মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে


৮০-এর দশক থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি পোশাকশিল্প। পোশাকশিল্প বাদ দিয়ে বর্তমান বাংলাদেশের অর্থনীতি চিন্তাই করা যায় না। অথচ বাংলাদেশে পোশাকশ্রমিকদের বেতন পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্নে। পাকিস্তানেও পোশাকশ্রমিকদের বেতন বাংলাদেশের প্রায় দ্বিগুণ। এমনকি মিয়ানমারও তাঁর শ্রমিকদের আমাদের চেয়ে বেশি বেতন দেয় (মাসিক বেতন ডলারে, ২০১৯-এর হিসাব অনুযায়ী: পাকিস্তান ১১১, মিয়ানমার ৯৪, বাংলাদেশ ৬৩)। অথচ বাংলাদেশের জিডিপিতে পোশাকশ্রমিকদের অবদান অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। চীন বাংলাদেশের শ্রমিকদের চেয়ে ৪.৫ গুণ বেশি বেতন দেয়।

বাংলাদেশে বেতন ছাড়া শ্রমিকদের জন্য আর কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই বললেই চলে। তাঁদের কাজের পরিবেশও ভীষণ অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ। ২০১৩ সালে সাভারে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় আইএলওর হিসাব অনুযায়ী ১ হাজার ১৩২ শ্রমিক নিহত এবং আড়াই হাজারের বেশি আহত হন। ম্যানেজমেন্টের লোকদের হাতে নারী শ্রমিকেরা বিভিন্নভাবে নিগ্রহের শিকার হন। নিগ্রহের মধ্যে আবার যৌন হয়রানির ঘটনাই বেশি। সবচেয়ে যেটা মর্মান্তিক, সংসারের দায় মেটাতে এই যৌন হয়রানিও তাঁরা নীরবে মেনে নেন। হয়তো বৃদ্ধ পিতা অসুস্থ, তাঁর জন্য ওষুধ কিনতে হবে; হয়তো ছোট ভাই স্কুলে যায়, তাকে টাকা পাঠাতে হবে।

শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত মানুষেরা বাড়িতে গৃহকর্মী রাখেন, যাঁদের তাঁরা নাম দিয়েছেন ‘কাজের মেয়ে’ বা ‘কাজের ছেলে’। কাজের মেয়ে বা কাজের ছেলে নামের মধ্যেই নিহিত রয়েছে বাঙালি সমাজের সহস্র বছরের অবজ্ঞার নিদর্শন। এই কাজের ছেলেমেয়েকে অধিকাংশ গৃহস্থই খেতে দেন উচ্ছিষ্ট খাবার অথবা আলাদাভাবে রান্না করা মোটা চালের ভাত, শুতে দেন ঘরের মেঝেয়। শুধু রাতে ঘুমানোর সময়টুকু ছাড়া তিনি সারা দিন কাজ করেন।

অতএব, তাঁর বেতন হওয়ার কথা প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টার সমান। অথচ তিনি মাসে বেতন পান গড়ে ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা। এমন শ্রমশোষণ পৃথিবীর আর কোথাও আছে কি না, জানা নেই। এমন অমানবিক দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায় যে গৃহকর্তার ১৫-১৬ বছরের ছেলের স্কুলব্যাগ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে ৯-১০ বছরের কাজের মেয়ে। কাজের ছেলেমেয়েদের টেলিভিশন দেখার সুযোগ থাকলেও সোফায় বসার অনুমতি নেই। গাড়ির ড্রাইভারকেও তাঁরা টেবিলে খেতে দেন না।

যাঁরা বড় কর্মকর্তা পর্যায়ে সরকারি চাকরি করেন, তাঁদের সেবাদানের জন্য যে সংখ্যায় পিয়ন, পেয়াদা, আরদালি ও সহকারী থাকে, উন্নত দেশে তা কল্পনাই করা যায় না। সে দেশের একজন ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলরও ক্যাফেতে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে কফি কেনেন, নিজের গাড়ি নিজে চালান।

বাঙালি সমাজে নিম্নবর্গের মানুষের প্রতি উচ্চবর্গের মানুষের এই যে দৃষ্টিভঙ্গি, এ হলো সামন্ত দৃষ্টিভঙ্গি। সামন্তব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়েছে, সামন্ত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়নি। পুঁজির বিকাশ ঘটেছে, মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণ করা হচ্ছে, কিন্তু আমরা পুঁজিবাদের উদারতাটুকু অর্জন করতে পারিনি, সমাজে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। যাঁরা বড় কর্মকর্তা পর্যায়ে সরকারি চাকরি করেন, তাঁদের সেবাদানের জন্য যে সংখ্যায় পিয়ন, পেয়াদা, আরদালি ও সহকারী থাকে, উন্নত দেশে তা কল্পনাই করা যায় না। সে দেশের একজন ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলরও ক্যাফেতে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে কফি কেনেন, নিজের গাড়ি নিজে চালান।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে দেখা গেছে মেট্রোতে সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে অফিসে যেতে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশের প্রধানমন্ত্রীরা অনেকেই নিজ হাতে বাজার করে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরেন। সাউথ আমেরিকার এক দেশের এক প্রধানমন্ত্রীকে একবার দেখা গেল, পায়ে হেঁটে সেলুনে গিয়ে চুল কেটে আসতে।

ইংল্যান্ডে দেখেছি, ইউনিভার্সিটিতে কর্মচারী থেকে শুরু করে প্রফেসর পর্যন্ত কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কার পেয়ে থাকেন। বার্ষিক ডিনারে পুরস্কারপ্রাপ্তরা সবাই ভাইস চ্যান্সেলরের সঙ্গে একই টেবিলে খেতে বসেন। শৌচকর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন ফ্যাকাল্টির ডিন—সবাই থাকেন সেখানে। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, কে ভাইস চ্যান্সেলর আর কে শৌচকর্মী।

সনাতন ধর্মে যাঁদের পৌরোহিত্যের অধিকার আছে, তাঁদেরই সাধারণত ব্রাহ্মণ বলা হয়ে থাকে, কিন্তু আসলে সব উঁচু শ্রেণির মানুষই নিজেকে ব্রাহ্মণ ভাবেন। হিস্ট্রি অব মডার্ন ইন্ডিয়া গ্রন্থে বিপন চন্দ্র বলছেন, ভারতের শাসনভার অর্পিত হলো এমন একটা গোষ্ঠীর হাতে, যাঁরা গান্ধী-নেহরুর, সবাই সাধারণ মানুষের কাতারের লোক এবং প্রধানমন্ত্রীর শপথগ্রহণও হলো খোলা মাঠে গাছের ছায়ায় নিম্নবর্গের মানুষের ব্যাপক উপস্থিতিতে। অন্যদিকে, পাকিস্তানের শাসনভার চলে গেল ব্রাহ্মণদের হাতে এবং প্রধানমন্ত্রীর শপথগ্রহণ হলো রাজকীয় হলরুমে ঝাড়বাতির আলোর নিচে। তাই ভারতের এই উন্নতি আর পাকিস্তানের এই অধোগতি। তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তান বাঙালিকে যে এতটা দাবিয়ে রেখেছিল, তার কারণও ছিল ওই ক্ষমতাসীন ব্রাহ্মণদের অহংকার। বাঙালিকে তাঁরা মনে করেছিলেন খর্বকায়, শীর্ণ, কালো, গরিব ও মিসকিন।

স্বামী বিবেকানন্দ ব্রাহ্মণ্যবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি কলিযুগকে বলেছিলেন ‘শূদ্র জাগরণের যুগ।’ ভারত থেকে তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি বলেছিলেন, রাশিয়াতে সমাজতন্ত্র আসন্ন। শূদ্র জাগরণের যুগ বলতে তিনি আসলে শ্রমিকশ্রেণির শাসনকেই বুঝিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মণ্যবাদকে বলেছিলেন ঘোরতর অন্যায় ও অন্যায্য। বলেছিলেন, ব্রাহ্মণ্যবাদ চলতে থাকলে এই সমাজ টিকবে না। ব্রাহ্মণদের উদ্দেশে তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন এইভাবে:
হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!
মানুষের অধিকারে
বঞ্চিত করেছ যারে
. . .
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
. . .
বিধাতার রুদ্ররোষে
দুর্ভিক্ষের দ্বারে বসে
ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান।
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।

ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ।
[email protected]