মগজ দিয়ে চলবে গাড়ি

চীন দেশের বিজ্ঞানীরা এমন এক গাড়ি তৈরি করেছেন, যা কিনা চলবে মগজ দিয়ে। মানে মানুষ সেটা চালাবে তার ব্রেন দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে, মগজ দিয়ে বা মস্তিষ্ক দিয়ে। চালক সেই গাড়িতে বসবেন, কিন্তু সেই গাড়িতে কোনো ব্রেক থাকবে না, স্টিয়ারিং থাকবে না, চালককে হাত ব্যবহার করতে হবে না, পা ব্যবহার করতে হবে না, এমনকি মুখে বলতেও হবে না, চলো, থামো, বাঁয়ে যাও, ডানে যাও, স্লো, বা তাড়াতাড়ি। যা করতে হবে, তা হলো চালকের মাথার সঙ্গে ১৬টা সেন্সর লাগানো ক্লিপ আটকাতে হবে। তারপর সেই গাড়ির কম্পিউটার ব্রেইনের ‘ইইজি’ সংকেত পাঠ করবে এবং সে অনুযায়ী গাড়ি চলতে থাকবে। ৯ ডিসেম্বর ২০১৫ ডেইলি স্টারে এই খবরটি আছে, রয়টার্স পরিবেশিত খবরটি দেশ-বিদেশের আরও বহু কাগজে প্রকাশিত হয়েছে। চীনের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের তিয়ানজিন শহরের নানকাই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা এই গাড়ি তৈরি করেছেন। গবেষকেরা বলেছেন, ভবিষ্যতে এই গাড়ি চালাতে পারবে প্রতিবন্ধী মানুষেরা, যাদের হাত-পা-মুখ চলে না, কিন্তু ব্রেইন কাজ করে। আরও ভবিষ্যতে চালকবিহীন গাড়ির চল হবে, সে ক্ষেত্রে এই গবেষণা অনেক কাজে দেবে।
ব্যাপারটা নিয়ে বেশ চিন্তিত আছি। এই গাড়ি নাকি ভিড়ের রাস্তাতেও ঠিকঠাক চলবে, বা থামবে, বা পেছনেও যাবে। কেমন করে তা সম্ভব হবে। মানুষের মস্তিষ্কের ভাবনা নাকি সে ঠিকঠাক পাঠ করে ফেলতে পারবে। আমার দুশ্চিন্তা হলো, মানুষের মস্তিষ্কের ভাবনা কি এতটাই সহজ-সরল। সে তো একটা কথা ভাবে না, এক মুহূর্তে ভাবে হাজার কথা। কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে। সেই যে ছোটবেলায় পড়া কাজের ছেলে কবিতায় পড়েছিলাম, ছেলেটা পথ দিয়ে যাচ্ছে—তাকে বাজার থেকে কিনে আনতে হবে ‘দাদখানি চাল মসুরের ডাল দুটি পাকা বেল সরিষার তেল’—সেটা সে মুখস্থ বলতে বলতে যাচ্ছে আর খেলা দেখছে, ‘ভোলা ভেতো হাবা খেলিছে তো বেশ, দেখিব খেলাতে কে হারে কে জেতে খেলা হলে শেষ।’ ভাবতে ভাবতেই পুরো ফর্দ ভুলে সারা। তেমনি হয়তো উঠলাম গাড়িতে, যাব বাড়িতে, যেতে যেতে মনে হলো, সিনেমার পোস্টারটা তো বেশ, বলাকায় চলিতেছে...যাব নাকি, অমনি দেখা গেল, আমার ব্রেইন-রিডার গাড়ি ঘুরতে শুরু করেছে, আরে আরে করো কী, যাব তো বাড়িতে, আবার গাড়ি সোজা পথ ধরল। যাচ্ছি আর ভাবছি, ছেলেটা বই চেয়েছিল, নিউমার্কেটে গেলে মন্দ হতো না, গাড়ি ততক্ষণে ঘুরে গেছে—আর তারপরের ভাবনা, নিউমার্কেট না, বউয়ের রিপোর্টটা নিতে হবে, হাসপাতাল বেশি জরুরি। ওই বেচারা গাড়ির ব্রেইন নষ্ট হওয়ার উপক্রম। তবে ওই গাড়ির কম্পিউটারকে এই পরামর্শ আগেই দিয়ে রাখতে হবে, পুরুষ হিসেবে এটা আমি পুরুষদের মাথার ভাবনাটা বলে রাখছি, মেয়েদের কী হয় আমি জানি না, রাস্তায় কোনো রূপবতী নারী দেখলে ছেলেদের মনে হয়—কবি কামরুজ্জামান কামুর গানের লাইন থেকে বলি—
‘এক পলকে চলে গেল আহ্ কী যে তার মুখখানা,
রিকশা কেন আস্তে চলে না।’
গাড়ি যেন রিকশার পেছন পেছন চলতে আরম্ভ না করে দেয়, সেই কমান্ড তাকে আগে থেকেই দিয়ে রাখতে হবে।
এ তো গেল যাদের ব্রেইন আছে, তাদের ব্যাপার। কিন্তু যাদের ব্রেইন নেই?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন মংপুতে বেড়াতে গিয়েছিলেন মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িতে, তখন একবার গৃহকর্ত্রী তাঁকে মগজ রান্না করে খেতে দিয়েছিলেন।
‘ওটা কী?’ রবীন্দ্রনাথের প্রশ্ন।
‘ব্রেইন।’
‘কী করে বুঝলে ব্রেইন জিনিসটারই আমার অভাব’—রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন।
সত্যি, আমার মতো যাদের মাথায় ব্রেইন জিনিসটাই নেই, তারা এই গাড়ি চালাবে কী করে?
কিংবা আমাদের নৌপরিবহনমন্ত্রী, যিনি চালকদের নেতা, যিনি বলেছিলেন, গাড়ি চালাতে এমএ-বিএ পাস করতে হয় না, শুধু রাস্তায় গরু-ছাগল চিনতে পারলেই হয়—তাঁর পছন্দের চালকেরা এই গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসলে গাড়ি চলবে তো! চলতে শুরু করার পর রাস্তার ধারে গরু-ছাগল দেখে চেনার আনন্দে থেমে যাবে না তো!
ছোটবেলায় শোনা বানর ও কুমিরের গল্পে শুনেছিলাম, বানর চড়েছে কুমিরের পিঠে। নদী পার হচ্ছে, মাঝনদীতে গিয়ে কুমির বলল, আমার বউ খুব বানরের কলজে খেতে চায়, এবার আমি তোমার বুক থেকে কলজে বের করব। বানর বলল, ইশ্ আগে বলবে না, তুমি জানো না, বানরের কলজে তো থাকে গাছের মগডালে, আমাকে তীরে নাও, আমি তোমার বউয়ের জন্য কলজে নিয়ে আসি। আমাদের মধ্যেও তো এমন
থাকতে পারেন, যাঁরা মাথার মগজটা বাড়ির ড্রয়ারে রেখে তারপর বের হন। তাঁরা আমাদের দিনে-রাতে উপদেশ দেন, মধ্যরাতে টক শো করেন, দেশ ও জনগণের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করেন। তাঁরা যদি এই গাড়ি চালাতে আসনে বসেন, তখন কী হবে? গাড়ি কি সংকেত দেবে, ‘নো ব্রেইন ইন দ্য স্কাল, প্লিজ রিফিল!’
সেই যে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কাছে গ্রামের এক কৃষক এসেছিল, ছেলেকে চাকরি দেন। শেরেবাংলা কৃষককে বললেন, ‘তোমার ছেলে কী পাস?’
‘লেখাপড়াটা সে করেনি হুজুর।’
‘তাহলে তাকে হালচাষ করতে লাগাও।’
‘হালচাষ সে পারে না হুজুর।’
‘তাহলে তাকে ব্যবসায় লাগাও।’
‘ব্যবসা সে পারবে না হুজুর। হিসাব-কিতাব কিছুই জানে না।’
‘তাহলে তো তোমার ছেলেকে মন্ত্রী বানাতে হয়।’ শেরেবাংলা বলেছিলেন।
এখন চীনাদের এই গাড়িও তো ওই কৃষকের ছেলে চালাতে পারবে না। তাহলে সে মন্ত্রীই হয়তো হতে পারবে। চীনা মন্ত্রী।
গাড়ি চালাতে ব্রেইন লাগে—কী যন্ত্রণা! দেশ চালাতেও বুদ্ধি লাগে। ওই গাড়ি যিনি চালাবেন, তাঁর যেমন বুদ্ধি দরকার হবে, তেমনি তাঁর অন্যান্য আবেগ কম থাকাই শ্রেয়। পথের ধারে কোনো রোগী কাতরাচ্ছে, কোনো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রাস্তা পার হতে পারছে না, একটা বিশাল হাতি হেলে-দুলে চলেছে, ফুটে আছে একটা রক্তবর্ণ গোলাপ—ব্রেইন যদি সেসব নিয়ে ভাবতে থাকে, গাড়ি থেমে যাবে আর পেছনের চালকদের অসুবিধা সৃষ্টি করবে। দেশ যাঁরা চালান, তাঁরাও এই সব আবেগের ঊর্ধ্বে ওঠেন, সন্তানহারা মায়ের কান্না, কিংবা মাঘ মাসের হু হু শীতের বাতাস তাদের বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতে পারে না। পারলে তো চাকা চলবে না, থেমে যাবে।
গাড়ি যাঁরা চালান, তাঁরা একটু নির্মোহ হবেন, এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। এ কারণেই লেখা থাকে, চলন্ত অবস্থায় চালকের সঙ্গে কথা বলবেন না। কিন্তু তাঁদের ব্রেইন থাকতে হবে, এটা কেবল প্রত্যাশা নয়, প্রাথমিক পূর্বশর্ত। তা চালকদের আছে কি না, সেটাই প্রশ্ন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।