ভূমধ্যসাগরে ডুবছে ইউরোপীয় মানবাধিকার

আফ্রিকার যুদ্ধপীড়িত অঞ্চলের ছন্নছাড়া মানুষের চোখের জলে ভূমধ্যসাগরের লোনা জল আরও লবণাক্ত হলো। একটু সচ্ছল, একটু ভালো জীবনের আশায় সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ১৯ এপ্রিল এই সাগরের উত্তাল জলে তলিয়ে গেল কয়েক শ মানুষ।
১৯৮৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ২৫ বছরে ১৯ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে। আর গত রোববার মধ্যরাতে ডুবে যাওয়া জাহাজটিতে অন্তত ৯০০ যাত্রীর মধ্য মাত্র ২৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে আর বাকি সবারই প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতালির কোস্টগার্ড ও বেঁচে যাওয়া এই অভিবাসীরা বলছেন, লিবিয়ার উপকূল থেকে মাত্র ১৭ মাইল দূরে ওই নৌযানটি ডুবে যায়। দুর্ঘটনার স্থানটি ইতালির লাম্পেদুসা দ্বীপের প্রায় ১৩০ মাইল দক্ষিণে। নৌযানটি ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি লোক নিয়ে ইতালি অভিমুখে যাওয়ার পথে রোববার মধ্যরাতে জাহাজটির পাশ দিয়ে একটি বড় বাণিজ্যিক জাহাজ যাওয়ার সময় এই বিপত্তি ঘটে।
ভূমধ্যসাগরের উত্তরাংশ ঘিরে রয়েছে ইউরোপ মহাদেশের স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, গ্রিস প্রভৃতি দেশ আর দক্ষিণাংশে রয়েছে আফ্রিকা মহাদেশের মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, মিসর প্রভৃতি দেশ। ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ পারের আফ্রিকান দেশগুলোর উপকূলগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার থাকলেও কেবল লিবিয়ায় ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল গাদ্দাফি সরকারের পতন হওয়ার পর থেকে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। আর সেই সুযোগে মানব পাচারকারীরা বিগত বছরগুলোতে লিবিয়ার দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে আসা ইরিত্রিয়া, সোমালিয়া, সুদান, মালিসহ সিরিয়া, মিসর ও এশিয়ার আরও কিছু দেশের অভিবাসীদের ন্যূনতম ২০০ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে ভঙ্গুরপ্রায় জাহাজে করে ইতালির উপকূলে এনে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
২০১৩ সালের অক্টোবর মাসেও এ ধরনের একটি মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটে, সেবার ইতালির লাম্পেদুসা দ্বীপের উপকূলরক্ষীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আফ্রিকার গৃহযুদ্ধকবলিত দেশ সোমালিয়া ও তানজানিয়ার প্রায় ৫০০ আশ্রয়প্রার্থীকে বহন করা জাহাজটিতে একটি কম্বলে আগুন দিলে তা দ্রুত নৌকাটিতে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর নৌকার সব যাত্রীই ভূমধ্যসাগরের শীতল জলে ঝাঁপ দিলে প্রায় ২৭০ জন যাত্রীর সলিলসমাধি ঘটে, ১৫৫ জনকে উদ্ধার করা গেলেও বাকি প্রায় ২০০ আশ্রয়প্রার্থীর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
ভূমধ্যসাগরের লিবিয়া উপকূলে কয়েক শ অভিবাসী নিয়ে ডুবে যাওয়া নৌযান থেকে জীবিত উদ্ধার হওয়া যাত্রীদের মধ্যে একজন বাংলাদেশিও আছেন। ওই বাংলাদেশিকে হেলিকপ্টারে করে উদ্ধার করে এনে সিসিলি দ্বীপের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি পুলিশকে জানিয়েছেন, নৌযানটিতে সাড়ে নয় শ আরোহী ছিলেন। ঘটনার সময় তাঁদের অনেকেই নৌযানটির মালামাল রাখার জায়গায় তালাবদ্ধ অবস্থায় ছিলেন।
বাংলাদেশি ওই অভিবাসীর কাছ থেকে ইতালির কাতানিয়ার রাষ্ট্রীয় কৌঁসুলিরা জানতে পেরেছেন, লোকে ঠাসা নৌযানটি দুই দিন ধরে সাগরে মোটামুটি ঠিকঠাক ভাসলেও শনিবার মধ্যরাতে পাশ দিয়ে একটি বাণিজ্যিক জাহাজ যাওয়ার সময় বিপত্তি ঘটে। কারণ, জাহাজটিকে দেখামাত্রই লোকজন নৌযানটির সেদিকে ভিড় করেন। এতে করে এক দিকে কাত হয়ে ডুবতে শুরু করে সেটি। এ সময় অনেকে বাঁচার আশায় সাগরে ঝাঁপ দেন। এতে তাঁদের বাঁচার আশা আরও ক্ষীণ হয়ে পড়ে। নৌযানটিতে বাংলাদেশি ছাড়াও আলজেরিয়া, মিসর, সোমালিয়া, নাইজার, সেনেগাল, মালি, জাম্বিয়া ও ঘানার নাগরিকেরা ছিলেন।
ভূমধ্যসাগর দিয়ে কয়েক দশক ধরেই এভাবে অভিবাসীরা বিপজ্জনকভাবে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টা করছেন। ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়া সংকটের জের, আফ্রিকান দেশগুলোতে জাতিগত হাঙ্গামার জের ধরে সাম্প্রতিক সময়ে এভাবে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের দেশগুলোতে যাওয়ার ঘটনা বেড়েছে। বিশেষ করে, বছরের এই সময়ে সাগর কিছুটা শান্ত থাকায় বিভিন্ন আকারের ঝুঁকিপূর্ণ নৌযানে করে কয়েক শ মাইল দূরের ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন অভিবাসীরা।
ভূমধ্যসাগরে নৌযানডুবিতে শত শত অভিবাসীর প্রাণহানির ঘটনায় গত সোমবার লুক্সেমবার্গে জরুরি বৈঠক করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা। বৈঠকে ভূমধ্যসাগর এলাকার অভিবাসী সংকট লাঘবে ১০ দফাসংবলিত এক কর্মপরিকল্পনা পেশ করা হয়। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনও অভিবাসী সংকট মোকাবিলায় ইউরোপকে আরও আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানান। বৈঠকের আগে ইইউর পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান ফেডারিকা মোঘারিনি বলেছিলেন, ‘এই ট্র্যাজেডির পর ইইউর আর কোনো অজুহাত নেই। ইইউ ও এর সদস্যদেশগুলোকে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ বিষয়ে ভূমিকা পালনে আমাদের একটি রাজনৈতিক ও নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। ভূমধ্যসাগর আমাদেরই একটা সাগর। ইউরোপীয় হিসেবে আমাদের একসঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে।’
ইউরোপীয় রাজনীতি, যত মানবিকতা আর মানুষের অধিকার সুরক্ষার কথাই বলুক না কেন, তাদের নিজ ভূখণ্ডে আশ্রয়প্রার্থী মানুষের জন্য এই মানবিকতা, আইন আর নিরাপত্তার বেষ্টনে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। ব্যাপারটি এই রকম যুদ্ধদুর্গত–পীড়িত দেশসমূহে নিপীড়িত ব্যক্তিদের অল্পবিস্তর সহযোগিতা করতে হবে কিন্তু মূলত ইউরোপীয় সীমান্ত এই অযাচিত অভিবাসীদের জন্য বন্ধ রাখতে হবে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জাতিগত বৈষম্যের কারণে প্রতিদিন শত শত মানুষ নিজ ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে আর এই মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে প্রায় চার কোটি শরণার্থীদের ৮০ শতাংশ মানুষ দুর্গত অঞ্চলের প্রতিবেশী দেশসমূহেই আশ্রয় নিয়েছে। বলাই বাহুল্য এই আশ্রয়দাতা দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশসমূহ, নিজেদের শত সমস্যার মাঝে নিরাশ্রয় বিপদাপন্ন ব্যক্তিদের আশ্রয় দিয়েছে।
আর দুই বছর আগে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত ইউরোপ মানবিকতাকে ভূলুণ্ঠিত করে সামান্য কিছু আশ্রয়প্রার্থী মানুষের সমুদ্রপথ দিয়ে আসা ঠেকাতে নতুন নতুন প্রযুক্তি আর আইন তৈরি করছে।
একদিকে মানবিকতা, মানবাধিকার আর সহমর্মিতা এবং অন্য দিকে যুদ্ধকবলিত অঞ্চলে দেদার অস্ত্র ব্যবসা, যেহেতু নিজ অঞ্চলে এই মারণাস্ত্রের প্রয়োগ নেই বা যুদ্ধের কারণে মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা নেই, তাই এই মারণাস্ত্র বানাতে আর বেচতে অসুবিধা কোথায়—ইউরোপের এই দ্বিমুখী আচরণ নিয়ে কথা উঠেছে।
ইউরোপের মুক্তবুদ্ধির মানুষ এবং সংবাদমাধ্যমগুলো ভূমধ্যসাগরের এই অমানবিক মৃত্যুর ঘটনার জন্য ইউরোপীয় অভিবাসী নীতির কঠোর সমালোচনা করছে, কিন্তু ইউরোপীয় মানবাধিকারের বারবারই সলিলসমাধি ঘটছে ভূমধ্যসাগরের লোনা জলে।
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি।
[email protected]

আরও পড়ুন