ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কৃতিত্ব ডোনাল্ড ট্রাম্পের?

হোয়াইট হাউসের প্রেস কনফারেন্সে ট্রাম্প বলেন, ‘এ যদি আমার জন্য না হতো, তাহলে তোমাদের আরও চার বছর ভ্যাকসিনের জন্য অপেক্ষা করতে হতো।’
এএফপি

ফক্স নিউজে সকালের হেডলাইন, ‘ফাইজার কোম্পানির ভ্যাকসিন তৈরির কৃতিত্ব ট্রাম্প নিচ্ছেন।’ সংবাদে উদ্ধৃতিসহ দ্বিতীয় লাইনটি, ‘আমরা ভ্যাকসিন তৈরিতে অনেক এগিয়ে আছি।’ হোয়াইট হাউসের প্রেস কনফারেন্সে ট্রাম্প বলেন, ‘এ যদি আমার জন্য না হতো, তাহলে তোমাদের আরও চার বছর ভ্যাকসিনের জন্য অপেক্ষা করতে হতো।’
মার্কিন প্রেসিডেন্টরা অনেক বুঝেশুনে কথা বলেন। কিন্তু এই প্রেসিডেন্টের কথার মর্ম সত্য প্রমাণ করা তাঁর নিজ পক্ষের সংবাদমাধ্যমেরও সম্ভব হয়ে উঠছে না।

এ কতটুকু অসম্ভব দাবি, একটু বুঝিয়ে বলি। সেপ্টেম্বর মাসে ফাইজার কোম্পানির সিইও সিবিএস নিউজে ‘ফেস দ্য নেশনে’ এসে বলেছেন, ‘আমরা সরকারের কোনো অর্থ নিইনি।  কারণ, আমরা প্রশাসন থেকে বিজ্ঞান এবং গবেষণাকে আলাদা রাখতে চেয়েছি।’ (সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট, নভেম্বর ৯, ২০২০)

ফাইজার কোম্পানি নিজেদের দুই বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে, বিদেশি এক গবেষণা কোম্পানি বায়োএনটেকের সঙ্গে একযোগ হয়ে এই ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছে। তারা বারবার বলছে, ‘আমরা ট্রাম্পের টাকা নিইনি, ট্রাম্পের কোনো প্রজেক্টের অংশও আমরা নই।’ কারণ, তারা জানে, যারা ট্রাম্পের আশপাশে আছেন, তাঁরা সবাই জানেন কীভাবে তিনি দিনকে রাত, রাতকে দিন করতে পারেন।

ফাইজারের ভ্যাকসিন গবেষণার প্রধান নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ‘আমরা কখনোই অপরারেশন ওয়ার্পের অংশ ছিলাম না, জনগণের করের টাকাও আমরা এই গবেষণায় নিইনি।’ (সূত্র: ফোর্বস, নভেম্বর ১৩, ২০২০)

এই যে এত দ্রুত আগে কখনো ভ্যাকসিন তৈরি হয়নি, সেই কৃতিত্ব ট্রাম্প কীভাবে নেবেন বুঝে পারছেন না, হয়রান হয়ে যাচ্ছেন যে মানুষেরা এই ধ্রুব সত্য দেখতে পাচ্ছে না কেন?

আমেরিকার হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিসেস কয়েকটি ভ্যাকসিন কোম্পানির সঙ্গে আগাম চুক্তি করে রেখেছে। চুক্তি হলো, তোমাদের ভ্যাকসিন এফডিএ অনুমোদন পেলে আমরা ১০ কোটি ডোজের ভ্যাকসিন এই অর্থমূল্যে প্রথম পাব। অর্থমূল্যটি হচ্ছে, ১ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। এর একটি পয়সাও ফাইজারকে দেওয়া হয়নি। চুক্তিটি করেছে আমেরিকার একটি প্রধান সরকারি সংস্থা, ট্রাম্প বা হোয়াইট হাউস নয়।
না হয় ধরেই নিলাম ফাইজারের ভ্যাকসিন আগাম কিনে রাখার বিস্ময়কর বুদ্ধি, জনদরদি ও ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন বর্তমান ‘অনড়’ মার্কিন প্রেসিডেন্টের মাথা থেকেই এসেছে। এখন দেখুন অন্য দেশগুলো কী করেছে।

ফাইজার এবং বায়োএনটেকের ভ্যাকসিন বিতরণের চুক্তিসমূহ:
ইউরোপীয় ইউনিয়ন—২০০ মিলিয়ন ডোজ
জাপান—২০ মিলিয়ন ডোজ
যুক্তরাষ্ট্র—১০০ মিলিয়ন ডোজ
যুক্তরাজ্য—৩০ মিলিয়ন ডোজ

তাঁর চার বছরে ভালো মানুষদের কুপোকাত করে বিদায় করে দেওয়ার পরও যে কজন ভালো মানুষ এখনো বহাল আছেন, তাঁরাই নিশ্চয় এই বুদ্ধি দিয়েছেন। তাঁরা ছয়টি সম্ভাবনাময় কোম্পানির ভ্যাকসিন আগাম কিনে রাখার ‘ডিল’ করেছেন। একটা না হলে আরেকটা, যেটাই সফল হোক, আমরা পাব, এই তরিকা আরকি।

এই তরিকা তাঁর নিজের মাথা থেকে বের হলেও ওপরের তালিকায় তিনি তৃতীয় হয়েছেন। তদুপরি ফাইজার কোনো সরকারের কাছ থেকে একটি পয়সাও নেয়নি। এসব হলো চুক্তিপত্র মাত্র। হলে টাকা দিয়ে নেব, নাহলে একটি পয়সাও পাবে না।
ফাইজার নিজেদের অর্থায়নে এই ভ্যাকসিন তৈরি করেছে। আরেকটি কথা খেয়াল করবেন, ফাইজারের সঙ্গে গবেষণায় কিন্তু বায়োএনটেক নামের কোম্পানিটিও আছে। তার কথা, হোয়াইট হাউস বা অতি বুদ্ধিমান মানুষটি কেন উল্লেখ করছেন না জানেন? কারণ, সেই কোম্পানি আমেরিকান কোম্পানি নয়, জার্মান কোম্পানি। তাঁর দম্ভোক্তি শুনে মনে হয়, তিনি তৃতীয় নন, তিনি নিজেই ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে রাত–দিন চোখ রেখে ভ্যাকসিনটি অতিদ্রুত আবিষ্কার করে ফেললেন।

আপনি যদি মডার্নার ভ্যাকসিনের কথায় আসেন, একই বিষয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্য মনে হচ্ছে, তিনি এখনো বুঝতে পারেননি মডার্নার আবিষ্কারটি আরও বৃহৎ, সেই ভ্যাকসিনের সম্ভাবনা সংরক্ষণের অনুচ্চ তাপমাত্রার কারণে আরও বেশি উজ্জ্বল। সেটাই হয়তো সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হবে। বুঝলে ফাইজার ছেড়ে মডার্না নিয়ে দম্ভোক্তি শুরু করতেন।

এই যে এত দ্রুত আগে কখনো ভ্যাকসিন তৈরি হয়নি, সেই কৃতিত্ব ট্রাম্প কীভাবে নেবেন বুঝে পারছেন না, হয়রান হয়ে যাচ্ছেন যে মানুষেরা এই ধ্রুব সত্য দেখতে পাচ্ছে না কেন? আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার বছর আগে এই নতুন ভ্যাকসিনের বীজ বপন হয়েছিল বিজ্ঞানী এবং গবেষকদের আবিষ্কারের মাধ্যমে।

এই যুগান্তকারী ভ্যাকসিন প্রযুক্তির নাম এম-আরএনএ (mRNA) ভ্যাকসিন। সনাতন ভ্যাকসিন থেকে সম্পূর্ণই ভিন্ন, অনেক দ্রুত তৈরি করা যায়, কম খরচে, এমনকি বিপদ ঘটার সম্ভাবনাও অনেক কম। সনাতনটিতে সেই রোগের (কোভিড-১৯) একটি দুর্বল বা মৃত জীবাণু শরীরে প্রবেশ করানো হতো। তাকে বলে ‘লাইভ ভেক্টর’ ভ্যাকসিন।

এই যুগান্তকারী আবিষ্কার যখন হয়েছে, তখন ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর দলের কাউকে লায়ার, কাউকে জোকার এবং ভিন্ন দলের কাউকে ‘ক্রুকেড’ নাম দিতে ব্যস্ত ছিলেন।
মানুষ, যাঁরা বোঝেন, তাঁরা শ্বাসবন্ধ করে অপেক্ষা করছিলেন নির্বাচনের ফলাফলের জন্য। এ শুধু ট্যাক্স বাড়াবে, যুদ্ধ লাগাবে, অবৈধ অভিবাসী প্রশ্রয় দেবে, এসব নয়। এমনকি ডেমোক্র্যাট/ রিপাবলিকান কোনোই বিষয় নয় এখানে। একজন ডাহা মিথ্যাবাদী মানুষ! একজন মানসিক অসুস্থ, ভয়ংকর মানুষ! আরও কত কিছু সর্বনাশ ঘটিয়ে ফেলতেন।

একটি গাড়ি গভীর খাদে পড়ে যাচ্ছিল। কোনোমতে ব্রেক কষে রক্ষা হয়েছে। শেষ রক্ষা হয়েছে কি না, সেটা এখনো দেখার বিষয়। সেই গাড়িতে মনুষ্য সমাজের সবাই রয়েছে। এমনকি পৃথিবীর পরিবেশ, অন্যান্য প্রাণী, গাছপালাও রয়েছে।

সবচেয়ে গা শিউরে ওঠার মতো ব্যাপারটি হচ্ছে, মার্কিন দেশের প্রায় ৭ কোটি ভোটার এবং তারও থেকে বেশি মানুষ মানবতার হুমকি মানুষটির প্রেমে পড়ে গেছেন। ভয়াবহ কী হতে যাচ্ছিল, তা তাঁরা কিছুই দেখতে পান না। মনে করছেন, একটি বাচ্চার কাছ থেকে শখের খেলনা কেড়ে নেওয়া হলে সে তো কাঁদবেই? চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলবে, এর থেকে বেশি আর কী?


হায় রে ভয়ংকর সর্বনাশা প্রশ্রয়!

মোস্তফা তানিম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি লেখক