প্রাণচঞ্চল ও শিল্পীমনা ছিলেন মহিউদ্দীন হায়দার। গল্প, কবিতা ও গান লিখতেন। রাজশাহী ও রংপুরের অনেক শিল্পীই তাঁর অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।
কর্মজীবনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ব্যক্তিগত ক্ষতি স্বীকার করেছেন অনেক। তবু পিছপা হননি। অবশেষে জীবন দিয়েছেন ঠিক একই কারণে।
রেডিও পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ বেতার) অনুষ্ঠান সংগঠক ছিলেন মহিউদ্দীন হায়দার। একাত্তরে রংপুর কেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন।
১৫ আগস্ট সকালে সরকারি গাড়িতে অফিসের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। গাড়িটি বেতারকেন্দ্রের গেট দিয়ে ঢোকার সময় সেখানে প্রহরারত পাকিস্তানি সেনাদলের এক সেনা গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি করে।
গাড়িতে একটি বোমা পাওয়ার অজুহাতে সেনারা তাঁকে আটক করে। এরপর তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
সেনারা তাঁকে সেনানিবাসে নিয়ে নির্যাতনের পর হত্যা করে।
হত্যার সঠিক তারিখ পরিবারের কারও জানা নেই। তাঁর বড় ভাই জিয়াউদ্দীন হায়দারের স্মৃতিচারণা থেকে এ ঘটনা ও তাঁর সম্পর্কে জানা যায়।
তিনি লিখেছেন, ‘ছেলেবেলা থেকেই মহিউদ্দীন সাহসী, স্পষ্টভাষী ও কিছুটা ভিন্ন স্বভাবের ছিল।
এক বোন ও ছয় ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট হওয়ায় তার দুরন্তপনায় বাড়ির সবাই উৎকণ্ঠিত থাকতেন। বাবা-মা তখন বৃদ্ধ হতে চলেছেন।
কাজেই অগ্রজ হিসেবে আমার ওপর কিছুটা দায়িত্ব এসে পড়ে তার ব্যাপারে। তাকে আদর-শাসন দুটোই আমাকে করতে হতো।
‘একাত্তরে মহিউদ্দীন প্রোগ্রাম অর্গানাইজার হিসেবে রংপুর বেতার কেন্দ্রে কর্মরত ছিল।
২৫ মার্চের আগে সে সপরিবারে দিনাজপুরে আমার মেজো ভাই শামসুদ্দীন হায়দারের বাসায় যায়।
পরে অবস্থার অবনতি লক্ষ করে মেজো ভাই সপরিবারে ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে। মহিউদ্দীনকেও সে তার সঙ্গে যেতে বলে।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। মহিউদ্দীন ওপারে না গিয়ে স্ত্রী ও ছেলেকে দিনাজপুর মিশন হাসপাতালে ভর্তি করে কারফিউ পাস নিয়ে রংপুরে ফিরে আসে।
কয়েক দিন পর ওই হাসপাতালে তার ছোট ছেলের জন্ম হয়।
কিছুদিন পর কোনো এক উর্দুভাষী আইনজীবীর সহায়তায় স্ত্রী-সন্তানদের রংপুরে নিয়ে আসে।
বাংলার একদিন জয় হবে, এই নিশ্চিত বিশ্বাস নিয়ে সে তার ছোট ছেলের নাম রাখে জয়।
‘সবার ধারণা, ওই পশ্চিমা অ্যাডভোকেট বন্ধুটিই তার সর্বনাশ করেছেন। এই অ্যাডভোকেট স্থানীয় মার্শাল ল কোর্টের উপদেষ্টা ছিলেন।
১৫ আগস্ট রোববার ছুটির দিন হলেও মহিউদ্দীন জরুরি কাজের জন্য অফিসে রওনা হয়।
বেতার কেন্দ্রের গাড়িতে চেপে কেন্দ্রের গেটে পৌঁছামাত্র পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী গাড়িটি তল্লাশি করা হয়।
গাড়ির আসনের নিচ থেকে একটি বোমা উদ্ধার করা হয়েছে বলে চিৎকার করে সেখানে কর্তব্যরত সামরিক অফিসারকে জানায়।
এই মিথ্যা অজুহাতে কয়েকজন সহযাত্রীসহ তাকে স্থানীয় সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়।
দুই দিনের মধ্যে সবাইকে ছেড়ে দিলেও মহিউদ্দীন ও চালককে তারা ছাড়েনি। পরে তাকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা সফল হয়নি।
‘পরে জেনেছিলাম, পাকিস্তানি সেনারা শ্যামপুর মিলের কাছে বধ্যভূমি, চিনিকলের নিজস্ব পরীক্ষামূলক ফার্মের জমিতে মহিউদ্দীনের মৃতদেহ পুঁতে রেখে চলে যায়।
মিলের লোকেরা তখনই মাটি খুঁড়ে স্যুট পরিহিত অবস্থায় মহিউদ্দীনের লাশ বের করে। তারা ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তার ধারে জানাজা পড়ে তাকে সমাহিত করে।
এ কথা জেনেছিলাম ওই মিলের জেনারেল ম্যানেজার মোসলেহউদ্দীন সাহেবের কাছে। তিনি আমার ছোট ভাইকে শনাক্ত করেন।
তিনিই এই দুঃসংবাদটি আমাদের জানিয়েছিলেন (পরিমার্জিত)।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, প্রথম খণ্ড, প্রকাশ ১৯৮৮, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।
মহিউদ্দীন হায়দারের জন্ম ১৯৩৫ সালের ৫ জুলাই, পাবনায়। বাবা শিক্ষাবিদ সদরুদ্দীন আহমেদ। মা নেগজান বেগম।
তাঁর বড় ভাই জিয়াউদ্দীন হায়দার ছিলেন কবি; সেজো ভাই ডা. সাঈদ হায়দার ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে শুধু জড়িতই ছিলেন না, প্রথম শহীদ মিনারের নকশাও করেছিলেন।
পঞ্চম ভাই সুজা হায়দার চিত্রশিল্পী। তাঁর ডাক নাম পল্টু। তাঁর পড়াশোনার হাতেখড়ি পাবনা শহরেই।
১৯৫৩ সালে পাবনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, পাবনার অ্যাডওয়ার্ড কলেজ থেকে ১৯৫৫ সালে আইএ ও ১৯৫৭ সালে বিএ পাস করেন।
মাঝে রংপুর কারমাইকেল কলেজে কিছুদিন লেখাপড়া করেন। বিএ পাসের পর আইন বিষয়ে পড়াকালে ওয়াপদায় চাকরি নেন।
সংস্কৃতিমনা মহিউদ্দীন হায়দার এ চাকরি বেশি দিন করেননি। পরে রেডিও পাকিস্তানে যোগ দেন। মহিউদ্দীন হায়দার দুই ছেলেসন্তানের জনক। স্ত্রী খুরশিদা বেগম।
প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (ষষ্ঠ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৭) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান