মাদক–বাণিজ্য ও খুনোখুনির বিস্তার সন্দেহজনক

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির
প্রথম আলো ফাইল ছবি

রোহিঙ্গা সংকট প্রতিদিন প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। সম্প্রতি আবারও খুনের ঘটনা ঘটে চলেছে রোহিঙ্গা শিবিরে। ২০১৮ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত নিহত হলো কমপক্ষে ১০০ জন রোহিঙ্গা। তার মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার সংখ্যাই বেশি। প্রায় ৬৮ জন। অথচ গত বছরও ডেইলি স্টার-এর শিরোনাম ছিল—রোহিঙ্গা শিবিরে ২ বছরে ৪৩ খুন, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ৩২ (২৫ আগস্ট ২০১৯)। চলতি মাসের ৪, ৫ ও ৬ তারিখ পরপর তিন দিনে সাতজন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। আগ্নেয়াস্ত্রসহ আটকও হয়েছে ৯ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী।

কেন হচ্ছে খুনোখুনি? সাধারণ্যে ধারণা, খুনোখুনির কারণ মাদক ব্যবসা ও অপরাধজগতে প্রভাব বিস্তারসংক্রান্ত বিরোধ। কিন্তু সমস্যাটাকে এতটা সহজ করে দেখা ঠিক নয় সম্ভবত। শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো মাদক শুধুই মাদক নয়। মাদক মিসাইলের মতো অস্ত্র। একে-৪৭-এর চালান বা ভূমি থেকে আকাশে বহনযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের চালান পরিবহন সহজ কাজ নয়। কিন্তু ইয়াবা বা মেথাম্ফিটামিন অথবা অন্যান্য মাদক পাচার সহজ। মাদকের আয় আকাশচুম্বী। সেই আয় দিয়েই সন্ত্রাসীরা অস্ত্র কেনে। আফগানিস্তানে যেমন তালেবানও হেরোইন বিক্রির টাকায় অস্ত্র কেনে!

প্রথম আলোর ২০১৮ সালের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন জানিয়েছিল যে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে রীতিমতো মাদক কারখানার বিস্তার ঘটেছে। প্রতিবেদনটি থেকে কয়েকটি বাক্য হুবহু তুলে দিচ্ছি—মিয়ানমার এলাকায় ইয়াবার করখানা আছে ৪০টি। এর মধ্যে ‘ইউনাইটেড ওয়া স্টেইট আর্মি’ নামে আন্তর্জাতিক মাদক পাচারকারী সংগঠনেরও চারটি কারখানা রয়েছে। অন্যগুলোর মালিক মিয়ানমারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। ওই কারখানাগুলোতে তৈরি ইয়াবা মিয়ানমারভিত্তিক ১০ জন ডিলার বাংলাদেশের এজেন্টদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে (২৬ আগস্ট)। এ বাস্তবতায় এমন সন্দেহ করা অমূলক নয় যে বাংলাদেশে ইচ্ছাকৃতভাবেই মাদক পাচার করা হচ্ছে। মাদকের অর্থকরী দিকটি বিবেচনায় নিলে এ সন্দেহ কিন্তু ডালে-পাতায় বাড়ে। দেখা যাক মাদক পাচার কীভাবে অর্থনৈতিক লাভালাভের বিষয় হয়ে উঠতে পারে।

এ বছরের ২৩ আগস্ট ধরা পড়া ১৩ লাখ ইয়াবার একটি চালানের বাজারমূল্যই নাকি আনুমানিক ৪০ কোটি টাকা (ভোরের কাগজ, ২৬ আগস্ট ২০২০)। পত্রিকাটি জানায়, ২০২০ সালে শুধু ৮ মাসেই ৫ কোটি ১৩ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। লক্ষণীয় যে ২০১৬ সালে উদ্ধার হয়েছিল দেড় কোটি ইয়াবা। প্রথম আলোর ২০১৮ সালের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয় যে সেই বছর শুধু প্রথম সাত মাসেই টেকনাফে ১ কোটি ৭৭ লাখ ৫৮ হাজার ১২১টি ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। পরবর্তী ২০ দিনের মাথায় আরও ১৩ লাখ ৮৭ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। অর্থাৎ টেকনাফে ২০১৭ সালের ২ কোটি এবং ২০১৮ সালে আড়াই কোটির বেশি উদ্ধার ইয়াবার সংখ্যা যোগ করা হলে বাজারমূল্য হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এ হিসাব শুধু টেকনাফ-কক্সবাজার এলাকায় ছিটেফোঁটা যেটুকু ধরা পড়েছে সেগুলোর। না ধরা পড়া চালানের সংখ্যা যে বহু বহুগুণ বেশি, সেটি বুঝতে রকেটবিজ্ঞানী হতে হয় না। এ সুবিশাল মাদক বিক্রয়লব্ধ অর্থ মিয়ানমারেই যাচ্ছে।

একে এ এলাকায় অশান্তি জিইয়ে রাখার জন্য মিয়ানমারের কূটকৌশল হিসেবে বিবেচনা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আমরা দেখছি, সম্প্রতি মিয়ানমার বাংলাদেশের পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া বাধানোর মতো উগ্র উসকানিমূলক আচরণ করেই চলেছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের মতো সালিসি সংস্থায় বসেই মিথ্যাচার করার পাশাপাশি অকূটনৈতিক ভাষায় হুমকিও দিয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৫তম সভাটি বসে ২৯ সেপ্টেম্বর। রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ে বাংলাদেশের শালীন কূটনৈতিক অবস্থানটির প্রত্যুত্তরে মিয়ানমার উগ্র মারমুখী ভাষ্য প্রদান করে। সেই উসকানিমূলক ভাষ্যটির মর্মার্থ ক) রোহিঙ্গা সংকটের জন্য বাংলাদেশ দায়ী। খ) মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় চুক্তিমতো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সব ব্যবস্থা আন্তরিকভাবেই করেছে, কিন্তু বাংলাদেশ কোনো সহযোগিতা না করে অসৌজন্যমূলক ও শত্রুতামূলক আচরণ করছে। গ) বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের মধ্যে মিয়ানমারবিরোধী উগ্র জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদে মদদ দিচ্ছে। ঘ) চুক্তি মোতাবেক দ্বিপক্ষীয় সমাধানে না গিয়ে আন্তর্জাতিক মহলকে যুক্ত করার বাংলাদেশি চেষ্টা মোটেই ফলপ্রসূ হবে না, এবং ঙ) দ্বিপক্ষীয় ছাড়া অন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, এবং বাংলাদেশ যেন অবশ্যই কাম্য আচরণ করে।

মিয়ানমারের ভাষ্যটি ছিল ইংরেজিতে ‘বুলিং’ বলতে যা বোঝায় অনেকটা সে রকম। অথচ সারা দুনিয়া দেখছে যে মিয়ানমার অসাধারণ চতুরতার সঙ্গে সমস্যাটি এড়িয়ে চলেছে। বাংলাদেশের নানামুখী চেষ্টার পরও একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি। মাস দুয়েক আগে মিয়ানমারের সমর হেলিকপ্টার বাংলাদেশের কয়েক কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে পড়ে। সীমান্তেও প্রতিদিনই সৈন্য সমাবেশ বাড়াচ্ছে মিয়ানমার। সম্প্রতি ভারত থেকে একটি সাবমেরিনও সংগ্রহ করেছে দেশটি। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের, এ বিষয় আন্তর্জাতিকভাবে সুরাহা হওয়ার পরও মিয়ানমার সম্প্রতি আবার ঘোষণা দিয়েছে যে সেন্ট মার্টিন তাদের অংশ। স্পষ্টতই এসব আচরণের উদ্দেশ্য হুমকি-ধমকির মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর মানসিক চাপ জারি রাখা। গাম্বিয়াকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে মামলা করতে বাংলাদেশের দেওয়া সমর্থনে মিয়ানমার ক্ষুব্ধ হয়েছে।

মিয়ানমার কি যেকোনোভাবে প্রমাণ করতে চায় যে রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসী, জঙ্গি ও মানব পাচারকারী? এ রকম পরিচিতি নির্মাণ করতে পারলে মিয়ানমারের অনেক সুবিধা। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অস্বীকার করা যাবে। বাংলাদেশকে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের মদদদাতা নাম দিয়ে একাদিক্রমে দায়ী করে যাওয়া যাবে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে তিন বছরে মামলা হয়েছে ৭৩১টি। আসামি ১ হাজার ৬৭১ জন (আমাদের সময়, ৮ অক্টোবর ২০২০)। অথচ তাদের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে মাদকসংক্রান্ত মামলা ছিল ৭৯টি। তালিকায় মাত্র ১৩ নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গা শরণার্থীর নাম ছিল। গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ১১১ জন রোহিঙ্গা (প্রথম আলো, ২৬ আগস্ট ২০১৮)। অর্থাৎ মাত্র এক বছরেই জ্যামিতিক হারে বেড়েছে অপরাধের সংখ্যা, যা যেকোনো বিচারে অস্বাভাবিক।

এসব বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়েই বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকটের কৌশল-পাল্টা কৌশল নির্ধারণ করা প্রয়োজন। রোহিঙ্গাদের মধ্যে মাদককেন্দ্রিক অপরাধের বাড়বাড়ন্তকে খোলা নজরে না দেখে সন্দেহের চোখে দেখা দরকার।

হেলাল মহিউদ্দীন: নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক