মহামারিতে বিশ্বায়নের উল্টো চিত্র ও টিকার রাজনীতি

বৈশ্বিক মহামারি করোনা আমাদের পরিচিত জগৎকে পাল্টে দিয়েছে। সরকারগুলোর হিসাবে এ পর্যন্ত মৃত মানুষের সংখ্যা ৪২ লাখ ছাড়িয়েছে। আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১৯ কোটি ৯১ লাখের ওপরে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী প্রথম শনাক্ত হয়। পরবর্তী ২০ মাসে পৃথিবীর এমন কোনো জনপদ নেই, যেখানে অদৃশ্য এ ভাইরাস তাণ্ডব চালায়নি। দেশে দেশে ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা। অক্সিজেনের অভাবে শ্বাস নিতে না পেরে চোখের সামনেই হারিয়ে যাচ্ছে স্বজনেরা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনায় প্রকৃত আক্রান্ত ও মৃত্যু নথিভুক্ত আক্রান্ত ও মৃত্যুর যে সংখ্যা, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।

এত নিরাশার মধ্যে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন বিজ্ঞানীরা। করোনা মোকাবিলায় নজিরবিহীন দ্রুত সময়ের মধ্যে তাঁরা টিকা উদ্ভাবন করেছেন। বিশ্বে এ মুহূর্তে ১১টি টিকার উৎপাদন হচ্ছে। মারাত্মক সংক্রমণ ও মৃত্যু কমাতে টিকার কার্যকরিতাও প্রমাণিত। কিন্তু করোনা মোকাবিলায় সবচেয়ে কার্যকর এ অস্ত্র তৈরির ফর্মুলা গুটিকয়েক ধনী দেশের হাতে। টিকার ক্ষেত্রে ‘নিজের দেশ আগে’—এ রকম সংরক্ষণবাদী নীতি তারা নিয়েছে। গড়ে তুলছে বাড়তি টিকার মজুতও। এ কারণে মধ্যম ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোর স্বাস্থ্যকর্মী, বয়স্ক ও ঝুঁকিপূর্ণ মানুষ টিকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মৃত্যুর মিছিল থামানো যাচ্ছে না।

‘আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা’–এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ এ পর্যন্ত করোনার এক ডোজ টিকা পেয়েছেন। দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ। প্রতিদিন ৩ কোটি ৯৭ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৪১৮ কোটি ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এর সিংহভাগই পেয়েছে উচ্চ আয়ের দেশগুলো। উন্নত দেশগুলোয় প্রতি ১০০ জনে ৯৮ ডোজ টিকা পেয়েছেন। আর নিম্ন আয়ের দেশগুলোর মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ এক ডোজ টিকার আওতায় এসেছেন।

ইউরোপীয় কমিশনের বরাতে রয়টার্সে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, এ বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে ইউরোপের ৭০ শতাংশ মানুষকে দুই ডোজ টিকার আওতায় আনছে তারা। এ জন্য টিকা উৎপাদনকারী ফাইজার ও মডার্নার সঙ্গে নতুন চুক্তি হয়েছে। ডেলটা ভেরিয়েন্ট বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ায় টিকার যে চাহিদা বেড়েছে, তাতে কোম্পানি দুটি এরই মধ্যে টিকার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আগের চেয়ে সাড়ে তিন থেকে চার ডলার বেশি দামে টিকা কিনতে হচ্ছে।

গত জুন মাসে বিশ্লেষকদের ধারণা ছিল, এ বছরে টিকার বাজার হবে সাত হাজার কোটি ডলারের। কিন্তু মারাত্মক সংক্রমণক্ষম ডেলটা ভেরিয়েন্ট বিশ্বের ১৩২টির বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পরও অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন। কাউকে কাউকে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা তাই বুস্টার ডোজ টিকা দেওয়ার কথা বলছেন। ফলে, টিকার চাহিদা ও বাজার বাড়ছে। এ অবস্থায় কোম্পানিগুলো বাড়িয়ে দিচ্ছে টিকার দাম। শুধু মুনাফাকেন্দ্রিক এ প্রবণতা গরিব দেশগুলোর টিকা পাওয়ার নিশ্চয়তা আরও দুঃসাধ্য করে তুলছে।

টিকাকরণের এ বাস্তবতা বৈশ্বিক অন্যায্য ও অসমতাকে নগ্নভাবে প্রকাশ করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে ‘নৈতিক অনাচার’ বলে উল্লেখ করেছে। পুঁজি, পণ্য আর মানুষের অবাধ চলাচলের কারণে করোনা খুব দ্রুতই বৈশ্বিক সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে। কিন্তু টিকার বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। টিকা কোম্পানিগুলো অধিক মুনাফা অর্জন আর ধনী দেশগুলো টিকার জাতীয়করণ নীতি নিয়েছে। অথচ এ ক্ষেত্রে যুদ্ধকালে প্রস্তুতি ও বৈশ্বিক সংহতির দরকার ছিল। কিন্তু এ ধরনের কোনো বৈশ্বিক উদ্যোগের ব্যাপারে বিশ্বনেতারা সীমাহীন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন।

টিকা কোম্পানিগুলো অধিক মুনাফা অর্জন আর ধনী দেশগুলো টিকার জাতীয়করণ নীতি নিয়েছে। অথচ এ ক্ষেত্রে যুদ্ধকালে প্রস্তুতি ও বৈশ্বিক সংহতির দরকার ছিল। কিন্তু এ ধরনের কোনো বৈশ্বিক উদ্যোগের ব্যাপারে বিশ্বনেতারা সীমাহীন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন।

গত জুন মাসে জি-৭ সম্মেলনে ধনী সাতটি দেশ গরিব দেশগুলোর জন্য ৯০ কোটি ডোজ টিকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বৈশ্বিক প্রয়োজনের তুলনায় সেটা খুব সামান্য। কেননা, এ পরিমাণ টিকা দিয়ে বিশ্বের ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকেও টিকার আওতায় আনা সম্ভব নয়। জি-৭–এর এই নামমাত্র উদ্যোগের কড়া সমালোচনা করেছে খোদ জাতিসংঘ। তারা বলছে, করোনা মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল, তা নিতে ব্যর্থ হয়েছে জি-৭ জোট। তাদের এই ছোট পদক্ষেপে মহামারি বিদায় নেবে না।

গত মাসের শেষ দিকে দ্য গার্ডিয়ান–এ প্রকাশিত হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালকের কয়েকজন বিশেষ দূতের লেখা একটি নিবন্ধ। ডেলটা ভেরিয়েন্টের সংক্রমণের প্রেক্ষাপটে সেখানে তাঁরা সতর্ক করেছেন, বিশ্ব আরও ভয়ংকর একটা পরিস্থিতির সীমানারেখায় দাঁড়িয়ে আছে। এ অবস্থায় মহামারিকে পরাজিত করতে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। দুই পথের একটি নীতিগত পদক্ষেপের কথা তাঁরা সামনে এনেছেন। প্রথম পথটা হচ্ছে বিশ্বের প্রাপ্তবয়স্কদের টিকার আওতায় আনা। এ জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এ কাজে ধনী দেশ ও টিকা উৎপাদনকারীরা তাদের যেন প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়। দ্বিতীয়টা হচ্ছে সংক্রমণের শিকল ভেঙে দেওয়ার জন্য ব্যক্তি ও কমিউনিটিতে অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলা।

প্রথম পথটি যাতে খুব দ্রুত বাস্তবায়ন হয়, সে জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি জোর আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা। এ জন্য বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে কৌশল প্রণয়নের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রতিটি দেশের কমপক্ষে ১০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে সেটা বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ, আগামী বছরের জুনের মধ্যে ৬০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনার কথা বলেছে সংস্থাটি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, ৬০টি দেশ কোভ্যাক্সের (টিকার বৈশ্বিক উদ্যোগ) টিকার ওপর নির্ভরশীল। বৈশ্বিক টিকাকরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য পাঁচ হাজার কোটি ডলার তহবিলের প্রয়োজন। কিন্তু এ তহবিল কীভাবে জোগাড় হবে, তা নিয়ে খুব আশাবাদী পদক্ষেপ এখনো নেই। এ কারণে গরিব দেশগুলোর টিকা পাওয়া নিয়ে তীব্র অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। অথচ ধনী দেশগুলো টিকার অতিরিক্ত মজুত গড়ে তুলছে। টিকা উৎপাদন ও সরবরাহের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে ব্রিটেনভিত্তিক সংস্থা ইয়ারফিনিটি। তারা জানাচ্ছে, এ বছরের শেষে বাড়তি টিকার মজুত হতে পারে কমবেশি ২৬০ কোটি ডোজ।

আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি, যেখানে অসমতা ও অন্যায্যতার মহামারি তীব্র হচ্ছে। প্রতি মিনিটে বিশ্বে ১১ জন মানুষ মারা যাচ্ছে না খেতে পেয়ে। করোনায় মারা যাচ্ছে ৭ জন। তহবিল জোগাড় না হলে ভেস্তে যেতে পারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিকাকরণের উদ্যোগ। অথচ এ সময়েই টোকিওতে বসেছে ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল অলিম্পিক। বিশ্বের শীর্ষ ধনী জেফ বেজোসরা শত শত কোটি টাকা খরচ করে মহাকাশ ভ্রমণ করছেন। আলফা, বিটা, গামার পর ডেলটা ভেরিয়েন্ট এখন বিশ্বে তাণ্ডব চালাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বারবার সতর্ক করছেন, দ্রুততম সময়ে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশকে টিকার আওতায় না আনা গেলে নতুন নতুন ভেরিয়েন্টের জন্ম হতেই থাকবে। সে ক্ষেত্রে প্রচলিত টিকার কার্যকারিতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। বিশ্বায়নের এ যুগে কেউই সুরক্ষিত নয়, যতক্ষণ সবাই নিরাপদ না হচ্ছে। গরিব দেশগুলোর টিকা প্রাপ্তির ন্যায্যতা নিশ্চিতে ধনী দেশগুলোর দায় আছে।

মনোজ দে সংবাদকর্মী ও অনুবাদক