মানসিক নির্যাতনের বিচার কে করবে

কেবল শরীরে দাগ পড়লেই বিচার করবে এই সমাজ? নোংরা মানসিকতা, নোংরা চিন্তা, নোংরা কথার কোনো বিচার হবে না?
ছবি : প্রতীকী

গত ২১ ডিসেম্বরের প্রথম আলো অনলাইনের একটা সংবাদে চোখ আটকে গেল। ভারতের চেন্নাইয়ে এক কিশোরী একটি চিরকুট লিখে আত্মহত্যা করেছে। সেই চিরকুটে সে লিখেছে, ‘মেয়েরা শুধু মাতৃগর্ভে ও গোরে নিরাপদ।’ কথাটা কেমন যেন তীরের মতো বুকে বিঁধে গেল। এই সংবাদের রেশ কাটতে পারল না, চোখের সামনে উঠে এল বিশ্বের দীর্ঘতম ‘অনিরাপদ’ সমুদ্রসৈকতে ঘটে যাওয়া লজ্জাজনক ঘটনা। চেন্নাইয়ের মেয়েটা কেন আত্মহত্যা করল? কারণ, একটা ছেলের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, সে মেয়েটিকে হয়রানি করছিল। মেয়েটি তার চিরকুটে লিখেছে, সে স্বপ্নেও মানসিক নির্যাতন দেখতে পেত। কী ভয়ংকর, কী নির্মম! মানসিক নির্যাতনের মাত্রা কোন মাত্রায় গেলে একজন কিশোরী এমনটা লিখে নিজেকে শেষ করে দিতে পারে! সেদিন এক পরিচিতা বলছিলেন, সহকর্মীরা তাঁকে নিয়ে, তাঁর শরীর নিয়ে আজেবাজে গল্প করে। ভাবা যায় অফিসের একদল সহকর্মী এসব নিয়ে ঠাট্টা–মশকরা করে, হাসাহাসি করে! অথচ দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তিনি। সহকর্মীরা এমন আচরণ কেন করেন? কারণ, দলের প্রধান হিসেবে সহকর্মীরা তাঁকে মেনে নিতে পারেন না।

কাগজে–কলমে এবং বিজ্ঞান–প্রযুক্তিতে আমরা একবিংশ শতাব্দীর বাসিন্দা। কিন্তু মানসিকতা দেখলে মনে হয়, আদিম যুগের মানুষও আমাদের অনেকের চেয়ে সভ্য ছিল। একটি ছেলে আর একটি মেয়ের মধ্যকার সম্পর্ক কোনো কারণে নষ্ট হয়ে গেলে আমরা প্রায়ই দেখি, ছেলেটি মেয়েটিকে হুমকি দিচ্ছে, ভয়ভীতি দেখাচ্ছে, হয়রানি করছে। কিন্তু কেন করে এমন আচরণ? এই হুমকি, হয়রানির পর একজন কি সত্যি আরেকজনের কাছে ফিরে যেতে পারে? সম্পর্কও কি সত্যি আগের মতো হয়ে যায়? সেটা হয় না। যা হয় তা হলো, পরিবেশ নোংরা হয়, কাদা–ছোড়াছুড়ি হয়। একপর্যায়ে হয়তো কোনো এক পক্ষ আত্মহত্যা করে, নয়তো আইনের মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আসে।

একজন পর্যটকের সঙ্গে স্থানীয় একদল ছেলের কথা-কাটাকাটি হলো, এ জন্য তাঁর স্ত্রীকে তুলে নিয়ে গিয়ে সহিংস আচরণ করতে হবে? সমাজের এই একদল মানুষের সব আক্রোশ নারীর ওপর কেন? কেন একজন সহকর্মী তাঁর নারী সহকর্মীকে নিয়ে কটাক্ষ করেন, বাজে কথা বলেন, টিজ করেন?

এ সব প্রশ্নের উত্তর বহুমাত্রিক। এই কু–অভ্যাস একদিনে হয় না। শুরুটা হয় পরিবার থেকে। একজন সন্তান যখন দেখে, তার পরিবারের নারী সদস্য পরিবারে অপমানিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত, তখন সে ধরেই নেয়, নারী মানেই অপমান করা যায়। কোনো ব্যক্তি যখন তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে কোনো নারীর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হন, তখন তাঁর মধ্যে একধরনের হিংসাত্মক মনোভাব তৈরি হতে পারে। যে বন্ধু বা স্বজন মহলে তিনি বেশির ভাগ সময় কাটান, সেই পরিমণ্ডলের একটা প্রভাব আছে। সবকিছু মিলে যে মনস্তত্ত্ব তাঁর ভেতরে তৈরি হয়, তা মোটেই সুস্থ নয়। আবার এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হলো, এই ধরনের মানসিকতার মানুষেরা দেখছেন না তাঁদের এই আচরণের জন্য কারও শাস্তি হচ্ছে। এ কারণে কেউ কেউ হয়ে ওঠেন বেপরোয়া।

কাগজে–কলমে, প্রযুক্তিতে আমরা একবিংশ শতাব্দীর বাসিন্দা। কিন্তু অনেকের মানসিকতা দেখলে মনে হয়, আদিম যুগের মানুষও এখনকার মানুষের চেয়ে সভ্য ছিল। একটি ছেলে আর একটি মেয়ের মধ্যকার সম্পর্ক কোনো কারণে নষ্ট হয়ে গেলে আমরা প্রায়ই দেখি, ছেলেটি মেয়েটিকে হুমকি দিচ্ছে, ভয়ভীতি দেখাচ্ছে, হয়রানি করছে। কিন্তু কেন করে এমন আচরণ? এই হুমকি, হয়রানির পর একজন কি সত্যি আরেকজনের কাছে ফিরে যেতে পারে? সম্পর্কও কি সত্যি আগের মতো হয়ে যায়?

অনেকের ধারণা ছিল, যাঁরা নিম্নবিত্ত, শিক্ষা–দীক্ষার আলো যাঁদের ঘরে পৌঁছায়নি, তাঁদের মধ্যে বোধ হয় নারী নির্যাতন বেশি হয়। কিন্তু বিষয়টি আর তেমন রইল কোথায়? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রুমানা মঞ্জুর মানসিক নির্যাতন তো সয়েই গিয়েছিলেন, কিন্তু শারীরিক নির্যাতন থেকে বাঁচতে পেরেছিলেন কি? প্রাণে বেঁচে গেলেও সারা জীবনের মতো দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। কিন্তু একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ইলমা আবার অত সৌভাগ্য নিয়ে জন্মাননি। শ্বশুরবাড়ির নির্যাতনে প্রাণটাই হারাতে হয়েছে।

মানসিকভাবে আমরা এমন এক জায়গায় পৌঁছে গেছি যে আপনার জীবনে যা–ই ঘটুক না কেন, এর প্রভাবটা নারীর ওপর খাটাতে পারলে যেন সুবিধা হয়। যেন একজন নারীর চলাফেরা থেকে শুরু করে যেকোনো বিষয় নিয়ে যে কেউ কোনো কারণ ছাড়া, জবাবদিহি ছাড়া যেকোনো কথা বলার অধিকার রাখে। মনের মধ্যে কত হিংসা–বিদ্বেষ থাকলে মানুষ এভাবে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে?

অথচ নারীর প্রতি শারীরিক, মানসিক সব ধরনের নির্যাতনেই শাস্তির বিধান আছে। কক্সবাজারের শারীরিক সহিংসতার শিকার নারী দেশের প্রচলিত আইনে হয়তো সুবিচার পাবেন। কেননা, শারীরিক নির্যাতনের প্রমাণ নিয়ে আইনের দ্বারস্থ হওয়ার প্রচলন আছে। কিন্তু এই যে মানসিক নির্যাতন, তার বিচার কে করবে? সেটা প্রমাণেরই–বা উপায় কি? কে জানে, মানসিক নির্যাতনের বিচার হয় না বলেই হাজারো কিশোর–কিশোরী আত্মহত্যার পথ বেঁচে নেয় কি না?

পরিবেশ একটা বড় প্রভাবক হিসেবে একজন মানুষের জীবনে কাজ করে। আমরা নারীর সম্মানের কথা বলি, সমতার কথা বলি। কিন্তু আমরা কি জানি, সম্মান আসলে কী, কীভাবে করতে হয়? যেমনটা কাজির গরু কিতাবে আছে গোয়ালে নেই, তেমনই আমাদের বিধানে নারীকে সম্মানের কথা বলা আছে, কিন্তু ঘরে-বাইরে কোথাও নারীর সম্মান নেই। নারীকে অবমাননা করলে তার শাস্তির কথা বলা আছে, কিন্তু সেই শাস্তির পর্যাপ্ত উদাহরণ নেই। জেন্ডার বাজেটে বরাদ্দও আছে, কিন্তু সমতা নেই। এমন হাজারো উদাহরণ আমাদের সামনে আছে।

নতুন একটি বছর শুরু হলো। নতুন বছরে মানুষ নতুন প্রতিজ্ঞা করবে। কিন্তু মানসিক অত্যাচারের বিচারের কথা কেউ ভাববে না? কেউ ভাববে না, কীভাবে একটা মেয়েকে বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ ঘর, চলাচলের জন্য নিরাপদ সড়ক, পড়াশোনার জন্য নিরাপদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জীবনযাপনের জন্য নিরাপদ বন্ধু-সঙ্গী, কাজের জন্য নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করা যায়? একজন খারাপ মানসিকতার মানুষ, সে সম্পর্কে যেই হোক না কেন, তার শাস্তি হোক। শারীরিক নির্যাতন করা হলে যেমন কঠিন শাস্তি হয়, তেমনই মানসিক নির্যাতনেরও শাস্তি হোক। শাস্তি হোক সেই মানুষটার, যে কিনা সম্পর্কের জের ধরে অপরজনকে হয়রানি করছে। শাস্তি হোক সেই আত্মীয়ের, যে খেলার ছলে একটি কন্যাশিশুর শৈশব নষ্ট করে দিচ্ছে। শাস্তি হোক সেই সহকর্মীর, যে তাঁর নারী সহকর্মীকে নিয়ে কুৎসা করেন, বাজে মন্তব্য করেন। কেবল শরীরে দাগ পড়লেই বিচার করবে এই সমাজ? নোংরা মানসিকতা, নোংরা চিন্তা, নোংরা কথার কোনো বিচার হবে না?

মাহবুবা সুলতানা প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক