ভুটানের সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য: প্রতীকী তাৎপর্য বেশি

৬ ডিসেম্বর ভুটানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত হয়েছে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে এবং ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ডা. লোটে শেরিং সে দেশের রাজধানী থিম্পু থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন
ছবি: পিআইডি

অবশেষে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির জগতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবেশ করল। ৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ভুটানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত হলো অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট বা পিটিএ)। এটি অবশ্য পুরোপুরি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নয়, বরং বলা যায় এফটিএর আগের ধাপ বা আংশিক এফটিএ। কেননা, এ চুক্তির আওতায় এখন বাংলাদেশ ভুটানে ১০০টি পণ্যে ও ভুটান বাংলাদেশে ৩৪টি পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে। পরে দুই দেশ আরও পণ্যকে শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় আনবে। সাধারণত গতানুগতিক এফটিএতে প্রায় শতভাগ বা বেশির ভাগ পণ্যকেই শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়। অল্প কিছু পণ্যকে স্পর্শকাতর (সেনসেটিভ) বিবেচনায় এ সুবিধার বাইরে রাখা হয়। তবে হাল আমলে এফটিএতে শুধু পণ্য নয়, বরং সেবা খাতও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

বাংলাদেশ অনেক বছর ধরেই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (বিএফটিএ) করার জন্য চিন্তা করছে। এ নিয়ে গত দুই দশকে কম আলাপ-আলোচনা, সভা-সেমিনার, গবেষণা-বিশ্লেষণ হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যনীতিতে এফটিএ যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিভিন্ন উন্নত দেশে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি কিছু উন্নয়নশীল দেশেও শুল্কছাড় ও আংশিক শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে আসছে। এর বিপরীতে তেমন কোনো ছাড় দিতে হয়নি। তবে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণের সময় ঘনিয়ে আসায় একতরফাভাবে বাজারসুবিধা পাওয়ার দিনও ফুরিয়ে আসছে। সে কারণেই ইদানীং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এফটিএ করার তাগিদ বেড়েছে।

স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিভিন্ন উন্নত দেশে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি কিছু উন্নয়নশীল দেশও শুল্কছাড় ও আংশিক শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে আসছে। এর বিপরীতে তেমন কোনো ছাড় দিতে হয়নি। তবে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণের সময় ঘনিয়ে আসায় একতরফাভাবে বাজারসুবিধা পাওয়ার দিনও ফুরিয়ে আসছে। সে কারণেই ইদানীং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এফটিএ করার তাগিদ বেড়েছে

এ অবস্থায় ভুটানের সঙ্গে পিটিএ করার মধ্য দিয়ে একটা অচলায়তন ভাঙার কাজ প্রতীকীভাবে শুরু হবে বলে ভাবতে কোনো অসুবিধা নেই। যদিও বছর তিনেক আগে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে এফটিএ করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছিল এবং সে অনুযায়ী কাজ অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। তারপর কোনো এক কারণে তা থমকে যায়। এদিকে নেপাল ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে পিটিএ জুন মাসের মধ্যে হতে পারে বলে জানা গেছে। আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গেও পিটিএ বা এফটিএ নিয়ে আলোচনা চলছে।

এটা স্পষ্ট যে যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ স্বল্প এবং যেখানে বাজার বাড়ানোর সম্ভাবনা সীমিত, সেসব দেশের সঙ্গে পিটিএ বা এফটিএ করে রপ্তানি বাড়ার ও পণ্য আমদানি সহজলভ্য হওয়ার সুযোগও কম। এসব দেশের সঙ্গে পিটিএ বা এফটিএ করার মাধ্যমে সমঝোতার একটা সক্ষমতা অর্জন হবে ও অভিজ্ঞতা বাড়বে, যা বড় পরিসরে দর–কষাকষির জন্য সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।

কিন্তু মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা এগিয়ে নিতে গিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা রক্ষণশীল বা ছাড় না দেওয়ার বাণিজ্যনীতি থেকে সরে আসাটা খুব সহজ হচ্ছে না। স্থানীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে একটি পক্ষ আমদানি শুল্ক কমানোর বিরোধিতা করে। রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) একই রকম অবস্থান নেয়। সম্প্রতি এনবিআর রাজস্বের ওপর এফটিএর সম্ভাব্য অভিঘাত বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে যে অভিমত জানিয়েছে, তাতে এ মনোভাবই স্পষ্ট হয়েছে। সংবাদপত্রে (দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ১৯ নভেম্বর ২০২০) প্রকাশিত খবর অনুসারে, যেসব দেশের সঙ্গে বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি আছে, তাদের সঙ্গে এফটিএ না করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দিয়েছে দেশের রাজস্ব কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই চলে আসবে চীন ও ভারতের কথা। এ দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য ঘাটতি—বলা যায় মোট বাণিজ্য ঘাটতির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। দেশ দুটোয় যেটুকু পণ্য রপ্তানি করা হয়, তার কয়েক গুণ বেশি পণ্য তাদের থেকে আমদানি করা হয়।

এনবিআর আরও বলেছে যেকোনো মুক্ত বাণিজ্য আলোচনায় রাজস্ব আয়ের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে। কেননা, দেশের মোট রাজস্ব আয়ের প্রায় ১১ শতাংশ আসে সরাসরি আমদানি শুল্ক থেকে। এর সঙ্গে আরও আছে আমদানিজনিত মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), নিয়ন্ত্রণমূলক কর (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) ও আগাম আয়কর। এফটিএ হলে প্রথমেই যেহেতু শুল্কহার কমাতে বা শূন্য করতে হবে, সেহেতু তা আমদানি শুল্ক থেকে রাজস্ব আদায় কমাবে।

তাহলে প্রশ্ন হলো আমদানি শুল্ক না কমিয়ে বা বাণিজ্য ঘাটতি না বাড়িয়ে কি এফটি করা সম্ভব? প্রাথমিকভাবে তা সম্ভব নয়। তবে আমদানি শুল্কজনিত ক্ষতি বা বাড়তি ঘাটতি অর্থায়নের চাপ দীর্ঘ মেয়াদে পূরণ করে নেওয়া যায়, যদি এফটিএকে ঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়। কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি ব্যয় কমে গিয়ে তা দেশের ভেতরে ও রপ্তানিমুখী পণ্যের উৎপাদনের ব্যয় কমিয়ে দেবে। ফলে এসব পণ্য অধিক প্রতিযোগিতা সক্ষম হবে, যা রপ্তানি বাড়াতে সহায়ক হবে। আবার এফটিএ অংশীদার দেশেও আমদানি শুল্ক কমে গিয়ে সেখানে বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশ সহজতর হবে।

তা ছাড়া শুধু এফটিএতে এখন আর শুধু শুল্কহার মুখ্য নয়। পণ্যের উৎসবিধি তো আছেই, আরও যোগ হয়েছে পণ্যের গুণগত মানের বিষয়, আছে মেধাস্বত্বের বিষয়। এ ছাড়া বাণিজ্য সহজীকরণ (ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে কম সময়ে পণ্য খালাসকরণ), বিদেশি বিনিয়োগ ও সরকারি ক্রয়ের মতো বিষয়গুলো ক্রমে যুক্ত হচ্ছে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে। সর্বোপরি, করোনাভাইরাসের আঘাতে দুনিয়াজুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের জগতেও প্রচলিত চিন্তাভাবনার পরিবর্তন আসছে। সুতরাং অর্থবহ এফটিএ করার জন্য শুধু শুল্ক নিয়ে দর–কষাকষি করলে ও অংশীদারকে যথেষ্ট ছাড় না দিলে কাঙ্ক্ষিত ছাড় মিলবে না।

আসজাদুল কিবরিয়া সাংবাদিক

[email protected]