ভোটাভুটির গল্প: সর্বজনীন থেকে স্বল্পজনীন

ভোটের মর্ম ও মূল্য না বুঝলেও বালক বয়সে দেখা ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের একটি ঘটনা আমার মনে আছে। আমাদের পাশের গ্রামে এক ভোটার ছিলেন যক্ষ্মার রোগী। এত দুর্বল যে পালকি ও ডুলিতে বসার শক্তিও তাঁর ছিল না। তাঁকে তক্তায় শুইয়ে তিন-চারজন লোক ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যান। অতিকষ্টে তিনি তাঁর ভোটটি হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর মার্কা নৌকায় দিতে পেরেছিলেন। নির্বাচনে জয়লাভ করে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠনের আগেই তিনি মারা যান। তাঁর তক্তায় শুইয়ে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া এবং কয়েক দিন পর মারা যাওয়ার কারণে অনেক দিন তিনি ছিলেন এলাকায় আলোচ্য বিষয়।

চুয়ান্নর নির্বাচন হয়েছিল ভারত শাসন আইন, ১৯৩৫-এর বিধানমতে। সেটা ছিল সংসদীয় ব্যবস্থা। প্রত্যক্ষ ভোটে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচিত হতো। সেই পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠন করতেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ৯ বছর পর ১৯৫৬ সালে প্রথম শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়। সেটা ছিল মোটের ওপর ভারতের সংবিধানের মতোই সংসদীয় পদ্ধতির। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদগুলো নির্বাচিত হবে প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের প্রত্যক্ষ ভোটে।

সর্বজনীন ভোটাধিকার এবং প্রত্যক্ষ নির্বাচন পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের পছন্দ হয়নি। ওই সংবিধানের ভিত্তিতে ১৯৫৯ সালের মার্চে পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। তৎক্ষণাৎ পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থ ও সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ব্রহ্মতালু উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তারা আর দেরি না করে ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে জেনারেল আইয়ুব খানকে ক্ষমতায় বসায়। তিনি ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল করে ১৯৬২ সালে তাঁর পছন্দমতো আরেকটি সংবিধান রচনা করেন। সেটি ছিল রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির: রাষ্ট্রপতি এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচিত হবে পরোক্ষ ভোটে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের দ্বারা। পূর্ব বাংলার জাতীয়তাবাদী নেতারা আইয়ুবের ওই সংবিধানকে প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৬৪ সালের ১৯ মার্চ সর্বজনীন ভোটাধিকার ও প্রত্যক্ষ নির্বাচনের দাবিতে তাঁরা দেশব্যাপী হরতাল এবং বিকেলে পল্টন ময়দানে জনসভা আহ্বান করেন। জনসভার পর মাওলানা ভাসানী, মাওলানা তর্কবাগীশ এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি সর্বদলীয় মিছিল রাজপথ প্রদক্ষিণ করে। কয়েকটি ইসলামপন্থী দলও তাতে শরিক হয়। সেদিন নেতাদের স্বাক্ষরিত যে প্রচারপত্র বিলি করা হয়, তাতে তাঁরা বলেছিলেন:

‘ভাইসব, পাকিস্তান অর্জিত হয় জনগণের ভোটে। আর আজ সেই পাকিস্তানের জনগণকে ভোটাধিকার হইতে চিরতরে বঞ্চিত করার এক জঘন্য ষড়যন্ত্র চলিয়াছে। ...আমাদের আজ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করিতে হইবে, সার্বভৌম ক্ষমতা দেশের জনগণের উপর ন্যস্ত, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের হাতে নয়। নির্ভীক চিত্তে বলিতে হইবে, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত নয়, এমন কোনো সরকার দেশবাসী গ্রহণ করিবে না। যত দিন আমাদের এই সর্বজনীন ভোটাধিকার ও প্রত্যক্ষ নির্বাচনের গণদাবি আদায় না হইবে, তত দিন সংগ্রাম চলিতে থাকিবে।’

জনমতকে উপেক্ষা করে আইয়ুব খানের শেষরক্ষা হয়নি। তাঁকে নতিস্বীকার করতে হয়। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে তাঁকে বিদায় নিতে হয় এবং সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতেই ১৯৭০ সালের নির্বাচন হয়।

জননেতাদের সংগ্রাম চলতে থাকলেও তা গ্রাহ্য করার প্রয়োজন বোধ করেননি সামরিক শাসক। পরোক্ষ নির্বাচনে তিনি নিজে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং একই পদ্ধতিতে বিডি (বেসিক ডেমোক্রেসি) মেম্বারদের ভোটে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদও নির্বাচিত হয়। কিন্তু জনমতকে উপেক্ষা করে আইয়ুব খানের শেষরক্ষা হয়নি। তাঁকে নতিস্বীকার করতে হয়। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে তাঁকে বিদায় নিতে হয় এবং সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতেই ১৯৭০ সালের নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনের দিন শাহজাহানপুর কেন্দ্রের একটি দৃশ্য আমার মনে আছে। এক যুবক তার মাকে রিকশা থেকে নামিয়ে কোলে করে বুথে নিয়ে যায়। কোনোরকমে ভোট দেওয়ার পর তাঁকে আবার কোলে করে রাস্তায় এনে রিকশায় তোলে। অনুমান করি, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্যই অত কষ্ট করে অসুস্থ বৃদ্ধা ভোটকেন্দ্র আসেন।

আমি ঘটনাক্রমে একাধিকবার নির্বাচনের সময় পশ্চিমবঙ্গে ছিলাম। দেখেছি সেখানে ভোটারদের উৎসাহ-উদ্দীপনা। সংঘাতও হয়েছে, সুষ্ঠু নির্বাচনও হয়েছে। পত্রিকায় দেখলাম, অরুণাচলের এক দুর্গম প্রত্যন্ত এলাকায় মাত্র তিনজন ভোটারের জন্য করা হয়েছিল একটি ভোটকেন্দ্র। সেখানে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে ভোটের সরঞ্জাম নিয়ে কর্মকর্তারা যান। ওই তিনজনের যেকোনো একজনের একটি ভোটের জন্য কোনো প্রার্থী পরাজিত হলে তার জন্য দায়ী হতো রাষ্ট্র। একবার আসামে মাত্র এক ভোটে এক প্রার্থী বিজয়ী হন। রাষ্ট্র একজন নাগরিককেও তাঁর ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত করতে পারে না।

রাজতন্ত্রের পত্তন ও সশস্ত্র মাওবাদী আন্দোলন-পরবর্তী নেপালে ঐতিহাসিক নির্বাচন হয় ২০০৮ সালের এপ্রিলে। সেই নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য নেপাল সরকার ৮০ জনের বেশি ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ করেছিল। বাংলাদেশ থেকে পর্যবেক্ষক হিসেবে যাঁরা যান, তাঁদের মধ্যে দুই নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন ও ছহুল হোসাইন এবং আমি ছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ও তাঁর পত্নী, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী, ভারতসহ কয়েকটি দেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনারও ছিলেন। পর্যবেক্ষকদের বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয়। আমাদের দলটিকে পাঠানো হয়েছিল ধানগাড়ি মহেন্দ্রনগরে, নেপাল-ঝাড়খন্ড সীমান্তের কাছে। ভোটাভুটির মধ্যেই দেখলাম জন্ম ও মৃত্যু। এক নারী ভোট দিতে এসে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কামরাতেই সন্তান প্রসব করেন। অন্য একটি কেন্দ্রে এক জরাগ্রস্ত ভোটার ভোট দিয়ে বুথেই মাথা ঘুরে পড়ে মারা যান। ভোট দিতে দূরদূরান্ত থেকে পাহাড়ি পথে হেঁটে এসেছেন মানুষ। সবাই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, পুরোনো দল কংগ্রেস জয়লাভ করবে, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় প্রচণ্ড (পুষ্পকমল দহল) ও বাবুরাম ভট্টরাইয়ের কমিউনিস্ট পার্টি। ওই নির্বাচনের পর নেপালে আরও নির্বাচন হয়েছে। কোনো কারচুপি বা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকার পরিবর্তন হয়েছে।

১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১-এর নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছিল। কিন্তু কয়েক বছর ধরে দেখছি ভোটারবহুল বাংলাদেশে কোনো কোনো ভোটকেন্দ্র নির্জনতায় খাঁ খাঁ করে। কোথাও কোথাও সাকল্যে ভোট পড়ে ৫-৭ শতাংশ।

বাংলাদেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ৪৪টি, অনিবন্ধিত দল কয়েক শ। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক দেশ বলতে যা বোঝায়, তা বাংলাদেশ। নেতা ও রাজনৈতিক দলের সংখ্যার বিপরীতে সংসদে মোট আসনসংখ্যা খুবই কম। ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১-এর নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছিল। কিন্তু কয়েক বছর ধরে দেখছি ভোটারবহুল বাংলাদেশে কোনো কোনো ভোটকেন্দ্র নির্জনতায় খাঁ খাঁ করে। কোথাও কোথাও সাকল্যে ভোট পড়ে ৫-৭ শতাংশ।

বঙ্গীয় ভোটাররা কোথায় গেলেন? ৬৬ বছর আগে আমাদের জাতীয় নেতারা সর্বজনীন ভোটাধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছেন, আজ বাংলাদেশে স্বল্পজনীন ভোটাভুটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেল। কেন এই অবস্থা, তার জবাব কে দেবে?

সরকারি দলের সমর্থক ভোটাররা বলবেন, তাঁদের প্রার্থীর জয় অবধারিত, তাই কষ্ট করে ভোট দিতে যাওয়া না যাওয়া একই কথা। কিন্তু তাঁরা একটি বিষয়ে ভুল করেছেন, তা হলো তাঁদের অনুপস্থিতিতে যদি বিরোধী দলের ভোটাররা সবাই গিয়ে ভোট দেন, তখন নিজেদের পরাজয় কীভাবে ঠেকাবেন? তবে ধারণা করি, নিশ্চয়ই তাঁরা জানেন, বিরোধী দলের ভোটারদের ভোট দিতে আসার গরজ নেই।

ভোটকেন্দ্রের ভোটারহীনতার কারণ জানতে চাইলে বিরোধী দলের নেতারা বলবেন, আমাদের নিয়তি পরাজিত হওয়া, তাই ভোট দিতে যাওয়া পণ্ডশ্রমমাত্র। সেই জন্য যেনতেন প্রার্থী দিই। কিন্তু তাঁদের ভুলটি হলো, সরকারি দলের ভোটারদের অনুপস্থিতিতে তাঁদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ষোলো আনা, যদি নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছা থাকে।

এই যে ভোটাভুটিতে সর্বজনীনতা থেকে স্বল্পজনীনতায় উত্তরণ, এর দায় সরকারি ও বিরোধী দল—উভয়েরই। বাংলার মাটিতে সরকারি ও বিরোধী দলের এত বিভেদ, এত বৈরিতা, কিন্তু একটি ব্যাপারে তাদের মধ্যে নিবিড় ঐক্য: ভোটারবিহীন নির্বাচন।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক