ভূমিহারা সাঁওতাল জাতি ও ভূমির অধিকার

সাঁওতালসহ অনেক ক্ষুদ্র জাতিসত্তা আছে, যাদের কাছে ভূমি কেনাবেচার বিষয় নয়
সাঁওতালসহ অনেক ক্ষুদ্র জাতিসত্তা আছে, যাদের কাছে ভূমি কেনাবেচার বিষয় নয়

এক সমাজের সঙ্গে অন্য সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে ভূমি বা জমিজমা অনেকের কাছে কেনাবেচা বা বিনিয়োগের জন্য লাভজনক একটা ‘পণ্য’ হিসেবে গণ্য হলেও, সাঁওতাল বা খাসি, গারোসহ অন্য যেসব ক্ষুদ্র জাতিসত্তা আছে, তাদের কাছে ভূমি বা জমি কেনাবেচার জিনিস নয়৷ ভূমি তাদের অস্তিত্বের বিষয়৷ এ কারণে তাদের ভূমির কোনো ব্যক্তিমালিকানা হয় না, প্রকৃতিমাতার ভূমি সমাজের বা গোত্রের ‘যৌথ মালিকানা’ হিসেবে স্বীকৃত৷ এ কারণে রাষ্ট্রের সাধারণ ভূমি আইনে সংজ্ঞায়িত বা লিপিবদ্ধ বিধিবিধান তাদের কাছে সব সময় থাকে দুর্বোধ্য৷ ফলে নিজেদের ভূমিতে তারা হয়ে যায় অবৈধ৷

২.

বাঙালি ছাড়াও দেশের অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ভূমি৷ জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিপদ বা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের ভূমি, ভূমির ওপর সম্পদ বা তাদের প্রথাগত ভূমির অধিকার৷ দেশের পূর্বাঞ্চল থেকে উত্তরাঞ্চল বা পার্বত্য অঞ্চল—সব ক্ষেত্রে দেখা গেছে ভূমিই তাদের জন্য সমস্যা ডেকে এনেছে৷ অথচ এটা হওয়ার কথা ছিল না৷ দেশের প্রত্যেক নাগরিকের ভূমি থাকা তার একটি মৌলিক অধিকার৷ তার ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব৷ বস্তুত সে লক্ষ্যেই প্রজাস্বত্ব আইন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে একক মালিকানায় নির্দিষ্ট পরিমাণের অধিক ভূমি না থাকার বঙ্গবন্ধুর নেওয়া ব্যবস্থার উদ্দেশ্যও ছিল ভূমিহীন বা সব নাগরিকের ভূমির মালিকানা বা অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করা৷ অথচ অবস্থা দাঁড়িয়েছে সম্পূর্ণ উল্টো৷ স্বল্প পরিমাণ ভূমি, যেটা তাদের অস্তিত্বের বিষয়, তাদের সে ভূমি বিভিন্ন অবস্থায় বা কারণে হারাতে হচ্ছে৷ বাজার অর্থনীতি, শিল্পায়ন, উন্নয়ন ইত্যাদি তাদের ভূমি অধিকারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে৷ জাতিগত সংখ্যালঘু নারীরা ভূমির ব্যবহারের ক্ষেত্রে সমানভাবে সক্রিয়। ফলে নারীদের ওপর এর সরাসরি প্রভাব পড়ে এবং নারীর ওপর তার প্রভাব মানে পরিবার তথা শিশুদের ওপর প্রভাব৷

৩.

সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতির বাইরে অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভূমি অধিকার বা মালিকানাকে আইন বা বিধিবিধানের মাধ্যমে যুগোপযোগী করা, আইন সংশোধনের মাধ্যমে তাদের পূর্বপুরুষদের প্রথাগত ভূমির ওপর মালিকানা বা অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা বা স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে বহু রাষ্ট্র এগিয়ে গেলেও আমাদের কোনো উন্নতি নেই৷ প্রতিবেশী দেশ ভারতে সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিলের মাধ্যমে ভূমি অধিকারের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক রক্ষাকবচ থাকার পরও বনে বসবাসকারী বাসিন্দাদের বনভূমির ওপর তাদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত
করে মালিকানা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ‘ফরেস্ট অ্যাক্ট ২০০৬’ নামে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে৷ বাংলাদেশের মতো অস্ট্রেলিয়ার
মোট জনসংখ্যার মাত্র তিন ভাগ সে দেশের আদিবাসী। দেশের মোট ভূখণ্ডের বিশাল পরিমাণ ভূমির ওপর সে দেশের আদিবাসীদের মালিকানা স্বীকৃত৷ তাতে কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কোনো ক্ষতি হয়নি৷ শুধু সরকার নয়, দেশে দেশে সর্বোচ্চ আদালত সহায়ক বা পরিপূরক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভূমির ওপর সংখ্যালঘু ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের অধিকারের বিষয়টি আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেছেন৷

ভূমির ওপর অধিকারের বিষয়ে কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ার সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের ফলে কানাডার ‘এবরিজিনাল টাইটেল’ এবং অস্ট্রেলিয়ার ‘নেটিভ টাইটেল’, ‘লিগ্যাল ডকট্রিন’ প্রতিষ্ঠিত করেছে৷ অনুরূপভাবে মালয়েশিয়ার হাইকোর্ট সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষের বসবাসরত ভূমির ওপর তাদের আইনি অধিকার আছে৷ কেনিয়ার ‘ওজিয়েক’, বতসোয়ানার ‘বাসারওয়া সান’ মানুষের তাদের ঐতিহ্যগত ভূমি থেকে সরিয়ে ‘গেম রিজার্ভ’ প্রতিষ্ঠা করা আদালতের রায়ে ছিল সম্পূর্ণরূপে বেআইনি৷ দক্ষিণ আফ্রিকা, পেরুসহ অন্যান্য অনেক দেশের সর্বোচ্চ আদালত এবং সাংবিধানিক আদালতের মাধ্যমে জাতিসত্তাগুলো তাদের হারানো ভূমির ওপর অধিকার ফিরে পেয়েছে৷ বেলিজ হাইকোর্ট ‘মায়া’ আদিবাসীদের ভূমির ও সম্পত্তির অধিকার স্বীকৃতি ও সংরক্ষণ করতে সরকারকে
আদেশ দিয়েছেন৷

আন্তর্জাতিক আদালত ইন্টার আমেরিকান কোর্ট নিকারাগুয়ার সরকারকে ‘আওয়াস তিঙ্গি’ আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ও প্রথাগত ভূমি, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং পরিবেশের ওপর অধিকারের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনসহকারে তাদের ভূমি অধিকার সংরক্ষণ করতে আদেশ প্রদান করেছেন৷ পেরুর কংগ্রেস সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত দিয়েছে, জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষের সম্মতি ছাড়া তাদের ভূমিতে কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা যাবে না৷ আদালতের এ সিদ্ধান্তসমূহ বস্তুত সংখ্যালঘু ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর ভূমির ওপর তাদের বিশেষ অধিকারের বিষয়টিকে জোরালোভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে৷

পিডিশন প্রধান: সভাপতি, বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী ফোরাম।