মহামারির পর শান্তি স্থাপনে যে পথ ধরতে হবে

নেলসন ম্যান্ডেলা: আমাদের জন্য হতে পারেন বড় অনুপ্রেরণা

ইংরেজ কবি জন মিলটন তাঁর প্যারাডাইস লস্ট বইয়ে সহিংস সংঘাতের অবসান ও টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ব্যাপারে এক অমোঘ সত্য উচ্চারণ করেছেন—‘যে জোর করে জয় করে, সে অর্ধেক শত্রু পরাস্ত করতে পারে।’ কলম্বিয়ার দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধ কীভাবে থামানো যায়, সে ব্যাপারে নকশা তৈরির জন্য এবং আমার নিজের বোঝাপড়ার জন্য এই অন্তর্দৃষ্টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমাদের সবার সামনে যে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, তার সঙ্গে এ দৃষ্টিভঙ্গি ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক।

শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বনেতাদের সহানুভূতিসম্পন্ন ও সংহতিপূর্ণ আচরণ করতে হবে। সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে কাজ ও আশাব্যঞ্জক নীতিগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে। কোভিড-১৯ মহামারি কাটিয়ে ওঠার জন্য আমাদের আরও সহনশীল পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে, যা ভবিষ্যতের ধাক্কা ও সংকটগুলো খুব ভালোভাবে সহ্য করতে পারে।

কোভিড-১৯-এর মানবিক অভিজ্ঞতা আমাদের সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে জীবন কতটা মূল্যবান, কতটা ভঙ্গুর এবং কতটা পরস্পরের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। আমরা যখন মহামারি-পরবর্তী সময়ের নানা সংকট থেকে বের হয়ে আসার পরিকল্পনা করতে শুরু করেছি, তখন আমাদের পূর্ববর্তী সফল নেতাদের উত্তরাধিকার থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজে পাই। এ ক্ষেত্রে নেলসন ম্যান্ডেলার চেয়ে ভালো কোনো উদাহরণ নেই।

ম্যান্ডেলা ছিলেন অসীম আগ্রহী এক দৃঢ়সংকল্পের মানুষ। তিনি জাতিগত নিপীড়নের কলঙ্কিত ব্যবস্থাকে ছুড়ে ফেলেছিলেন এবং তাঁর প্রজন্মের সর্বশ্রেষ্ঠ শান্তির রূপকার হয়েছিলেন। ম্যান্ডেলা প্রায় তিন দশক ধরে অসহ্য যন্ত্রণাময় কারাভোগ করেছেন এবং তাঁর দেশের জনগণকে স্বাধীনতার পথে পরিচালনা করেছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি স্থিতিশীল ও বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা আজ পর্যন্ত টিকে আছে। ম্যান্ডেলার চিরকালীন নম্রতা এবং গণতন্ত্রের প্রতি লৌহকঠিন বিশ্বাস আধুনিক দক্ষিণ আফ্রিকার ভিত্তি স্থাপনে সহায়তা করেছে। তাঁর এ গুণগুলো সমগ্র বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করেছে।

কোভিড-১৯-এর মানবিক অভিজ্ঞতা আমাদের সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে জীবন কতটা মূল্যবান, কতটা ভঙ্গুর এবং কতটা পরস্পরের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত।

আমাদের এ সাধারণ মানবতাবোধ ম্যান্ডেলার ‘দ্য এল্ডার্স’কে খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে। এটি স্বতন্ত্র বৈশ্বিক নেতাদের একটি গ্রুপ, আমি নিজেও এ গ্রুপের একজন সদস্য। ২০০৭ সালের জুলাই মাসে জোহানেসবার্গে এ সংগঠনের উদ্বোধনী ভাষণে ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘যেখানে ভয় আছে, সেখানে সাহসকে সমর্থন করুন। যেখানে দ্বন্দ্ব আছে, সেখানে চুক্তিকে উৎসাহিত করুন এবং যেখানে হতাশা রয়েছে, সেখানে আশাকে অনুপ্রাণিত করুন।’

আজ এ মহামারির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের অবশ্যই ম্যান্ডেলার এ ধারণার প্রতি আবার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পারমাণবিক অস্ত্রের মতো অস্তিত্ববিনাশী হুমকি মোকাবিলার ব্যাপারেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। আমাদের সবার সংহতি গুরুত্বপূর্ণ—এ সত্যটুকু বিশ্বনেতাদের স্বীকার করতে হবে এবং সবার পক্ষে কাজ করার ব্যাপারে তাঁদের মানসিকতাকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।

এ উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও আশাবাদ খুবই দরকারি। কোভিড-১৯ মহামারির প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ২০২০ সালের মার্চে ‘বিশ্বব্যাপী যুদ্ধবিরতির’ আহ্বান জানিয়েছিলেন। এটা আশা করা হয়েছিল যে গত বছর এপ্রিলের শুরুতে যুদ্ধরত ১১টি দেশ জাতিসংঘ মহাসচিবের এ আহ্বানে খুব দ্রুত সাড়া দেবে। কিন্তু দেখা গেল, নিরাপত্তা পরিষদ গুতেরেসের আহ্বানকে সমর্থন করে একটি প্রস্তাব পাস করতেই তিন মাসের বেশি সময় নিল! শুধু তা-ই নয়, ২০২০ সালের পুরোটা জুড়ে তারা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও ক্ষোভ অব্যাহত রাখল, যা এখন পর্যন্ত চলছে।

এসব কারণে নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের জীবন ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সহিংস সংঘর্ষের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ৮ কোটিতে গিয়ে ঠেকেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ বছরের শেষের দিকে ১০ কোটি মানুষ ভয়াবহ খাদ্যসংকটের মুখে পড়বে। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৭০ লাখ।

এটা মূলত নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্যভুক্ত দেশের ব্যর্থতার ফল। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বিশ্বনেতাদের ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে তাঁদের এ ব্যর্থতাকে দেখতে হবে। এ ব্যর্থতাগুলোর মধ্যে রয়েছে মহামারি রোধে সমন্বয়হীনতা ও অপর্যাপ্ত তথ্য আদান-প্রদান, বিশ্বের অর্থনীতি রক্ষায় জি-২০-এর অপ্রতুল সহযোগিতা এবং ‘ভ্যাকসিন বর্ণবাদ’ নিয়ে নৈতিক বিপর্যয়।

এসব চ্যালেঞ্জের কারণে আমরা সহজেই হতাশ হয়ে পড়ি। তবে আমি নিজে হতাশ নই। আমি আশাবাদী এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে আমরা মহামারি থেকে আবার উঠে দাঁড়াব। আমাকে আশাবাদী করে আমার স্বদেশীয় মহান লেখক, নোবেলজয়ী সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, ‘বন্যা বা মহামারি, দুর্ভিক্ষ বা প্রলয়, এমনকি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলমান অনন্ত যুদ্ধ ও মৃত্যু, কোনো কিছুই জীবনের অবিরাম সুবিধাকে কেড়ে নিতে পারে না।’

সেই চেতনাকে ধারণ করে আমাদের অবশ্যই শান্তি স্থাপনের জীবনপ্রত্যয়ী কাজটি চালিয়ে যেতে হবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

হুয়ান মানুয়েল সান্তোস কলম্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী