মহামারি ঠেকাতে বৈশ্বিক প্রতিরোধ দরকার

কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের কার্যক্রম বিশ্বজুড়ে গতি পাচ্ছে। এ ক্রমবর্ধমান গতিকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বনেতাদের সামনে জনস্বাস্থ্যের ভবিষ্যতের দিকে আরও বেশি নজর দেওয়ার সুযোগ এসেছে। অভ্যন্তরীণ উদ্যোগে এবং জি-২০, জি-৭ এবং জি-৭৭-এর মতো বহুপক্ষীয় সংস্থার মাধ্যমে কোভিড-১৯ কে রুখে দেওয়ার কাঠামোকে শক্তিশালী করার সময় এসেছে।

অভিন্ন এ লক্ষ্য অর্জনে অংশীদার দেশগুলোকে সহায়তা করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। অ্যাকসেস টু কোভিড-১৯ টুলস (এসিটি) অ্যাকসেলেটর কার্যক্রমের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সরকার, বহুপক্ষীয় সংস্থা, বহুজাতিক কোম্পানি ও বিশ্ব হিতৈষী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে পরিচালিত কার্যক্রমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পশ্চাৎপদ এলাকাতেও ভ্যাকসিন পৌঁছে যাচ্ছে।

বস্তুত এ মহামারির সময় আমরা আন্তর্জাতিক সংস্থা, সরকারি ও বেসরকারি খাতের নজিরবিহীন পারস্পরিক সহযোগিতা দেখেছি। যখন কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং অ্যাপের জরুরি প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল, তখন বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো নিজেদের ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভুলে জনস্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে এক হয়ে কাজ করেছে।

দ্রুততম সময়ের মধ্যে টিকা তৈরির পেছনে বিভিন্ন দেশের সরকার, বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বৃহৎ ওষুধ কোম্পানিগুলোর সমন্বিত ও সহযোগিতামূলক উদ্যোগ ভূমিকা রেখেছে। একই সঙ্গে করোনাসংক্রান্ত উপাত্ত সংগ্রহ ও মহামারির পূর্বাভাস ঘোষণার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ, প্রযুক্তি খাত ও সরকারি সংস্থার নজিরবিহীন সমন্বয় দেখা গেছে।

সরকারি পর্যায়ে প্রায় সব দেশেই যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকে, সেই জটিলতাকে পাশ কাটিয়ে দ্রুততম সময়ে সরকারি সিদ্ধান্ত নিতে দেখা গেছে। এটি বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে আমাদের অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষী হতে সহায়তা করছে।

দীর্ঘ মেয়াদে জনস্বাস্থ্যব্যবস্থার টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বিশ্বজনীন, সহজ প্রাপ্য ও ক্রয়সাধ্য চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আজকের দিনে এসেও স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো নিজেরাই তাদের প্রয়োজনীয় ডিজিটাল উপকরণ উৎপাদন করতে পারছে না। এর জন্য স্বাস্থ্য খাতের বাইরের অন্যান্য প্রযুক্তি খাতের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনের ওপর তাদের নির্ভর করতে হয়।

স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে আমাদের সবারই নজর প্রথম যে খাতের ওপর পড়ে, সেটি হলো প্রযুক্তি। জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে দ্রুত রোগ শনাক্ত করতে হয়। শনাক্তের পর রোগের সংক্রমণ ও প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হয়। এসবের জন্য শক্তিশালী নতুন ডিজিটাল সরঞ্জাম দরকার হয়। এ ধরনের সরঞ্জাম ও উপকরণ প্রায়ই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধার মুখে পড়ে। ইবোলা, জিকা এবং কোভিড-১৯–এর মতো ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি প্রচলিত অণুজীববিজ্ঞানের নজরদারি ব্যবস্থা দিয়ে এসব ভাইরাসের গতি বোঝা সম্ভব নয়। অত্যাধুনিক ডিজিটাল সরঞ্জাম এক দিক থেকে যেমন তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী হয়ে থাকে, অন্যদিকে তা অনেক বেশি কার্যকর হয়। তবে এ সুবিধা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হলে স্বাস্থ্যসেবায় আরও বেশি বরাদ্দ দেওয়ার বিকল্প নেই।

ভ্যাকসিন, রোগ নির্ণয়, স্যানিটেশন এবং রোগের গতিপ্রকৃতির দিকে সার্বক্ষণিক নজরদারি করা—মহামারি প্রতিরোধের প্রধান শর্ত। সে কারণে এসব খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে গেলে সত্যিকারের সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে।

বৈশ্বিক মহামারিকে বৈশ্বিকভাবে মোকাবিলা করতে হলে ২০০৮ সালের মহামন্দার পর যে বাণিজ্যিক স্থিতিশীলতা পর্ষদ গঠন করা হয়েছিল, ঠিক সেই মডেলে একটি বৈশ্বিক পর্ষদ গঠন করতে হবে। জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় যেভাবে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম হাতে নিয়ে সে অনুযায়ী বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে, একইভাবে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্বল্প, মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়ে বৈশ্বিক পর্ষদের মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত করতে হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানকে এসব কার্যক্রমে অর্থ বরাদ্দের বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করতে হবে। এসব অর্থ যথার্থভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে তাদের নজরদারি বাড়াতে হবে।

সর্বোপরি, বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলা করতে এবং সারা বিশ্বকে এ ধরনের হুমকি থেকে মুক্ত রাখতে গেলে বিচ্ছিন্ন ও স্থানীয় পর্যায়ের উদ্যোগ নিয়ে লাভ হবে না। এটিকে বৈশ্বিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

স্যালি সি ডেভিস কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের স্নাতকোত্তর ও ট্রিনিটি চ্যালেঞ্জের চেয়ার, জেরেমি ফারার ওয়েলকাম ট্রাস্টের পরিচালক এবং জিম ও’নিল চ্যাটাম হাউসের চেয়ার