মামলার রায় বাংলায় লিখতে হলে যা করতে হবে

.
.

ভাষার মাস, ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন যে, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগও বাংলায় রায় প্রদান করবেন। ওই দিন সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে বাণী অর্চনা উদ্‌যাপন পরিষদের অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমাদের হাইকোর্টে বিচারকেরা সুন্দরভাবে বাংলায় রায় দিচ্ছেন। আপিল বিভাগের রায় বাংলায় দেওয়ার চেষ্টা চলছে।’ (বণিক বার্তা, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আইনের ধারাগুলো ইংরেজিতে হওয়ায় এবং বাংলা ভাষায় লেখা আইনের বই না থাকায় সর্বোচ্চ আদালতে বাংলা ভাষায় রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সহমত পোষণ করেই বলতে চাই যে এ ব্যাপারে আরও খোলামেলা ও অনুপুঙ্খ আলোচনা প্রয়োজন। শুধু আবেগের অনুবর্তী হয়ে বাংলায় রায় লেখার কথা বলা বা দু-একটি রায় বাংলায় লিখে চমক সৃষ্টি করা কাম্য নয়। নিঃসন্দেহে বাংলায় রায় লেখাটা কঠিন। বাংলায় রায় দেওয়ার বিষয়টি অনেকগুলো পূর্বশর্ত পূরণের ওপর নির্ভর করে।
বাংলাদেশের আইন ও বিচারব্যবস্থার বাস্তবতা হচ্ছে, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন, কার্যবিধিসহ অধিকাংশ মূল আইন প্রণীত হয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের দ্বারা তাঁদের মাতৃভাষা ইংরেজিতে। ভিনদেশের ওই শাসকেরা আদালতের যে বিন্যাস সাজিয়ে দিয়েছিলেন, এখনো তা বহাল আছে। বাংলাদেশের আইন ও বিচারব্যবস্থা ব্রিটেনে বিকশিত ‘কমন ল’ সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশের আইনশিক্ষা ও বিচারব্যবস্থায় মূলত ইংলিশ আইনের নীতিমালা, ম্যাক্সিম ও মামলা পড়ানো হয় ও অনুসরণ করা হয়। বাংলাদেশের আইন ও বিচারব্যবস্থাকে আমরা কতটা বাংলাদেশের করতে পেরেছি, তা নিয়ে আমার মধ্যেও খটকা আছে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও বিচারক ও আইনজীবীরা যখন কোট-টাই পরে গলদঘর্ম হন, তখন বেশ কৌতুক অনুভব করি। শীতের দেশের বিচারক ও আইনজীবীরা যে পোশাক পরেন, সেই পোশাক পরে ধুলাবালি ও রোদ-বৃষ্টির দেশের বিচারক ও আইনজীবীদের কেন গলদঘর্ম হতে হবে, সেটি আমার মস্তিষ্কে কিছুতেই প্রবেশ করতে চায় না।

বাংলাদেশে যেসব শিক্ষার্থী এখন বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন সম্মান অধ্যয়ন করতে আসেন, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে আইনবিষয়ক কোনো কোর্স না থাকায় প্রথম দুই বছর অথবা প্রথম ছয় সেমিস্টার আইন, আইনের নীতিমালা, আইনের ভাষা, পরিভাষা ও বিষয়বস্তু বোঝার জন্য তাঁদের রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। এর কারণ বিষয়বস্তু সম্পর্কে পূর্বজ্ঞান না থাকা। দ্বিতীয় কারণ ভাষা।

প্রধান বিচারপতি যেমন বলেছেন, আইনের প্রায় সব প্রামাণিক ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থই ইংরেজিতে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইনের মূল বয়ান ইংরেজিতে, ল রিপোর্টগুলো ইংরেজিতে, রয়েছে পরিভাষার সমস্যা। অনেক আইনের মূল বয়ানের (ঔপনিবেশিক বা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংসদ কর্তৃক প্রণীত মূল আইন) কোনো কোনো ধারায় অর্ধপৃষ্ঠা বা এক পৃষ্ঠাজুড়ে একটি বাক্যে আইনের ভাষ্য বর্ণিত হয়েছে, যা অত্যন্ত জটিল, দুর্বোধ্য ও ক্লান্তিকর। অধিকাংশ আইনের শিক্ষার্থী তাঁদের পাঁচ বছরের শিক্ষাজীবনে মূল আইনের ভাষা নিঃসৃত বিষয়বস্তু বুঝতেই গলদঘর্ম হয়ে যান, রপ্ত করা তো দূর–কল্পনা! এর মূল কারণ আইনের ভাষা ইংরেজি এবং সেই ইংরেজি আবার সহজ নয়, জটিল ও দুর্বোধ্য।

অভিজ্ঞতায় দেখেছি, স্বল্পসংখ্যক কিছু আইনের শিক্ষার্থী, যাঁরা অত্যন্ত মেধাবী বা আইন বিষয়ে যাঁদের পারিবারিক ঐতিহ্য রয়েছে এবং যাঁরা পরবর্তী সময়ে আইনের শিক্ষক, গবেষক, বিচারক ও আইনজীবী হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দেন, তাঁরাই ভাষার দেয়াল ভেদ করে আইনের ভাষা ও নীতিমালার সৌন্দর্যে অবগাহন করতে পারেন, বিচিত্র সব মামলার ভান্ডার থেকে তুলে আনতে পারেন মণিমুক্তো। প্রশ্ন হচ্ছে, স্বল্পসংখ্যক মেধাবীর জন্য আইনকে কেন ‘রক্তকরবীর রাজা’র মতো বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে সর্বসাধারণের কাছ থেকে? আইনের ভাষাকে প্রাঞ্জল এবং সহজে বোধগম্য করতে বাধা কোথায়? নেপোলিয়নিক কোড সারা বিশ্বে একটি মডেল কোড হিসেবে বিখ্যাত। নেপোলিয়ন দেওয়ানি, ফৌজদারিসহ বিভিন্ন কোড প্রণয়নের জন্য একটি কমিশন নিয়োগ করেছিলেন। ওই কমিশন কোড প্রণয়নের পর নেপোলিয়ন নিজে কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে বসতেন, সদস্যদের তিনি আইনের ভাষা ও বিষয়বস্তু তাঁকে বোঝাতে বলতেন। নেপোলিয়ন এমন ভাষায় আইন প্রণয়ন করতে তাগাদা দিতেন যে আইন পড়ে জনগণ সহজে বুঝতে পারবে।

প্রায়শই মনে হয় যে বাংলাদেশে আইনের ভাষা দিয়ে সাধারণ মানুষ ও বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে এক দুর্ভেদ্য ও দুর্বোধ্য দেয়াল রচনা করা হয়েছে। ওই দেয়াল ভেদ করে শেষ অব্দি আইনের ভাষার সৌন্দর্য, বিষয়বস্তুর যথার্থতা ও সংজ্ঞা বুঝতে সমর্থ হন গুটিকতক মেধাবী ও প্রশিক্ষিত বিচারক, আইনজীবী, শিক্ষক ও গবেষক। বাংলাদেশের আইন হয়ে গেছে ‘রক্তকরবীর রাজা’র মতো অভিজাত ও নিঃসঙ্গ। আইন ভিনদেশি ভাষা দিয়ে, ভাষার চারদিকে জটিল ও দুর্বোধ্যতার দেয়াল তুলে দিয়ে নিজেই হয়ে পড়েছে অবরুদ্ধ। আইনের ভাষাকে প্রাঞ্জল ও ব্রাত্যজনের বোধগম্য করার কোনো উদ্যোগ তো দূরের কথা, নীতিনির্ধারকেরা এর প্রয়োজনীয়তা বোঝেন কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।

কয়েক দশক ধরে বাংলা ভাষায় আইন প্রণীত হচ্ছে। উচ্চ আদালতের কয়েকজন বিচারপতি বাংলায় রায় দিয়ে প্রশংসিত হয়েছেন। কিন্তু কয়েকটি রায় বাংলায় দেওয়া হলেও প্রচলিত নিয়ম বা প্রবণতার কোনো পরিবর্তন হয়নি, মামলার রায় বরাবরের মতো এখনো দেওয়া হয় ইংরেজিতে। যেসব মামলার রায় বাংলায় দেওয়া হয়েছে, তার কোনো কোনোটির ভাষার মান নিয়ে ভাষাবিদেরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আইন মন্ত্রণালয়ের ড্রাফটিং শাখা ও বাংলাদেশ আইন কমিশন কর্তৃক প্রস্তুতকৃত কয়েকটি বাংলা আইনের ভাষাকে দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ মনে হয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের যে বাংলা তরজমাটি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান করেছেন, সেটিকে মান ধরলে বর্তমানে প্রণীত আইনের মান নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়া কঠিন।

মোদ্দা কথা হচ্ছে, আমরা যদি বাংলাকে আইনশিক্ষার মাধ্যম করতে চাই, আইনকে যদি সর্বসাধারণের বোধগম্য করতে চাই, যদি প্রত্যাশা করি মামলার রায় লেখা হবে প্রমিত বাংলায়, তাহলে আইনের ভাষাকে সহজবোধ্য করতে হবে, আইনের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থগুলোকে বাংলায় অনুবাদ করতে হবে, ল রিপোর্টগুলোকে বাংলায় বের করতে হবে এবং সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশিত আইনের নিত্যনতুন প্রামাণিক বইগুলোকে দ্রুততার সঙ্গে অনুবাদের ব্যবস্থা করতে হবে।

উল্লিখিত কাজগুলো সহজ নয়। এ জন্য প্রয়োজন হবে একদল মেধাবী, উদ্যমী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শিক্ষক, বিচারক, আইনজীবী, গবেষক ও আইনের খসড়া প্রণয়নকারী বা ড্রাফটসম্যানের, যাঁদের অতি–অবশ্যই হতে হবে বাংলা, ইংরেজি ও আইন বিষয়ে সুপণ্ডিত।

শেখ হাফিজুর রহমান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক।