ভয়ংকর নজির হয়ে থাকবে এটা

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প

তাহলে ডোনাল্ড ট্রাম্প সবাইকে নাকচ করে দিচ্ছেন, যেটা বোঝাতে অশ্লীল শব্দ (ফা...) ব্যবহার করলেও কৈফিয়ত দেওয়ার কিছু নেই। এ কথাটি এমন একজন মানুষ বলেছেন, যিনি পেন্টাগনকে ব্যবহার করে নিজেকে যেমন অসম্মানিত করেছেন, তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও। ট্রাম্পের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ‘পাগলা কুকুর’ ম্যাটিস ২০০৩ সালে ইরাকে গিয়ে বলেছিলেন, তিনি ‘বন্ধুত্বের বারতা’ নিয়ে এসেছেন। এমনকি তিনি মেরিন সেনাদের সহানুভূতিশীল হতেও বলেছিলেন। কিন্তু যারা অবৈধ মার্কিন আগ্রাসন রুখতে আসবে, তিনি তাদের হত্যা করবেন (ইফ ইউ ফা... উইথ মি, আই উইল কিল ইউ)।

এই সমস্যা সমাধানের যেন পথ নেই। আপনি একে নাৎসি, ফ্যাসিবাদী, বর্ণবাদী, দুষ্ট, অনুদার, অনৈতিক ও নির্মম বলতে পারেন। আরও বিপজ্জনক ব্যাপার হচ্ছে, ট্রাম্প যা করছেন নজির হিসেবে দুষ্ট প্রকৃতির। আপনি যদি তাঁদের আসা বন্ধ করতে পারেন, তাহলে আপনি তাঁদের বেরও করে দিতে পারেন। আপনি যদি সাতটি দেশের মুসলমানের আগমনের ব্যাপারে ‘চরম ভেটিং’ প্রয়োগ করতে পারেন, তাহলে যাঁরা এখন ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন, তাঁদের ‘মূল্যবোধ পরীক্ষাও’ নিতে পারেন। ভিসাধারীদেরও পরীক্ষা নিতে পারেন। অথবা দ্বৈত নাগরিকত্বের অধিকারী মার্কিনদেরও নিতে পারেন? অথবা মুসলিম বংশোদ্ভূত মার্কিনদেরও? হিস্পানিক ও ইহুদিদের? একদিন শরণার্থীদের? পরের দিন নাগরিকদের? তারপর আবার শরণার্থীদের।

না, ট্রাম্প কিন্তু অবশ্যই ইহুদি অভিবাসীদের এমন অশ্লীল পরীক্ষার মুখে ফেলবেন না। কারণ, সেটা অশ্লীল হবে, তাই নয় কি? এমনকি তিনি মুসলিম দেশ থেকে খ্রিষ্টানদের আগমনেও বাদ সাধবেন না। যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই বিভক্ত রাষ্ট্রের সমালোচনা করেছে। কিন্তু ট্রাম্প নিজেই এখন ঘোষণা করলেন, তিনি এই বিভক্তি অনুমোদন করেন। সংখ্যালঘুদের স্বাগত জানানো হবে, তবে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদের গোষ্ঠী আলাওয়াইটদের জন্য দরজা খোলা থাকবে না। আমরা আশা করতে পারি, দুনিয়াজোড়া মার্কিন দূতাবাসগুলোতে ভিসার জন্য তিনটি লাইন দেখা যাবে। একটি হবে খ্রিষ্টানদের জন্য, একটি মুসলমানদের, আরেকটি অন্যদের। সেই লাইনেই আমাদের অধিকাংশকে দাঁড়াতে হবে। আর সেটা করে আমরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই অন্যায় ব্যবস্থাকে অনুমোদন করব, তার সঙ্গে ট্রাম্পকেও।

যা হবে তার জন্য সময় অপচয় করার মানে হয় না। কথা হচ্ছে, ট্রাম্প যে সাতটি দেশের নাগরিকদের আগমন নিষিদ্ধ করেছেন, তার মধ্যে পাঁচটি দেশে যুক্তরাষ্ট্র বোমা বর্ষণ করেছে। সুদান অল্পের জন্য পার পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৮৮ সালে এক যাত্রীবোঝাই ইরানি বিমানকে আকাশেই উড়িয়ে দিয়েছিল। ইসরায়েল যে সিরিয়ায় ইরানি কর্মকর্তাদের ওপর বোমা বর্ষণ করছে, তাতেও সে আপত্তি করেনি। তার মানে এই সংখ্যাটা ছয়ে উঠল। আর এ কথা নতুন করে বলে কোনো ফায়দা নেই যে সৌদি আরব, মিসর, আমিরাত ও লেবানন—এই চারটি দেশ ৯/১১-তে সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধে অংশ নেওয়া সত্ত্বেও এই তালিকায় নেই। সৌদি আরবে শিরশ্ছেদের চল থাকলেও বা তাদের নাগরিকেরা আইএসসহ হন্তারকদের টাকা দিলেও দেশটিকে আদর-সোহাগ করতে হবে। মিসর শাসন করছেন ট্রাম্পের ‘দারুণ মানুষ’ ও ‘সন্ত্রাসী’ প্রেসিডেন্ট আল-সিসি। চকচকে ও সম্পদশালী আমিরাতের গায়ে টোকা দেওয়া যাবে না। লেবাননের গায়েও টোকা পড়বে না, যদিও তার লাখ লাখ দ্বৈত নাগরিকত্বধারী সিরিয়ার মানুষেরা সামনে হয়তো কঠিন সময়ের মুখোমুখি হবেন।

তবে এই কুৎসিত আইনটি কোনো জাতিকে উদ্দেশ্য করে করা হয়নি। এটা শরণার্থী, গরিব ও আমজনতাকে লক্ষ্য করে করা হয়েছে, মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার জন্য যাদের প্রাণ আইটাই করছে। মুসলমানরা, খ্রিষ্টানরা নয়, তারা কীভাবে ‘মূল্যবোধ পরীক্ষা’ সহ্য করতে পারে? আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যবোধই বা কী? সার্বভৌম রাষ্ট্রকে আক্রমণ করা ঠিক আছে। অন্য দেশের নারী-পুরুষকে আক্রমণ করতে চালকবিহীন বিমান ব্যবহার করা যেতে পারে। আপনার মিত্র যদি নিজের জনগণের জন্য অপরের কাছ থেকে জমি চুরি করে, তাহলেও সমস্যা নেই। আরব একনায়কেরা যতক্ষণ যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র, ততক্ষণ তাঁরা বন্দীদের মারলে, কাটলে বা ধর্ষণ করলেও সমস্যা নেই। সৌদি আরবকে ফাস্ট-ট্র্যাক ভিসা দেওয়া যেতে পারে, এমনকি তারা বিশ্বের সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ী ওয়াহাবি রীতির সদস্য হলেও, যার সদস্যের মধ্যে আছে তালেবান, আল-কায়েদা, আইএসসহ অন্যান্য গোষ্ঠী।

এই ভুয়া খেলায় আমাদের অংশ নেওয়া নিয়ে দালালি করার মধ্যেও কোনো মূল্য নেই। থেরেসা মে উপসাগরীয় অঞ্চলের খুনি সরকারপ্রধানদের মাথায় শুধু মৃদু টোকা দেন, কিন্তু সদ্য ওয়াশিংটন সফর করে তিনি ট্রাম্পের ভ্রান্ত নীতি সম্পর্কে কিছু বলেননি। অথচ এই যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন কি কয়েক মাস আগে পূর্ব আলেপ্পোর শরণার্থীদের জন্য বালতি বালতি অশ্রু বিসর্জন করেনি?

তবে পূর্ব আলেপ্পোর প্রায় সব শরণার্থীই মুসলিম ছিলেন। ওদিকে সিরিয়ার খ্রিষ্টানরা বাশারের কাছে আশ্রয় চেয়েছিলেন, যদিও এটা তাঁদের দোষ ছিল না। উত্তর সিরিয়ার খ্রিষ্টান পাদরিদের আমি যখন সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, তখন তাঁরা কী বলেছেন? তাঁরা চাননি, তাঁদের স্বগোত্রীয়রা পশ্চিমের উদ্দেশে রওনা হোক। কঠিন হলেও খ্রিষ্টানদের উচিত, তাঁদের বিশ্বাসের ভূমিতে বসবাস করা। পশ্চিমে তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে স্রেফ হারিয়ে যাবেন। ট্রাম্প এটা নিশ্চিত করতে চাইছেন, ব্যাপারটা যেন এমনই হয়।

এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে ‘কট্টরপন্থী ইসলামি চরমপন্থীদের’ হাত থেকে ‘রক্ষা’ করতে চাইছে। খেয়াল করুন, ‘ইসলামি’ ‘ইসলামপন্থী’ নয়। তখন ব্রিটেনও তাকে অনুসরণ করতে পারবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসা একক ব্রিটেনও এই একই পথে হাঁটতে সক্ষম হবে। যে পথটির ধরন বেশ বাজে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি ব্রিটেনের প্রাণ হয়, তাহলে যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক ভাঁড়দের কাছেও কি এটা নৈতিক প্রাণভোমরা হবে না?  হ্যাঁ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। কিন্তু হিটলারের অশুভ কাজের আগে ও পরে যুক্তরাষ্ট্রই বা কী করেছে? তারা ইহুদি শরণার্থীদের ঢুকতে দেয়নি। হ্যাঁ, সেই আনা ফ্রাঙ্কের পরিবারকেও। এখন তারা আবার সেই কাজ করতে যাচ্ছে।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন

রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।