ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ঘুঁটি আয়া সোফিয়া ও এরদোয়ানের উচ্চাভিলাষ

জাদুঘর হিসেবে ব্যবহারের সময় আয়া সোফিয়ার ভেতরের দৃশ্য। ছবি: এএফপি
জাদুঘর হিসেবে ব্যবহারের সময় আয়া সোফিয়ার ভেতরের দৃশ্য। ছবি: এএফপি

তুরস্কের নোবলে বিজয়ী লেখক ওরহান পামুক মন্তব্য করেছেন তুরস্ক আর ধর্মনিরপেক্ষ রইল না। ১৮০০ বছরের পুরোনো গির্জা আয়া সোফিয়াকে পুনরায় মসজিদে পরিণত করার প্রতিক্রিয়ায় পামুক এই মন্তব্য করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে তুরস্ক কি আদৌ কখনো ধর্মনিরপেক্ষ ছিল? আধুনিক তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্ক এক জোরপূর্বক রক্তাক্ত প্রক্রিয়ায় তুরস্ককে আধুনিক ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশে পরিণত করেছিলেন। যে কারণে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষ ও ইসলামপন্থীদের লড়াই বা দ্বন্দ সব সময়ই সক্রিয় ছিল। এ ধরনের রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ বলা যায় না। জোরপূর্বক ধর্মনিরপেক্ষতা তুরস্কের সমাজে যে অবদমনের সৃষ্টি করেছিল তার অবশ্যসম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে আয়া সোফিয়াকে আবারও মসজিদ হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত।

এশিয়া মাইনরে অবস্থিত বাইজান্টিয়ুন শহর কনস্টান্টিনোপোল বা ইস্তাম্বুল অনেকবার হাতবদল হয়েছে। অস্থিতিশীল এক ভূখণ্ডের নাম এশিয়ার মাইনর। আয়া সোফিয়াকেই শাসকেরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। এশিয়া মাইনর নিয়ে ইউরোপীয় ও এশীয়দের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। প্রাক্‌ ইসলামিক সময়ে ওই অঞ্চলের দখল নিয়ে নানা সময়ে যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে। ইসলামিক খিলাফত প্রতিষ্ঠার পর এই দ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা লাভ করে। আনাতোলিয়া বা এশিয়া মাইনরের দখল নিয়ে গ্রিক ও রোমানদের সঙ্গে পারস্য, আরব ও সেলজুকরা একাধিক যুদ্ধে করেছে। ১৩ শতকের দিকে মোঙ্গলরাও আনাতোলিয়া আক্রমণ করে সেলজুকদের পরাজিত করেছিল। সর্বশেষ অটোমানরা ১৫ শতকে কনস্টান্টিনোপোল দখল করে ইস্তাম্বুল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।

রোমান সম্রাট কনস্টানটাইন দ্য গ্রেট ৩২৪ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট লিনিসিয়ুসকে পরাজিত করে রোমান সাম্রাজ্যের একাধিপতি হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি বসফরাসের ঠিক মুখে আয়া সোফিয়া গির্জা নির্মাণের নির্দেশ দেন। সম্রাট দ্বিতীয় কনস্টানটাইন ৩৬০ সালে আয়া সোফিয়ার উদ্বোধন করেন। রোমানদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও দাঙ্গায় ৪০৪ খিষ্টাব্দে সম্রাট আক্রেডিউসের আমলে ভস্মীভূত হয় আয়া সোফিয়া। সম্রাট দ্বিতীয় থিওডিসিয়ুস ৪০৫ সালে আবারও গির্জাটি পুনর্নির্মাণ করেন। তবে এটা আবারও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট জাস্টিনিয়ানের বিরুদ্ধে নিকা বিদ্রোহের সময়। ওই সময় বিদ্রোহীরা কনস্টান্টিনোপোলের অর্ধেক আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিল। জাস্টিনিয়ান আয়া সোফিয়া পুনরায় নির্মাণের নির্দেশ দেন এবং ৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ সম্পন্ন হয়। এরপর অটোমানদের হাতে কনস্টান্টিনোপোলের পতন পর্যন্ত আয়া সোফিয়া কখনো ক্যাথলিক, কখনো অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। গির্জার পাশাপাশি পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন রাজকীয় ও প্রশাসনিক অনুষ্ঠান এখানে উদ্‌যাপিত হতো। অটোমান সম্রাট দ্বিতীয় মেহমেত ১৪৫৩ সালে ৫৩ দিন অবরুদ্ধ করে রাখার পর আয়া সোফিয়া গির্জা দখল করেন এবং মসজিদে রূপান্তর করেন। ১৯৩৪ সালে অটোমান খিলাফত বাতিলের পর কামাল আতাতুর্ক আয়া সোফিয়াকে জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করেন।

দেখা যাচ্ছে এশিয়া মাইনর বা আনাতোলিয়াকে নিয়ে এশিয়া ও ইউরোপের দ্বন্দ্ব একসময় রোমান সাম্রাজ্য ও অটোমানদের মধ্যে আয়া সোফিয়াকেন্দ্রিক হয়ে দাঁড়ায়। আয়া সোফিয়ার পতন ও একে মসজিদ হিসেবে ব্যবহার করা ইউরোপীয়দের জন্য পীড়াদায়ক ও অস্বস্থিকর ছিল। আবার ক্রুসেডসহ বিভিন্ন সময় প্রশাসনিক কেন্দ্র বা ক্রুসেডারদের আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করা আয়া সোফিয়া দখল করতে কৌশলগত কারণে মরিয়া ছিল অটোমানরা। হাতছাড়া হওয়া আয়া সোফিয়া ফিরে পেতে ইউরোপীয়রা বরাবরই চেষ্টা করেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপীয়দের সামনে সেই সুযোগ এনে দেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লুজান চুক্তি অনুসারে অটোমানদের সাম্রাজ্য বিলুপ্ত করা হয়। আনাতোলিয়া বা বর্তমান তুরস্কের বাইরের ভূখন্ডের ওপর তুরস্কের অধিকার রহিত করা হয়। এটা ঠিক কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের বর্তমান ভূখণ্ডকে সম্মিলিত ইউরোপীয় আক্রমণ থেকে উদ্ধার করেছিলেন। বিনিময়ে তিনি অনেক শর্তের সঙ্গে আয়া সোফিয়াকে খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের হাতে ফিরিয়ে না দিলেও জাদুঘরে পরিণত করেন।

কিন্তু মসজিদ হিসেবে আবারও ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে রিসেপ এরদোয়ান আয়া সোফিয়াকেন্দ্রিক দ্বন্দ্বকে উসকে দিলেন। তুরস্কের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, ১৯২৩ সালে সম্পাদিত লুজান চুক্তি ও আয়া সোফিয়ার মসজিদে রূপান্তর—পরস্পর গভীরভাবে সম্পর্কিত। তুরস্কের সাম্প্রতিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে এরদোয়ানের দল পরাজিত হয়েছে। ইস্তাম্বুলে প্রথমবার পরাজিত হওয়ার পর নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ করে এরদোয়ানের দল। পুনর্নির্বাচনে আবারও পরাজিত হয়। করোনা সংকট, মুল্যস্ফীতি, বেকারত্ব বৃদ্ধি নানা কারণে এরদোয়ানের জনপ্রিয়তা কমেছে। ইসলামপন্থীদের সমর্থনও এরদোয়ান হারাচ্ছিলেন। একসময়ের রাজনৈতিক গুরু নাজিমুদ্দিন এরবাকানের অনুসারীরা এখন বরং এরদোয়ানের বড় শত্রু। এরদোয়ানের দুই ঘনিষ্ঠ সহচর আবদুল্লাহ গুল ও আহমেত দাভুতওগলু নতুন দল গঠন করছেন। এই দুইজন রক্ষণশীল সমর্থকদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। রক্ষণশীলদের আস্থায় আনতে এরদোয়ান আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরের কৌশল অবলম্বন করেছেন।

খেয়াল করার বিষয় হচ্ছে ক্ষমতায় আসার পর দীর্ঘ সময় এরদোয়ান আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পরিণত করার দাবি মেনে নেননি। বরং এরদোয়ানের যুক্তি ছিল, আয়া সোফিয়ার কাছেই সুলতান আহমেত মসজিদ আছে। কিন্তু ইন্তানবুলের মেয়র নির্বাচনের প্রচারণায় তিনি আয়া সোফিয়াকে মসজিদ করার ঘোষণা দেন। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দেওয়ায় প্রতিশোধ নিতে তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জেরুজালেম একসময় তুর্কি সাম্রাজ্যেরই অংশ ছিল। জেরুজালেম হারানোর শোক তিনি আয়া সোফিয়া দিয়ে ঢেকে দিয়ে ভোটের মাঠে নিজের অবস্থানকে সংহত করতে চাইছেন। অবস্থা বুঝে তিনি আগাম নির্বাচনও ঘোষণা করতে পারেন। কারণ এরদোয়ান যেকোনো মূল্যে ২০২৩ সালে ক্ষমতায় থাকতে চাইছেন।

ওদিকে ২০২৩ সালে লুজান চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। এই চুক্তিতে যেমন স্বাধীন তুরস্কের স্বীকৃতি দেওয়া হয়, আবার স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্কের অনেক অধিকারও রহিত করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বসফরাস প্রণালি দিয়ে কৃষ্ণসাগরে চলাচলকারী বিদেশি জাহাজ থেকে কোনো ধরনের কর বা শুল্ক আদায়ের অধিকার তুরস্কের নেই। এ ছাড়া ইজিয়ান সাগরেও তুরস্কের অধিকার সীমিত করা হয়েছে। ১০০ বছর মেয়াদি লুজান চুক্তি শেষ হলে তুরস্ক শর্তগুলো আর অনুসরণ করতে না–ও পারে। ইতিমধ্যেই এরদোয়ান হাঁকডাক শুরু করে দিয়েছেন। এই অবস্থায় পশ্চিমারা চাইছে ২০২৩ সালের আগেই তুরস্কের ক্ষমতায় পরিবর্তন করে অনুগত কাউকে আনতে, যে লুজান চুক্তির শর্ত মেনে চলবে বা নতুন করে চুক্তি স্বাক্ষর করবে। এর লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। ২০১৬ সালে এক শক্তিশালী ক্যু দমন করেছেন এরদোয়ান। আবদুল্লাহ গুল ও আহমেত দাভুতওগলুর সঙ্গে আংকারার মার্কিন দূতাবাস ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অফিসের সম্পর্ক ভালোই যাচ্ছে।

এরদোয়ান হয়তো ধরেই নিয়েছেন, তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হতে পারবে না। তাই আয়া সোফিয়াকে পুঁজি করে এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি শিকার করতে চাইছেন। প্রথমত, ইসলামপন্থীদের হারানো সমর্থন পুনরুদ্ধার করা। করোনা মোকাবিলায় ব্যর্থতা, অর্থনৈতিক মন্দাকে আড়াল করা এবং আয়া সোফিয়াকে নিয়ে পশ্চিমাদের সঙ্গে দর–কষাকষি করা। কিন্তু তিনি আয়া সোফিয়াকে বেছে নিলেন কেন পশ্চিমাদের জব্দ করার জন্য? কারণ আয়া সোফিয়া ইউরোপীয়দের কাছে, বিশেষ করে খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে ঐতিহ্য ও আবেগের বিষয়। এরদোয়ান ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেননি। তবে ইতিহাসকেই অনুসরণ করেছেন। কনস্টানটাইন, জাস্টিনিয়ান, সুলতান মেহমেত, কামাল আতাতুর্ক অথবা রোমান সাম্রাজ্যের বিদ্রোহীরা আয়া সোফিয়াকে ব্যবহার করেছেন নিজেদের ক্ষমতাকে সংহত করতে, প্রভাব প্রতিপত্তির জানান দিতে। বসফরাসের ব্যবসা–বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতে। এরদোয়ানও একই কারণে আয়া সোফিয়াকে নিয়ে রাজনীতি করছেন। তিনি ক্ষমতায় থেকে বসফরাসের অধিকার ফিরে পেতে চান। এর মধ্যে তিনি বসফরাসের বিকল্প কৃত্রিম চ্যানেল তৈরির উদ্যোগও নিয়েছিলেন। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপের কারণে সেই উদ্যোগ সফল হয়নি। তাই এরদোয়ানের আয়া সোফিয়ার রাজনীতিকে নেহাত ধর্মীয় রাজনীতির আবহে না দেখে ভূ-রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখতে হবে।

বাবরি মসজিদের ঘটনা ও আয়া সোফিয়ার ঘটনা এক না। এদোয়ান যতটা না সাম্প্রদায়িক তার চেয়ে বেশি জাতীয়তাবাদী। তুর্কি ইসলামপন্থাকে তিনি তুর্কি জাতীয়তাবাদ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চাইছেন। হয়তো ক্ষমতায় থাকার নিশ্চয়তা পেলে এরদোয়ানই আয়া সোফিয়ার জাদুঘরের মর্যাদা ফিরিয়ে দেবেন। এখানে দুই পক্ষকেই ট্রেডঅফ করতে হবে। অন্য কোনো শাসক এসে যদি আয়া সোফিয়া জাদুঘরের মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে চান, তবে তাঁকেও কামাল আতাতুর্কের মতোই নির্মম ও নিষ্ঠুর হতে হবে।

ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক