ্য কী নিছক খাদ্যপ্রেম, ব্যবসা নাকি শুধুই জনপ্রিয়তা লাভ করা, ঠিক বলতে পারি না। খাবার বা খাদ্যপণ্যের প্রচারণা সেক্ষেত্রে আলাদা বিষয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল বাণিজ্যের ফাঁদে ‘ভিউয়ারের’ সংখ্যাভিত্তিক বিনোদন বাড়ছে, বাড়ছে তারকাসংখ্যা। সেই সঙ্গে বাড়ছে তারকা হওয়ার স্বপ্ন আর জনপ্রিয় হওয়ার যুদ্ধ। কমছে শুধু পরিশ্রম, অধ্যবসায় আর সাধনা। নিম্নগামী হচ্ছে মানুষের রুচি আর দায়িত্বশীল আচরণ। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মান নির্ধারিত হচ্ছে ভিউ দিয়ে, সেখানে গুণগত মানের বিষয়টি থাকছে উপেক্ষিত।

৩.

দীর্ঘদিনের পরিচিত এক সহকর্মীকে ইদানীং সমাজসচেতনতামূলক বিভিন্ন ভিডিও আপলোড করতে দেখি ফেসবুকে, যেখানে কথা বলেন তিনি নিজেই। অথচ দীর্ঘ চাকরিজীবনের অভিজ্ঞতায় সমাজ গঠন কিংবা পরিবর্তন নিয়ে তার মধ্যে তেমন কোনো চিন্তাভাবনার প্রতিফলন দেখিনি কখনো। সমাজ কিংবা পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে ফেসবুক গরম করা এই ব্যক্তিটিকে নাকি কিছুদিন আগে গাড়ির জানালা দিয়ে চিপসের খালি প্যাকেট বাইরে ফেলতে দেখা গেছে। অবাক করা বিষয় হলো, যিনি নিজেই নিজের জীবনে পরিবেশ রক্ষার ন্যূনতম মৌলিক বিষয়গুলোর চর্চা করেন না, তিনি সবাইকে সচেতন করেন সমাজ ও পরিবেশ রক্ষার নানা ইস্যুতে।

মোটিভেশনাল স্পিকার, টিকটকার আর ইউটিউবাররা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে অনলাইনভিত্তিক প্রচার ও যোগাযোগমাধ্যমে। দিন দিন ভিউয়ের রাজনীতিতে বন্দী হয়ে পড়ছে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিজগৎ। এ দেশে বক্তা আছে কিন্তু কর্মী নেই; ভিউয়ার আছেন কিন্তু প্রকৃত অর্থে শ্রোতা নেই। কে বলছেন, কী বলছেন, কাকে বলছেন, কেন বলছেন, কে শুনছেন, কী শুনছেন, কেন শুনছেন এই প্রশ্নগুলোর যেন কোনো উত্তর নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল বাণিজ্যের ফাঁদে ‘ভিউয়ারের’ সংখ্যাভিত্তিক বিনোদন বাড়ছে, বাড়ছে তারকাসংখ্যা। সেই সঙ্গে বাড়ছে তারকা হওয়ার স্বপ্ন আর জনপ্রিয় হওয়ার যুদ্ধ। কমছে শুধু পরিশ্রম, অধ্যবসায় আর সাধনা। নিম্নগামী হচ্ছে মানুষের রুচি আর দায়িত্বশীল আচরণ। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মান নির্ধারিত হচ্ছে ভিউ দিয়ে, সেখানে গুণগত মানের বিষয়টি থাকছে উপেক্ষিত।

অনলাইন মাধ্যমে তারকা হয়ে ওঠা অনেকের মধ্যে লক্ষণীয়ভাবে চোখে পড়েছে চেয়ে শ্রোতাদের লাইক কিংবা সাবস্ক্রিপশন পাওয়ার বাসনা। মোটিভেশনাল স্পিকাররাও ব্যতিক্রম নন। একজন মোটিভেশনাল স্পিকার হয়ে ওঠার পথটি সহজ নয় মোটেই। এ ধরনের বক্তা হতে সবার আগে যা প্রয়োজন, তা হলো জীবন থেকে লব্ধ বা¯তব অভিজ্ঞতামিশ্রিত মেধা আর প্রজ্ঞা। পাশাপাশি প্রয়োজন সূক্ষ্ম জীবনবোধ, অন্যের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচরণ আর বক্তব্যের মাধ্যমে অন্যকে আকৃষ্ট করতে পারার অসাধারণ ক্ষমতা। ভাষা ও উপস্থাপনকৌশল যদিও–বা চর্চার মাধ্যমে আয়ত্ত করা সম্ভব, কিন্তু বক্তব্যের পূর্ণতার জন্য প্রয়োজন বাস্তব অভিজ্ঞতা ও জীবনমুখী জ্ঞান। এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু একজন শিশুও যখন অনুপ্রেরণামূলক বক্তা হিসেবে হাজির হয় এবং বক্তব্যের বিষয়বস্তু যখন শিশুতোষ না হয়, তখন সেই প্রক্রিয়ায় তার ক্ষুদ্র জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতা উপস্থাপনের সম্ভাবনা আসলে কতটুকু! ফলে সে হয়ে ওঠে বড়দের শিখিয়ে দেওয়া বুলির ওপর নির্ভরশীল একজন মুখস্থসর্বস্ব বক্তা।

আরও পড়ুন

দারুণ গোলমেলে একটা সময়ে এসে পৌঁছেছি আমরা। প্রথাগত আর প্রচলিতের সঙ্গে পরিবর্তিত নতুনের সমন্বয় ঘটাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছি আমরা। ‘ভালো মানে জনপ্রিয়’ নাকি ‘জনপ্রিয় মানেই ভালো’ এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মাঝখানে অনেক অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত বক্তব্য আর বিনোদনে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। তাই সব পক্ষ থেকে প্রয়োজন দায়িত্বশীল আচরণ। একটি ভালো কিংবা মন্দ বিষয়বস্তুকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা। তাই মন্দের প্রসারে তাঁরা তাঁদের দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। মন্দের প্রসার বন্ধে আমাদের আচরণ দায়িত্বশীল না হলে একসময় তা আমাদেরই ক্ষতির কারণ হবে। তখন হা-হুতাশ করে লাভ হবে না। অন্যদিকে যাঁরা শুধু জনপ্রিয় হওয়ার বাসনায় কিংবা তারকাখ্যাতি লাভ করার জন্য কোমর বেঁধে নেমেছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই পরিশ্রম, নিষ্ঠা আর আন্তরিকতা ছাড়া সস্তা জনপ্রিয়তা বেশি দিন টেকে না। আমরা যা বলি, তা যদি আমরা নিজেদের জীবনে অনুসরণ না করি, তবে আমাদের বক্তব্য একদিন অন্তঃসারশূন্য হিসেবে প্রমাণিত হবেই। মিথ্যা জনপ্রিয়তার পলেস্তারা খসে পড়তে সময় লাগে না। সময়ের পরিক্রমায় মিথ্যা তার জৌলুশ হারাবেই আর দিন শেষে যা সত্য ও যা সুন্দর, তা উদ্ভাসিত হবেই।

  • নিশাত সুলতানা লেখক ও গবেষক