মজুরি পরিস্থিতির অবনতি উপেক্ষা করা যায় না

প্রতীকী ছবি

করোনাভাইরাসের অভিঘাতে লাখ লাখ মানুষ যেমন কাজ হারিয়েছেন, তেমনি কাজে টিকে থাকা শ্রমজীবীদের এক বড় অংশেরই বেতন বা মজুরি কমেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ বিষয়ে তেমন কোনো গোছানো তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায় না। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে যে আয়-ব্যয় ধারণা জরিপ পরিচালনা করেছে, তা থেকে জানা যায় যে কাজ হারানোর ফলে জুলাই মাসে দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে হয়েছিল ২২ দশমিক ৩৯ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বর মাসে নেমে আসে ৪ শতাংশে। মানে, যাঁরা কাজ হারিয়েছিলেন, তাঁরা বেশির ভাগই কোনো না–কোনোভাবে কাজ ফিরে পেয়েছেন বা বিকল্প কাজের সন্ধান করে নিতে পেরেছেন।

‘কোভিড-১৯ বাংলাদেশ: জীবিকার ওপর অভিঘাত ধারণা জরিপ’ শিরোনামের এই জরিপ থেকে আরও জানা গেছে যে করোনার সময়টাতে মানুষের আয় ও ব্যয় দুটোই কমলেও ব্যয়ের তুলনায় আয় কমেছে অনেক বেশি। মার্চ মাসের তুলনায় আগস্টে যেখানে পরিবারপ্রতি গড় আয় কমেছে প্রায় চার হাজার টাকা বা ২০ শতাংশ, সেখানে গড় ব্যয় কমেছে প্রায় ১ হাজার ৩০০ টাকা বা ৬ শতাংশ। অন্যভাবে বললে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমেছে। (জরিপের ফলাফলসহ প্রতিবেদনটি অবশ্য এখন পর্যন্ত বিবিএসের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি।)

বিবিএসের এই জরিপে মজুরির ওপর সেভাবে কোনো আলোকপাত করা হয়নি। তাই বেকারত্ব পরিস্থিতির অবনতি ঘটা ও দ্রুত তা থেকে উত্তরণ ঘটার যে চিত্র এতে তুলে ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে কর্মজীবী মানুষের মজুরির অবস্থা কী হয়েছে, তা জানা সম্ভব হয় না। তবে মাসওয়ারি ভোক্তা মূল্যসূচক ও মূল্যস্ফীতির হারের সঙ্গে যে মজুরি হার সূচক প্রকাশ করা হয়, সেটা থেকে মজুরি পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা যায়। সেপ্টেম্বর মাসের মজুরি হার সূচক অনুসারে এই সময়কালে জাতীয় পর্যায়ের নামিক মজুরি বেড়েছে ৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে যা বেড়েছিল ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ। সে হিসাবে বলা যায় যে নামিক মজুরি বাড়ার হার কমেছে। গত বছরের অক্টোবরে নামিক মজুরি হার সূচক কমে যাওয়ার পর থেকে পরের তিন মাসে সামান্য করে বেড়েছিল। তবে ফেব্রুয়ারি থেকে আবার কমতে শুরু করে জুলাইতে এসে সাম্প্রতিক কালের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে (৫ দশমিক ৮২ শতাংশ) এসে ঠেকে। পরের দুই মাস একটু করে বেড়েছে। অর্থাৎ মজুরি হার সূচকের এই প্রবণতা দেখায় যে মজুরি কমেনি, কমেছে মজুরি বৃদ্ধির হার। করোনার এই কালে বিষয়টি কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকাটাই স্বাভাবিক। আরও সমস্যা হলো মজুরি হার সূচক নিয়মিত প্রকাশ করলেও এ নিয়ে বিবিএসের প্রতিবেদনে স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা থাকে না। ফলে গোটা বিষয়টি নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা থেকে যায়।

বিবিএসের নামিক মজুরি সূচক মূলত কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের মোট ৪৪টি বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত শ্রমিকদের নামিক মজুরির একটি সমন্বিত সূচক। নামিক মজুরি পরিমাপ হয় অর্থমূল্যে বা টাকার অঙ্কে। সুতরাং শ্রমিকেরা মজুরি বাবদ যে টাকা পেলেন, তা কতটা বা কী হারে বাড়ল, সে সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় এই সূচক থেকে। এর বেশি কিছু নয়। যদি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে নামিক মজুরির সমন্বয় করা হয়, তাহলে প্রকৃত মজুরি বা শ্রমিকের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা সম্পর্কে জানা যায়। বিবিএস অবশ্য বহু বছর ধরেই আর প্রকৃত মজুরি সূচকের কোনো হিসাব প্রকাশ করে না। ২০০৫-০৬ অর্থবছরের পর থেকে এ বিষয়ে কোনো জাতীয়ভিত্তিক উপাত্ত পাওয়া যায় না। তবে বিকল্প পন্থা হিসেবে মাসওয়ারি মূল্যস্ফীতির হারের সঙ্গে নামিক মজুরি সূচক মিলিয়ে দেখলে প্রকৃত মজুরি পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করা যায়।

এ বছর সেপ্টেম্বর মাসে ভোক্তামূল্য সূচকের (সিপিআই) ভিত্তিতে বিবেচনা করলে এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে নামিক মজুরি যা-ই বাড়ুক না কেন, প্রকৃত মজুরি নেতিবাচক হয়ে গেছে। সেপ্টেম্বরের মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ আর নামিক মজুরি সূচক বৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এই একটা সাদামাটা অঙ্কের হিসাবই বলে দেয় যে শ্রমিক যা মজুরি পাচ্ছেন, তা ব্যয় করার পর হাতে কিছুই থাকছে না বরং ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে।

আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যানের বাইরে বিভিন্ন বিকল্প সূচক থেকেও বোঝা যায় যে নিম্ন আয়ের সাধারণ কর্মজীবী ও শ্রমজীবীরা জীবনধারণের জন্য কতটা কষ্ট করছেন। বাজারে সবজিসহ খাদ্যপণ্যের দাম যেভাবে বেড়েছে, তাতে এই নিম্ন আয়ের মানুষ অধিকতর ভুক্তভোগী হচ্ছেন। বিভিন্ন শিল্পকারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই তো হয়েছেই, যাঁরা টিকে আছেন, তাঁরা অনেকেই অনিয়মিত ও কম বেতন পাচ্ছেন। জুলাইয়ের তুলনায় আগস্টে বেকারত্ব পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে বলে বিবিএসের ধারণা জরিপে যে চিত্র পাওয়া গেছে, তাতে নীতিনির্ধারকেরা তুষ্ট বলে মনে হয়। আর এখানেই সমস্যা। কী শর্তে, কতটা কম বেতন বা মজুরিতে অনেক মানুষ আগের বা নতুন চাকরিতে বা কাজে যোগ দিয়েছেন কিংবা কতটা কম আয় মেনে নিয়ে অনেকে নিজস্ব উদ্যোগে বিকল্প কাজের সন্ধান করেছেন, এ বিষয়গুলো সম্পর্কে নীরব থাকা গেলেও কঠিন বাস্তবতা উপেক্ষা করা যায় না। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে—এটা যেমন সত্যি, তেমনি অনেক চড়া মূল্য দিয়ে যে তা হচ্ছে, সে সত্যিটাও তো অস্বীকার করা যায় না। মজুরি পরিস্থিতির দিকে তাকালে চড়া মূল্যের বিষয়টি ধরা পড়ে।

আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক

[email protected]