ভিন্ন স্বরকে জায়গা দিতে হবে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

কোভিড মহামারির এই বিরাট দুর্যোগের সময়েও নাগরিকদের মতপ্রকাশের ওপর সরকারি নজরদারি অব্যাহতভাবে চলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী নাগরিকদের ওপর নজর রাখা হচ্ছে বিশেষভাবে। সেখানে নজরদারিই শেষ কথা নয়, কালাকানুন ব্যবহার করে স্বাধীন মতপ্রকাশকারী নাগরিকদের হয়রানিও করা হচ্ছে। ফেসবুকে কিছু লেখার দায়ে রাতদুপুরে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গত কয়েক দিনে পরপর কয়েকজনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামের কালাকানুনটির বিদ্বেষমূলক অপপ্রয়োগ ঘটেছে। মামলা ও গ্রেপ্তার চলেছে; উপরন্তু গ্রেপ্তারকৃত কেউ কেউ চাকরিস্থলে সাময়িকভাবে বরখাস্ত হয়েছেন।

সদ্য প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সম্পর্কে ফেসবুকে কথিত ‘আপত্তিকর’ স্ট্যাটাস লেখার অভিযোগে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক সিরাজুম মনিরাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তাঁরই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার। একজন সাবেক মন্ত্রীর বিষয়ে ফেসবুকে ‘আপত্তিকর’ স্ট্যাটাস লেখার সঙ্গে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের সংক্ষুব্ধ হওয়ার কী সম্পর্ক থাকতে পারে, তা এক ঘোলাটে প্রশ্ন। স্ট্যাটাসদাতার বিরুদ্ধে তাঁর দায়ের করা মামলাটি কী যুক্তিতে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হলো, সেটা আরও গুরুতর প্রশ্ন।

তারপর একই অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক কাজী জাহিদুর রহমানকে। অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে মামলাটি যিনি দায়ের করেছেন, তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ নন, একজন আইনজীবী। এখানেও সেই একই প্রশ্ন: প্রয়াত মন্ত্রী সম্পর্কে ফেসবুকে কেউ স্ট্যাটাস লিখল, আর তাতে সংক্ষুব্ধ হয়ে স্ট্যাটাসদাতার বিরুদ্ধে মামলা করলেন একজন আইনজীবী এবং পুলিশ সেই মামলা গ্রহণ করল—এসবের যুক্তি কোথায়?

এর আগে, গত ৬ মে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করোনাভাইরাস নিয়ে এবং সরকারের বিরুদ্ধে ‘গুজব’ ছড়ানোর অভিযোগে লেখক মুশতাক আহমেদ ও কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়।

প্রাতিষ্ঠানিক সংবাদমাধ্যমে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিংবা প্রকাশিত বইপত্রসহ অন্যান্য মাধ্যমে প্রকাশিত যেকোনো মতের বিরুদ্ধে পাল্টা মত থাকতে পারে। কেউ ফেসবুকে কিছু লিখলে তার প্রতিবাদে অন্য কেউ নিজের মত ব্যক্ত করতে পারেন, যুক্তি তুলে ধরতে পারেন। সেটাই সভ্য সমাজের রীতি। কিন্তু আমাদের দেশে এসব ক্ষেত্রে মামলা দায়ের করা হয়, সেসব মামলার যুক্তি আছে না নেই, তা খতিয়ে না দেখেই গ্রহণ করা হচ্ছে এবং মামলা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এভাবে যাঁরা দমনপীড়নের শিকার হচ্ছে, তাদের ভিন্নমতকে দেখা হচ্ছে সরকারবিরোধিতা হিসেবে। কিন্তু সরকারের সমালোচনা করা যাবে না, এমন তার রাজনৈতিক মতামতের বিরোধী মত প্রকাশ করা যাবে না—এমন কোনো আইন এ দেশে নেই। থাকলেও সে রকম আইন হতো আমাদের সংবিধানের পরিপন্থী। কারণ, সংবিধানে প্রত্যেক নাগরিকের বাক্‌ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে।

নাগরিকদের বাক্‌স্বাধীনতার বিষয়গুলো যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখতে পাই, সরকারের অবস্থানের বিপরীতে কোনো কণ্ঠ শুনতে, মানতে কিংবা প্রচার জারি রাখতে তারা রাজি নয়। বরং সমালোচনাকারী বা বিরোধী মতপ্রকাশকারীদের কণ্ঠ রুদ্ধ করার চেষ্টা অবিরাম চলছে। কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা কণ্ঠরোধের সেই প্রচেষ্টাকে মদদ দিয়ে থাকেন। কিন্তু বিষয়টি এর উল্টো হওয়ার কথা। কেন? বিশ্ববিদ্যালয় কী, কেন একটি দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বুঝলে আমরা বিষয়টি ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করতে পারব।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় থেকে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার ফাটলগুলো নিয়ে আলোচনা করে এসেছে, রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কিন্তু বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য-আদর্শ থেকে অনেকটাই সরে গেছেন। তাঁদের অনেকের এখন পরিচয় সরকারের অনুগত সেবক হিসেবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে না থেকে সরকারকে খুশি করার চেষ্টা করে চলে। রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের মামলা করার ঘটনাটিকে সে রকমই একটি দৃষ্টান্ত।

এমনিতে অদৃশ্য করোনার আতঙ্কে সবাই তটস্থ। তার মধ্যে চলছে নাগরিকদের কণ্ঠরোধের জন্য কালাকানুনের অপব্যবহার। মামলা, গ্রেপ্তার, হয়রানির পাশাপাশি রয়েছে চাকরি হারানোর ভয়। আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারার পরে এসেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামের কালাকানুন। এই আইনের অপব্যবহার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এসব বন্ধ করা উচিত। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। আইনটি বাতিল করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকারকে বুঝতে হবে, ভিন্নমত বা সমালোচনায় সরকারের ‘ভাবমূর্তি’ ক্ষুণ্ন হয় না; বরং কণ্ঠরোধের চেষ্টার ফলেই তা ঘটে এবং দেশ ও সমাজ পিছিয়ে যায়।

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: [email protected]