মধুপুরের বাসন্তী রেমার কান্না

বন বিভাগের উচ্ছেদ অভিযানে কেটে ফেলা কলাগাছের সামনে বাসন্তী রেমা
ছবি: প্রথম আলো

মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের আমাদের এই দেশে অসংখ্য নদ-নদী, পাহাড়, অরণ্য ছড়িয়ে আছে মানবকল্যাণে। কিন্তু প্রকৃতির এসব দান উপদ্রুত। ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় কে যে ছোট, কে যে বড়, তা বোঝা মুশকিল। তবে বড় ধরনের ক্ষতির শিকার যে বনভূমি পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ব্রিটিশ আমলের আগে বনভূমি ছিল স্বাধীন, দুর্গম সব বনাঞ্চল ছিল পশুপাখি আর তাদের সেবাইত মানুষের আবাসভূমি। এই সেবাইত মানে আদিবাসী। তাদের সঙ্গে অরণ্যের অন্য অধিবাসীদের ছিল গভীর সংযোগ। ধরিত্রী ছিল তাদের মা। মাতৃস্নেহেই রক্ষা করত বনভূমি আর জলাধার। বেনিয়া ইংরেজরা সমৃদ্ধ বনভূমিকে অর্থমূল্যে রূপান্তর করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করে। নানা ধরনের আইনকানুনের বেড়াজালে বাঁধতে থাকে বনভূমিকে। বন আইনের প্রয়োগে বিত্তশালী হতে থাকে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ, তার পদলেহী জমিদার ও জমিদারদের আমলারা। আক্রমণ হতে থাকে বনের সেবাইত আদিবাসীদের ওপর। যে সঘন বনভূমিতে আশ্রয় মিলেছিল পশুপাখির, সেখানে সূর্যালোক ঢুকে যায়। মানুষের হাতে নিধন হতে থাকে প্রকৃতির এই দান।

যেখানে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হতে পারে, সেখানে পরিবেশ আর শিক্ষার জন্য বিশ্বব্যাংকের ওপর নির্ভর করতে হবে কেন?

সাম্প্রতিক কালেও এমন অনেক ঘটনাই ঘটছে, কিন্তু সেদিকে আমাদের দৃষ্টি নেই। মধুপুরে ন্যাশনাল পার্ক, ইকোপার্ক নির্মাণ করা, চারদিকে বসবাসরত মান্দি জাতিগোষ্ঠীকে কাঁটাতারের বেষ্টনীতে আটকানো এবং বন আইনে মানুষকে উৎখাত করে মৌলিক বনজ গাছপালা কেটেকুটে সেখানে বিশ্বব্যাংকের ইচ্ছা প্রয়োগ করার চেষ্টা। বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করবে বলে কিছু শর্ত আরোপ করে থাকে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হলো, কিন্তু টাকার মহাজনের কথাই মানতে হলো।

যেখানে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হতে পারে, সেখানে পরিবেশ আর শিক্ষার জন্য বিশ্বব্যাংকের ওপর নির্ভর করতে হবে কেন? সচেতন নাগরিক সমাজ ও ক্ষুদ্র জাতিমত্তার মানুষের প্রতিরোধের মুখে সরকার পিছু হটেছে, কিন্তু প্রচেষ্টা অব্যাহতই আছে। সারা দেশে তো বটেই, মধুপুর থেকে ভাওয়াল পর্যন্ত অনেক বনভূমি ও পাহাড় কেটে সাফ করে দেওয়া হয়েছে। অবৈধ দখলদারদের এসব কাজে সহায়তা করেছে রাষ্ট্রের বন সংরক্ষক সংস্থা। তার হাতে আছে কঠোর আইন, সে আইনের প্রয়োগকারীরা দুর্ধর্ষ। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এমন একজন বন সংরক্ষকের কথা আমরা জানলাম, যাঁর এত অর্থ জমে গেল যে ব্যাংক ও আত্মীয়স্বজনের কাছে তাঁর টাকা রাখার পরও বালিশের ভেতর, চালের ড্রামের ভেতর অবৈধ টাকা রাখতে হলো।

সম্প্রতি টাঙ্গাইলের মধুপুরে বাসন্তী রেমার ওপর বন বিভাগের নিপীড়নের ঘটনা হৃদয়বিদারক। বংশপরম্পরায় মাতৃতান্ত্রিক অধিকার থেকে বাসন্তী রেমা একটি জমির মালিক হয়েছেন। আইএলওর ১০৭ নম্বর কনভেনশন অনুযায়ী প্রথাগত ভূমি অধিকার বা ‘কাস্টমারি ল্যান্ড রাইট’ বাংলাদেশে স্বীকৃত। ব্রিটিশদের নিজেদের স্বার্থে করা ১৯২৭ সালের এক আইনের বলে স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রের বনরক্ষকেরা বনের আদি অধিবাসীদের জমি ও বসতবাড়ির ওপর হামলা করে, মামলা দেয়। তাদের এসব নিপীড়নে বহু মান্দিকে দিনের পর দিন পালিয়ে থাকতে হয় অথবা দেশ ত্যাগ করতে হয়। আক্রমণ হয় শুধু মান্দি জাতিগোষ্ঠীর ওপর, সমতলের দখলদারদের ওপর হয় না। মধুপুরের ভেতরে গেলে দেখা যায় বাঙালিরা ঘরবাড়ি করে, দোকান-বাজার বসিয়ে নির্বিঘ্নে বাস করছে।

অতিদরিদ্র বাসন্তী রেমা তাঁর দুটো সন্তান নিয়ে কায়ক্লেশে বসতবাড়িসংলগ্ন ৪০ শতক জমিতে কলা চাষ করে কোনোমতে দিনাতিপাত করছিলেন। ঘটনার দিন তিনি দিনমজুরি খাটতে যাওয়ার পর হঠাৎ সংবাদ পেলেন, তাঁর কলাবাগান কেটে ফেলা হচ্ছে। দ্রুত সেখানে এসে দেখতে পান বন বিভাগের কর্মকর্তা, বন প্রহরী, ৬০ থেকে ৭০ জন মজুর এবং জাহাঙ্গীর নামে এলাকার এক রাজনৈতিক কর্মী প্রবল উল্লাসে কলাগাছগুলো কেটে ফেলছেন। বাসন্তীর আর্তনাদে এলাকাবাসী সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করলে কাজটি বন্ধ হয়।

কথা হলো, রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগের কিছু বিধি আছে; তার একটি হলো আগে নোটিশ দেওয়া। কিন্তু সেখানকার সহকারী বন সংরক্ষকের ভাষ্য, এসব কাজে নোটিশের প্রয়োজন হয় না। ওপর থেকে নির্দেশ এলেই হয়। প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের চোখের সামনে যখন বন উজাড় হয়ে গেল, তখন ওপরওয়ালাদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হয়।

টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে আমার নিজের গ্রামটি পাহাড়ের পাদদেশে। পঞ্চাশের দশকেও ওই পাহাড়ে প্রচুর বনজঙ্গল ছিল। হাতি, বাঘ, জংলি শূকর, বনমোরগ থাকত, ছিল বিচিত্র বুনো ফলমূল, শাকসবজি ও তরকারি। ঘাটাইলের দেওপাড়া পাহাড়ে ধাইরা নামে পাহাড়ের ওপরে একটা বাজারও বসত। সত্তরের দশকেও বাজারটা ছিল; কিন্তু তারপর বন্য প্রাণী চলে গেল, মান্দিরাও চলে গেল। বনানী হারিয়ে গিয়ে লালমাটির পাহাড়টা নিঃসঙ্গ হয়ে গেল। পরে পাহাড়টাকে কেটেকুটে একেবারে সমতল করে দেওয়া হলো। সেই বন-পাহাড়ের ভেতর থেকে সূর্যোদয় এখনো আমাদের কাছে এক দুঃখজাগানিয়া স্মৃতি। ওই অঞ্চলের মানুষের কাছে ফরেস্টার ছিলেন ভিআইপি। রেঞ্জার সাহেব, বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বা ডিএফও ছিলেন ভিভিআইপি সাহেব। আরও ওপরের কথা নাই-বা বললাম।

বাসন্তী রেমার বাড়িসংলগ্ন জায়গাটার ওপর অতর্কিতে আইন প্রয়োগের পরিণতি সবার জানা। জায়গাটি দ্রুত অন্যের দখলে চলে যাবে। তাই জাহাঙ্গীর ও তাঁর দলবলের সেখানে যেতে সময় লাগেনি। আরেকবার দেখেছিলাম নওগাঁয়। হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ থাকা সত্ত্বেও আলফ্রেড সরেনের বাড়িতে তিন-চার শ লোক দিয়ে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়। আলফ্রেড সরেনকে নিষ্ঠুরভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়। অতগুলো লোককে তাৎক্ষণিকভাবে একত্র করা সম্ভব হয়েছিল কীভাবে? পূর্বপ্রস্তুতি ছিল।

বন বিভাগের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিকভাবেই দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ। আমরা অবশ্যই চাই রাষ্ট্রের মালিকানা বনে প্রতিষ্ঠিত হোক। অবৈধ দখলদারেরা ভূমি থেকে উচ্ছেদ হোক, যার একটি প্রক্রিয়া নদীর ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হতে শুরু করেছে। কিন্তু এই বনে যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী বসবাস করে বনের সেবা করে গাছপালা ও পশুপাখিকে রক্ষা করছে, নিজেরা বেঁচে থাকছে, তাদের উৎখাত করে কোন উপকার হবে? ১৯২৭ সালের বন আইন বিলুপ্ত করে একটি নতুন আইন করা প্রয়োজন, যেটি বনের সুরক্ষা ও মানুষের স্বার্থ রক্ষা করবে। নইলে বাসন্তী রেমাদের দুঃখ-পীড়নের অবসান হবে না।

মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব