মানুষের মন কীভাবে সারাই করা যাবে

এই বড় গৃহযুদ্ধের পর সিরিয়া কি একত্র থাকতে পারবে? আর তা যদি হয়, সিরিয়াকে যদি একত্র করা যায়, তাহলে মানুষের ক্ষত সারবে কী করে? এসব অলস কথা নয়, বিশেষ করে যখন সীমান্তের ওপারে লেবাননের মানুষেরা ১৯৭৫ সালে শুরু হওয়া শোকাতুর গৃহযুদ্ধের বার্ষিকী পালন করছে। লেবাননের মৃত মানুষদের সাংবাদিক ও রাজনীতিকেরা পুনরুজ্জীবিত করছেন, আবার তাদের কবরও দিচ্ছেন। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটছে। আমাদের হিসাবে লেবাননের গৃহযুদ্ধে দেড় লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। মাস দুয়েক আগে বৈরুতের এক তরুণ কর্মী হঠাৎ করেই বললেন, ওই যুদ্ধে দুই লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তো, এই অতিরিক্ত ৫০ হাজার মানুষের কী হলো? এরপর গত মাসে স্থানীয় এক সংবাদপত্র হিসাব দিল, এই সংখ্যাটা আড়াই লাখ। তাহলে এই অতিরিক্ত এক লাখের কী হলো?

সংখ্যার এই বিশৃঙ্খল পরিবর্তনটা মনে রাখা দরকার। সিরিয়ায় কত মানুষ মারা গেছে, তা গণনা করা সম্ভব নয়। জাতিসংঘ যখন বলল, সিরিয়ায় চার লাখ মানুষ মারা গেছে; তখন গণমাধ্যমও সেটা মেনে নিল। কিন্তু এই এক সপ্তাহের কিছু বেশি সময় আগে বিবিসি ওয়ার্ল্ড টেলিভিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হলো, সিরিয়ায় তিন লাখ মানুষ মারা গেছে। তাহলে এক লাখ মৃত মানুষকে কে কবর থেকে জাগিয়ে তুলল? এই সংখ্যা বা পরিসংখ্যান কতটা সত্য, তা জানা যাবে না। যুদ্ধে মারা যাওয়া মানুষদের স্মরণ করার একমাত্র উপায় কি এই পরিসংখ্যান?

সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মধ্য দিয়ে লেবাননের অন্ধকার অতীতের অবসান হয়। এই ঘোষণায় সব খুনিকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়, ফলে মৃত ব্যক্তিদের স্বজনেরা ন্যায়বিচার বা স্বস্তি কোনোটিই পাননি। লেবাননের ২০টি গণকবর এখনো স্পর্শই করা হয়নি, তবে বৈরুতে এ কথা বলা যাবে না। এগুলোর মধ্যে কিছু গণকবরের কথা সবাই জানে। যেমন দুটির কথা তো বলাই যায়, যার একটি সাবরা শাতিলা শিবিরে; ধারণা করা হয় আরেকটি বৈরুত বিমানবন্দরের পাশে গলফ কোর্সসংলগ্ন। মানুষ এগুলো খুঁড়তে ভয় পায়। আমি ধারণা করি: ‘তারা এতে আরও রক্ত ঢালতে চাইবে (ক্রোয়েশীয়রা যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার গণকবর খুঁড়তে শুরু করে, তখন এক নারী আমাকে এ কথা বলেছিলেন)।’

লেবানিজ সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটসের প্রেসিডেন্ট ওয়াদিহ্ আল-আসমার এই গণকবর খুঁড়ে মৃতদেহ শনাক্তকরণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। তিনি আবার সতর্ক করে দেন, যুদ্ধের সময় যাঁরা হারিয়ে গেছেন, তাঁরা যে সবাই মারা গেছেন—এমন কথা বিশ্বাসের কৈফিয়ত হিসেবে এটা নেওয়া যাবে না। অপরাধ হলে অপরাধীও আছে। কিন্তু জাতীয় ক্ষমার আওতায় এরা পার পেয়ে গেছে। কাতারের নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক সামি হারমেজ ওয়ার ইজ কামিং: বিটুইন পাস্ট অ্যান্ড ফিউচার ভায়োলেন্স ইন লেবানন শীর্ষকচমৎকার একটি বই লিখেছেন। তিনি এতে বলেছেন, এই ক্ষমা আইনের জন্য লেবানীয়রা ভুলে যাচ্ছে, তাদের দেশে এই অপরাধ হয়েছিল। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, দেশটির এই প্রজন্ম দেখেনি যে সম্ভাব্য অপরাধের জন্য ‘কারও বিচার হয়েছে বা কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে বা কাউকে অপরাধ স্বীকার করতে হয়েছে।’ রাজনৈতিক নেতাদের পরবর্তী সময়ে বিচার হতে পারে। কিন্তু নিরপরাধ মানুষের ওপর পরিচালিত সহিংসতা ক্ষমা করে দেওয়ার মাধ্যমে এটা যে অপরাধ, তা নিয়েই ধোঁয়াশা এবং নানা ব্যাখ্যার অবকাশ সৃষ্টি করা হয়েছে।

জার্মান নাগরিক ও লেবাননের আবাসিক চলচ্চিত্রকার ক্রিস্টিনা ফরেচ সাব স্মরণ করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের ইতিহাস ক্লাসের পাঠদানের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের জাদুঘর ও তৎকালীন নির্যাতন শিবিরে নিয়ে যাওয়া হতো। এর লক্ষ্য ছিল, যা হয়েছে তার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, সেটা নিশ্চিত করা। তিনি বলেন, ‘এরপর আমি যখন বৈরুতে এলাম, তখন দেখলাম, সেখানে এ রকম কিছু হচ্ছে না।’ তবে যাঁরা সেই যুদ্ধ দেখেছেন, তাঁদের মনে এর স্মৃতি তখনো তরতাজা।

লেবাননের ফরাসি ভাষার সংবাদপত্র এল ওরিয়েন্ত লে জুর-এর এক ফটোসাংবাদিক তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে দুঃখের দিনটির স্মৃতিচারণা করেছেন: ‘বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলের এক উপশহরে বোমা হামলায় নিহত ছোট বালিকাকে কবর দেওয়া হচ্ছিল। চোখ ছলছল হয়ে ওঠায় ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডার দিয়ে আমি কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। জনা কয়েক মানুষ কাফনের কাপড়ে জড়ানো মেয়েটির দেহ নিয়ে এলেন। তাঁরা নীরবে গোরস্তানের দিকে গেলেন। একজন শেখ নামাজ পড়ালেন। এরপর যে লোকটি মেয়েটির দেহ বয়ে আনছিলেন, তিনি দেহটিকে উঁচু করে ধরলেন। সম্ভবত তিনি মেয়েটির বাবা। এরপর তিনি ছোট্ট শরীরটি কবরে নামিয়ে রাখলেন। তাঁরা যে রকম নীরবে ও মর্যাদার সঙ্গে এসেছিলেন, মাটি দেওয়ার পর ঠিক সেভাবেই বেরিয়ে গেলেন। তাঁদের চোখে অশ্রু ছিল না। একধরনের ভারী দুঃখবোধ তাঁদের বুকে দুদ্দাড় আঘাত করছিল। সে কারণে দৃশ্যটি আরও অসহনীয় হয়ে ওঠে।’

প্রতি সপ্তাহে এল ওরিয়েন্তে হারিয়ে যাওয়া বা সম্ভাব্য মৃত মানুষদের ‘লিখিত’ একটি নিবন্ধ ছাপা হয়। চাহিন ইমাদ নামের এমন একজন লিখেছেন, ১৯৮২ সালের জুন মাসে ‘বিয়ের কয়েক মাস আগে আমরা হারিয়ে যাই।’ ভামদুন শহরের কাছে রক্ষীবাহিনীর এক তল্লাশিচৌকিতে তাঁকে থামানো হয়েছিল। এরপর তাঁকে আর কখনো দেখা যায়নি। ‘মৃতদের’ নামে ছাপা প্রতিটি নিবন্ধ একই কথা দিয়ে শেষ হয়: ‘আমাদের গল্প এখানেই শেষ হতে দেবেন না।’

ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রেডক্রস ও দুটি এনজিও লেবাননের যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের স্মৃতিচারণা করার প্রকল্পে টাকা দিচ্ছে। কিন্তু সিরিয়ার যুদ্ধে লেবাননের যুদ্ধের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ মারা ও হারিয়ে যাবে। তাদের সংঘাতের পরিসর আরও বড়। বিশাল বিশাল শহর ও নগর মাটিতে মিশে গেছে। চলমান সিরীয় যুদ্ধের মধ্যেও পুনঃসমঝোতা প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু এখানকার মানুষের মন কীভাবে সারাই করা যাবে? লাখ লাখ সিরীয় মানুষের মনের মধ্যে এই যুদ্ধ ঢুকে গেছে। সেটা থেকে যাবে। 

অনূদিত, ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া।

রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি