মসুল বিজয়ে দিয়ের এজরের পতন

‘পশ্চিম মসুলের পুনর্দখল শুরু হয়েছে’, আরবের বিভিন্ন পত্রিকার শিরোনাম এ রকম বা এর কাছাকাছি হয়েছে। এটা সত্য যে ইরাকি সেনাবাহিনী ও তার শিয়া মিত্ররা কিছু মার্কিন, তুর্কি, ব্রিটেন ও কুর্দি সেনা সঙ্গে নিয়ে মসুলের পুরোনো বিমানবন্দরের কাছে আইএসের ছেড়ে যাওয়া কিছু জমি দখল করে নিয়েছে। কিন্তু মসুলে আইএসের ওপর বিজয় দাবি করতে তাদের সপ্তাহখানেক বা এমনকি কয়েক মাসও লেগে যেতে পারে। এমনকি তারা যদি সফলও হয়, তাহলে আসল ধাক্কাটা লাগতে পারে সিরিয়ার কয়েক শ মাইল পশ্চিমের এক শহরে।

পশ্চিম মসুলে ইরাকি সেনারা গোলাবর্ষণ করে যে ধুলার মেঘ সৃষ্টি করেছে, তার পেছনে রয়েছে সিরিয়ার আরেক শহর দিয়ের এজর। যদিও ইরাকি প্রধানমন্ত্রী ও সমমনা মার্কিন জেনারেলরা যথারীতি সফলতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই শহরের সরকার-সমর্থকসহ ৯০ হাজার বেসামরিক নাগরিককে আইএস দুটি ছোট জায়গায় ঠেলে দিয়েছে। এই অঞ্চলের সরকারপন্থীদের হেলিকপ্টারে নানা রসদ সরবরাহ করা হয়েছে, যাদের নেতৃত্বে আছেন একজন হিংস্র দ্রুজ সিরীয় জেনারেল। তারা এই অঞ্চলে পাঁচ বছর ধরে টিকে আছে। কিন্তু আগামী কয়েক সপ্তাহে আইএস যদি মসুল থেকে বেরিয়ে যায়, তাহলে তাদের যোদ্ধারা হয়তো ৩৪০ মাইল পশ্চিমে এমন এক শহরে চলে যাবে, যেখানে তাদের সহযোদ্ধাদের ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। অন্য কথায় বলা যায়, মসুলের বিজয় মানে দিয়ের এজরের পরাজয়।

তবে গল্পটি এভাবে বলা হয়নি। এ কথা যদি আমরা ভুলেও যাই যে গত তিন বছরে মসুলে চারবার আইএসের বিরুদ্ধে বিজয়ের দাবি করা হয়েছে, তাহলেও এটা পরিষ্কার, ভূগোলবিষয়ক ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভ্রমাত্মক ধারণার কারণেও মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের বিরুদ্ধে তাঁর
জয় দরকার। তিনি যেসব নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার মধ্যে তিনি এটার সম্মান প্রথমত রাখতে পারবেন। সন্দেহ নেই, সে কারণেই ইরাকে ‘পাগলা কুকুর’ উপাধি পাওয়া জেনারেল জিম ম্যাটিস বাগদাদে গিয়ে মার্কিনপন্থী আরব সেনাদের মসুলমুখী অভিযাত্রায় উৎসাহ দিয়েছেন।

ইরাকি প্রধানমন্ত্রী হায়দার-আল এবাদি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ২০১৬ সালের বসন্তের মধ্যে মসুল মুক্ত করা হবে, যেটা ২০১৪ সালে আইএসের অধীনে চলে যায়। ফলে আইএসের বিরুদ্ধে একটি জয়ের জন্য তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছেন, যাদের বহুমুখী আক্রমণে তাঁর সবচেয়ে সুপ্রশিক্ষিত সেনাদের অর্ধেকই মারা পড়েছিল। পুরোনো পশ্চিম মসুলের প্রাচীন ও সরু রাস্তায় লড়াইয়ের সময় ইরাকি বাহিনীর ট্যাংক বা সমর যান তেমন একটা কাজে লাগবে না। পশ্চিম মসুলের লাখ পাঁচেক বেসামরিক নাগরিকের ওপর বোমাবর্ষণের কারণে সেখানে পূর্ব আলেপ্পোর সেই দুঃস্বপ্নের পুনরাবৃত্তি ঘটে, যখন পশ্চিমা নেতারা ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধাদের ওপর রাশিয়া ও সিরিয়ার বোমাবর্ষণের নিন্দা করেছিলেন।

ইরাকের ‘নতুন’ আক্রমণ সত্ত্বেও দৃশ্যপট নিদারুণভাবে সেই আগের মতোই। কারণ, তারা শুধু জনশূন্য গ্রামগুলোই কেবল দখল করতে পেরেছে: আইএসের যোদ্ধাদের পেছনে সাড়ে ছয় লাখ বেসামরিক নাগরিক আটকা পড়েছে, তবে সামনের দিকে কয়েকটি পালানোর পথ ও বিশাল নদী টাইগ্রিস রয়েছে। পরিহাস হচ্ছে, দিয়ের এজরের ভাগ্য মসুলের ওপর নির্ভর করলেও এই শহরটি প্রাচীন যুগল নদী ইউফ্রেটিসের ধার ঘেঁষে অবস্থিত, যে নদী পশ্চিমে সিরিয়া-আইএস ফ্রন্ট লাইনের ধার ঘেঁষে চলে গেছে। এ বছরের শুরুর দিকে আইএস দিয়ের এজরে সরকারনিয়ন্ত্রিত অঞ্চল দুই ভাগ করতে পেরেছিল, সিরীয় সেনারা শুধু শহরের বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পেরেছিল, তাও আবার বিমানবন্দরে মার্কিন বিমানবাহিনীর বড় ধরনের হামলার পর, যে হামলায় ৬০ জন সিরীয় সেনা মারা গিয়েছিল। মার্কিনরা বলেছে, ভুলক্রমে তারা এই হামলা করেছিল, যদিও সিরীয়রা বলে, এটা ইচ্ছাকৃত ছিল।

ট্রাম্প নির্বাহী আদেশ দিয়ে ইরাকিদের যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায় জেনারেল ম্যাটিসের কাজ হয়েছে প্রেসিডেন্টের নানা কথায় যেসব ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে, সেগুলোতে প্রলেপ দেওয়া। যেমন তাঁর প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ২০০৩ সালের ইরাক অভিযানের পর মার্কিন সেনাদের উচিত ছিল, ইরাকের তেল দখল করা। তিনি ইরাকিদের বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র কারও তেল দখল করার জন্য ইরাকে আসেনি। এই বিশ্বাস থেকেই হয়তো ইরাকি সেনাদের পশ্চিম মসুলের অগ্নিগর্ভ সড়কে কুচকাওয়াজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যথারীতি মার্কিন, ব্রিটিশ ও তুর্কিরা বিমান শক্তি প্রয়োগ করবে, কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে, স্থলযুদ্ধে ইরাকি, কুর্দি ও আইএসের শত্রুরাই বেশি অংশ নেবে, মারাও পড়বে মূলত তারাই।

সম্ভবত পশ্চিম মসুলে যে সাড়ে ছয় লাখ বেসামরিক মানুষ আটকা পড়েছে বলে জানানো হচ্ছে, এই সংখ্যাটা হয়তো অতিরঞ্জিত। পূর্ব আলেপ্পোতে যে আড়াই লাখ নারী, পুরুষ ও শিশু আটকা পড়েছে বলে বলা হচ্ছে, তার সংখ্যাটা ৯০ হাজারের কাছাকাছি মনে হয়। যুদ্ধ শেষ হলে পরেই এর সত্যতা জানা যাবে। কিন্তু জাতিসংঘসহ অন্যান্য মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থাকে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, তা সে সাংবাদিক, জেনারেল ও রাজনৈতিক নেতারা যা-ই বলুন না কেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে এর তুলনা দেওয়া সব সময় প্রবঞ্চনার শামিল, কিন্তু এই দ্বৈরথের যে প্রচারণা দেওয়া হচ্ছে তা থেকে আজকের যুদ্ধ-সম্পর্কিত শিক্ষা লাভের সুযোগ আছে। হিটলার ১৯৪২ সালের শরৎকালে স্টালিনগ্রাদে ‘বিজয়’ ঘোষণা করেছিলেন। শহরটি পুনর্দখল করতে রুশদের ছয় মাস লেগেছিল। আর মসুল দখলের সর্বশেষ যুদ্ধ শুরু হয়েছে কেবল চার মাস আগে।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া।

রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্ট-এর মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি