মানবাধিকারের প্রশ্নে আপসহীন থাকলেন যে দার্শনিক

জার্মান দার্শনিক ইউরগেন হেবারমাস
ছবি: রয়টার্স

বয়সের ভারে ন্যুব্জ, তবু মাথা নোয়াবার নয়। বলছিলাম এই সময়ে জার্মানির স্বনামধন্য দার্শনিক ইউরগেন হেবারমাসের কথা। এ বছর তাঁর বয়স হলো ৯১, তবু এখনো সাক্ষাৎকার দেন, টেলিভিশনে আসেন। বিশ্বরাজনীতি ও সমাজব্যবস্থা নিয়ে নিজের যুক্তি ও দর্শনে অটল থাকেন।

এ দার্শনিক সম্প্রতি আরব সাহিত্য পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। শেখ জায়েদ, যা আরব সাহিত্য পুরস্কার নামে পরিচিত, তা এ বছরই গ্রহণ করার কথা ছিল। পুরস্কারটির মূল্যমান ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। কিন্তু দার্শনিক ইউরগেন হেবারমাস বিনয়ের সঙ্গে পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যান করেছেন।

কিন্তু কেন ইউরগেন হেবারমাস এই বিশাল অঙ্কের অর্থের সম্মানীয় পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করলেন! অঢেল ধনসম্পদ আর আরব বিশ্বে প্রতাপশালী আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ এ মুহূর্তে আরব সাহিত্য পুরস্কারটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ২০০৭ সাল থেকে আরব বিশ্বের সেরা লেখক, বুদ্ধিজীবী, প্রকাশক এবং বছরের সেরা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনকে সম্মানিত করার জন্য পুরস্কারটি চালু হয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রয়াত শাসক শেখ জায়দ বিন সুলতান আল নাহয়ানের স্মৃতির উদ্দেশ্যে পুরস্কারটি দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে পুরস্কারটি আরও অন্যান্য বিষয়ে বিস্তৃত হয়। ২০১৩ সাল থেকে এই পুরস্কারের নতুন বিন্যাসে উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতাসহ আরবি সভ্যতা ও সংস্কৃতিবিষয়ক চীনা, জার্মান ও ইংরেজি ভাষায় সর্বাধিক লিখিত রচনাগুলোকে সম্মানিত করার জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

এর আগের বছরের সেরা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সংগঠন হিসেবে ইউনেসকো, ফিলিস্তিনি কবি দেনস জনসন দাভিস, মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পেদ্রো মারটিনেজ মনটাভেজ, মোহম্মদ বিন রশিদ আল মাখতুম, লেবাননে জন্মগ্রহণকারী ফরাসি লেখক আমিন মালুফ, মরক্কোর দার্শনিক, ইতিহাসবিদ ও ঔপন্যাসিক আবদুল্লাহ লারউয়ি, মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মোহাম্মদ আল তায়েব, ফিলিস্তিনি লেখিকা সালমা খাদ্রা জাইউসি প্রমুখ সম্মানিত হয়েছেন।

পুরস্কারটি ইতিমধ্যেই বিশ্বে একটি সম্মানজনক পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত। ২০২১ সালে এই পুরস্কার ঘোষণার প্রাক্কালে, আবুধাবি সংস্কৃতি ও পর্যটন বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ খলিফা আল মোবারক এই বছরের মনোনয়ন সম্পর্কে বলেন, ‘শেখ জায়েদ বা আরব সাহিত্য পুরস্কারটি আধুনিক বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দার্শনিক এবং সমাজবিজ্ঞানীদের সম্মানিত করতে চেয়েছে। ইউরগেন হেবারমাস সমসাময়িক জার্মান দর্শনের একটি উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর দর্শন সভ্যতার মধ্যে সংলাপ ও বোঝাপড়া প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করেছে। সহনশীলতা ও সহাবস্থানের মূল্যবোধকে শক্তিশালী করেছে।’

আবুধাবি আরবি ভাষা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান আলী বিন তামিম ২০২১ সালের বছরের সেরা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে মনোনয়নের বিষয়ে বলেন, ‘সমসাময়িক সময়ে আমরা ইউরগেন হেবারমাসের মতো দার্শনিক, সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব খুব কমই খুঁজে পাই, যিনি ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে জার্মান সাংস্কৃতিক জীবনে প্রভাবশালী প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছেন। ইউরগেন হেবারমাসের মতো দার্শনিককে বছরের সেরা সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব হিসেবে মনোনয়ন আরবিসহ আন্তর্জাতিক সংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলবে এবং তাঁর দার্শনিক রচনা অন্যান্য সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করবে। এ ছাড়া এই পুরস্কার আরব বিশ্ব ও জার্মানির মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্কের বন্ধন তৈরি করবে।’

১৯২৯ সালে জার্মানির ডুসেলডর্ফ শহরে জন্মগ্রহণকারী ইউরগেন হেবারমাসকে জার্মানিতে সমাজনীতি ও দর্শন—উভয়ই ক্ষেত্রে সমালোচনামূলক তত্ত্বের পথিকৃৎ বলা হয়। তিনি বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী। একাডেমিক জগতে তাঁর বক্তৃতা, কর্ম এবং যুক্তিবাদী তত্ত্বের অবদানের সঙ্গে সামাজিক দর্শন নিয়ে কাজের মাধ্যমে তিনি পরিচিত। সর্বশেষ তিনি ফ্রাঙ্কফুর্ট গ্যোটে বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন।

জার্মানির জগদ্বিখ্যাত সব দার্শনিক ফ্রিডরিশ হেগেল, আর্থর শ্যাপেনহাওয়ার, ফ্রিডরিশ নিটসে, কার্ল মার্ক্স, কার্ল জেসপার প্রমুখর উত্তরসূরি সমসাময়িক জার্মান দার্শনিক ইউরগেন হেবারমাস শেষ পর্যন্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের কাছে সমর্পিত না হয়ে তাঁর পূর্বসূরিদের যশ ও খ্যাতিকে অম্লান রাখলেন।

দার্শনিক ইউরগেন হেবারমাস কয়েক সপ্তাহ আগে আরব সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্তির বিষয়টি জানতে পারেন। তবে তিনি শেষ পর্যন্ত এই পুরস্কার গ্রহণ করবেন কি না, তা নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন। সম্প্রতি জার্মানির স্বনামধন্য পত্রিকা ডের স্পিগেলে আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দুর্বল গণতন্ত্রকরণের বিষয়ে দুটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। সেই নিবন্ধে এ পুরস্কারের প্রধান পৃষ্ঠপোষক মোহাম্মদ বিন জায়েদকে অত্যন্ত বিতর্কিত রাজনীতিবিদ বলে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা, ফ্রিডম হাউস, গণতন্ত্র, রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারবিষয়ক গবেষণা জরিপ উদ্ধৃত করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের গণতন্ত্রচর্চা এবং মানবাধিকারের বিষয়গুলো খুব নিচের স্তরে বলে উল্লেখ করা হয়। নিবন্ধে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘দার্শনিক ইউরগেন হেবারমাস কি শেষ বয়সে তাঁর মত ও পথ পরিবর্তন করলেন!’

এরপর দার্শনিক ইউরগেন হেবারমাস এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এ পুরস্কারের বিষয়ে আমার সন্দেহ ছিল। পুরস্কারটি গ্রহণের সম্মতি দেওয়ার আগে আমি পুরস্কারদাতাদের সমন্ধে এবং এর আগে কারা এ সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন, তা জানতে চেয়েছিলাম। এ বিষয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার পরিচালক এবং ওই পুরস্কারের জুরি কমিটির সদস্য ইউরগুন বসের কাছে তথ্যাদি চেয়েছিলাম। তবে পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সবার নাম এবং দেশটির মানবাধিকার বিষয়ে আমাকে সঠিক তথ্য জানানো হয়নি।’ আবুধাবিতে চলমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং এ পুরস্কার প্রদানকারীদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের বিষয়টিও তাঁর কাছে যথেষ্ট পরিষ্কার ছিল না বলে জানান ইউরগেন হেবারমাস।

দার্শনিক ইউরগেন হেবারমাস বলেন, ‘শেখ জায়েদ বা আরব সাহিত্য পুরস্কারটি গ্রহণে সম্মতির বিষয়টি একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল এবং আমি এখন তা সংশোধন করেছি। আমার এ সিদ্ধান্ত যদি দেশটির গণতন্ত্র ও মানবাধিকারে সহায়ক হয়, তবে তা হবে আমার আজীবন লালিত দর্শনের জয়।’

জার্মানির জগদ্বিখ্যাত সব দার্শনিক ফ্রিডরিশ হেগেল, আর্থর শ্যাপেনহাওয়ার, ফ্রিডরিশ নিটসে, কার্ল মার্ক্স, কার্ল জেসপার প্রমুখর উত্তরসূরি সমসাময়িক জার্মান দার্শনিক ইউরগেন হেবারমাস শেষ পর্যন্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের কাছে সমর্পিত না হয়ে তাঁর পূর্বসূরিদের যশ ও খ্যাতিকে অম্লান রাখলেন।

সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি
Sharaf. [email protected]