মার্কিন নির্বাচন, মধ্যপ্রাচ্যের জন্য শাঁখের করাত

গত চার বছরে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি বদলে দিয়েছেন ট্রাম্প
ছবি: রয়টার্স

প্রথাগতভাবে সর্বশেষ মার্কিন নির্বাচনী বিতর্কের বিষয়বস্তু পররাষ্ট্রনীতি হলেও করোনা মহামারি, স্বাস্থ্যবিমা এবং নাজুক মার্কিন অর্থনীতির বাস্তবতায় পররাষ্ট্রনীতির আলাপ সামান্যই হয়েছে। স্বল্প পরিসরে উত্তর কোরিয়া, চীন আর ইউক্রেন নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। নিকট অতীতে ও বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের চারটি যুদ্ধের প্রধান কারিগর মার্কিনরা হলেও ট্রাম্প–বাইডেন শেষ বিতর্কে মধ্যপ্রাচ্যের কথা ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। সঙ্গে আজারবাইজান-আর্মেনিয়া ও ভূমধ্যসাগরের সমুদ্রসীমা নিয়ে সৃষ্ট সংঘাত তো আছেই। অবিরত এসব সংঘাত, রাশিয়া ও তুরস্কের উত্থান এবং গত চার বছরের মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতা কাঠামোয় পরিবর্তনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই নির্বাচন। যদি বাইডেন এতে জয়লাভও করেন, পরিবর্তিত মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাব ধরে রাখা কঠিন হবে।

২০১৫ সালের জুন মাসে প্রথম দফার নির্বাচনী প্রচারণার শুরুর দিন থেকেই ট্রাম্প ভিন্ন আবহ তৈরি করেছিলেন। মেক্সিকো, মুসলিম ইস্যু এবং হিলারিসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গে প্রকাশ্যে বর্ণবাদী মন্তব্য করেন। চারদিকে ঘৃণার বাণী ছড়িয়ে মার্কিন ভোটারদের মনে অন্যদের থেকে ভিন্ন আখ্যান গেঁথে দিয়েছিলেন। ট্রাম্প কথা রেখেছেন। হোয়াইট হাউসে পাকাপোক্ত হয়ে প্রথমেই তিনি মার্কিনদের মধ্যপ্রাচ্য নীতির  ছলচাতুরী জনসম্মুখে আনেন। সেখান থেকে কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অবয়ব বদলে দিচ্ছে। এসব ঐতিহাসিক পরিবর্তন বড় সময়ের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির গতিপথ বদলে দেবে। ২০১৭ সালে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা ছিল এই পরিবর্তনের প্রথম প্রকাশ। ২০২০ সালে এসে শতাব্দীর চুক্তির নামে ইসরায়েল–ফিলিস্তিনের ‘দ্বিরাষ্ট্রিক’ ব্যবস্থাও তিনি বাতিল করেন। পরের ধাপে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের অবৈধ বসতি স্থাপনকে স্বীকৃতি দেন এবং ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আমিরাত, বাহরাইন ও সুদানকে রাজি করান। একই সঙ্গে সৌদিদের নিরাপত্তা মার্কিনদের ওপর নির্ভরশীল—এই ঘোষণা দিয়ে সৌদিদের আদতে একটি আজ্ঞাবহ শাসক হিসেবে চিনিয়ে দেন। একইভাবে সিরীয় কুর্দিদের দল পিকেকেকে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের পাহারাদার হিসেবে উল্লেখ করে পিকেকের ব্যাপারে আদর্শিক পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছেন।

একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প এবং তাঁর কর্মপদ্ধতির নিন্দাই হয় বেশি। যুক্তরাষ্ট্র নারী মুক্তির নামে আফগানিস্তানে যুদ্ধে নেমে পড়লেও সৌদি নারীদের মৌলিক অধিকার হরণের বিষয়ে নীরব সমর্থন দিয়ে চলছিল। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে ইরাককে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করলেও গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ভেনেজুয়েলার মাদুরো এবং বলিভিয়ার মোরালেসকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে হাঙ্গামা উসকে দিয়েছে। শান্তি আলোচনার নামে ঢাল–তলোয়ারবিহীন ফিলিস্তিনিদের আলোচনার টেবিলে বসিয়ে, সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে ইসরায়েলকে অবৈধ বসতি স্থাপনের অবাধ সুযোগ দিয়েছে। ট্রাম্প আগেকার প্রেসিডেন্টদের এই ঘোরালো পথে যাননি। ব্যাটিংয়ে নেমে সোজাসুজি ছক্কা হাঁকিয়েছেন। শতাব্দীর চুক্তির নামে প্রায় সব ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইসরায়েলের কর্তৃত্ব স্বীকার করেছেন। তালেবানের সঙ্গে চুক্তি করেছেন। সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যা এবং সৌদি আরবের ইয়েমেনে হামলার পক্ষ নিয়েছেন। ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হলে প্রথম আমলের মতোই পররাষ্ট্রনীতি বহাল থাকার সম্ভাবনা বেশি। তবে ট্রাম্প ইরান যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

তবে যদি চমক দিয়ে বাইডেন জয় পান, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি আক্ষরিক অর্থেই পুরোনো অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রায় চার দশক ধরে জো বাইডেন ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক ক্ষমতাবৃত্তের অংশীদার। বাইডেন ওবামা আমলে ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন, ছিলেন ইরাক যুদ্ধের অন্যতম সমর্থক। আগ্রহী পাঠকেরা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি যে ওবামা-বাইডেন জুটি ‘আরব বসন্তের’ নামে কীভাবে সিরিয়া এবং লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ বাধিয়েছে এবং আধুনিক মিসরের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে উৎখাত করে সিসিকে মদদ দিয়েছিল। ২০১৬ সালে তুরস্কে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে ওবামা-বাইডেন প্রকাশ্য মদদও ভুলে যাওয়ার নয়। যদিও ইতিমধ্যে বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্রের মজবুতি, ২০১৫ সালের ইরান–মার্কিন পরমাণু চুক্তি পুনরায় জীবন্ত করা, মোহাম্মাদ বিন সালমান এবং এরদোয়ানের লাগাম টেনে ধরাসহ ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে দ্বিরাষ্ট্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বাইডেন যখন এসব চমক লাগানো নতুন কর্মপদ্ধতির কথা বলছেন, তখন সাধারণ মানুষ প্রশ্ন উঠিয়েছে যে ক্ষমতায় থাকার সময়ে এই সব পদক্ষেপ কেন নেওয়া হয়নি।

আদতে বাইডেনের জয়লাভ মধ্যপ্রাচ্যের চিরচেনা যুদ্ধের চিত্র বদলাবে না। কারণ এই যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের নয় বরং যুক্তরাষ্ট্রেরই। ওবামার মতোই বাইডেন আরেক মরীচিকা, যুদ্ধবাজ এবং স্বঘোষিত জায়োনিস্ট। যদি মধ্যপ্রাচ্যকে বাইডেনসহ বর্তমান ডেমোক্র্যাটদের কিছু দেওয়ার থাকত, তাহলে ওবামার আমলে সিরিয়া, লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ হতো না। সিরীয় আর ইরাকিদের এক টুকরা রুটির জন্য ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরতে হতো না। মূলত বাইডেন মধুর কথা বলে কৃষ্ণাঙ্গ, উদারনৈতিক, প্রতিষ্ঠানবিরোধী এবং মুসলিমদের ভোটব্যাংক দখলের ফন্দি আঁটছেন। এই প্রকল্পে বাইডেন অনেকটা সফলও বলা যায়। কারণ সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও ইতিমধ্যেই জগৎখ্যাত প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি, অ্যানেজলা ডেভিস থেকে শুরু করে কর্নেল ওয়েস্ট সবাই ট্রাম্পের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বাইডেনকে ভোট দিতে উৎসাহ দিচ্ছেন। কিন্তু এক দুর্বৃত্তকে অপর দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে সমর্থন সম্ভাব্য কোনো সমাধান দেবে কি না, সেই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। সম্প্রতি আল–জাজিরায় প্রকাশিত কলামে হামিদ দাবাসি এই প্রশ্নের বিশদ উত্তর দিয়েছেন। চমস্কি, ডেভিসসহ অনেকেরেই ‘বাইডেনেকে বেছে’ নেওয়ার বিষয়টিকে দাবাসি ‘ভাসমান সমুদ্রে এক খড়কুটো ছেড়ে আরেক খড়কুটো ধরে বেঁচে থাকার অবলম্বন খোঁজার’ চেষ্টার সঙ্গে তুলনা করেছেন।

মার্কিন দেশের নাগরিকেরা আগামী ৩ নভেম্বর নিজেদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবেন। নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ঔপনিবেশিক আমলের মতো বিশ্বের কোটি মানুষের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যেরও ভাগ্য নির্ধারণ করবেন। বৃহৎ পরিসরে ট্রাম্প অত্যন্ত গর্হিত কিছু কাজ করেছেন। কিন্তু ওয়াশিংটন এবং সৌদি বলয়ের প্রবল চাপ উপেক্ষা করে যেভাবে ইরান আক্রমণ থেকে বিরত থেকেছেন এবং সিরিয়া ও লিবিয়ার গৃহযুদ্ধের পরিধি আটকে দিয়েছেন, তা মধ্যপ্রাচ্যের মানুষকে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে

রাহুল আনজুম: আন্তর্জাতিক রাজনীতিবিষয়ক গবেষক।