মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে হালকাভাবে নিয়ে যে ভুল করছে সরকার

সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বোঝা উচিত, বাংলাদেশের মতো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে
ছবি : প্রতীকী

গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাকে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা কিছু হালকা কথাবার্তা ও বিএনপির ওপর লবিংয়ের দায় চাপিয়ে পার করতে চাইছেন। তাঁদের আচরণ খুব বেশি বুদ্ধিদীপ্ত ও জুতসই মনে হচ্ছে না। প্রথমত, তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নানা কথা বলেছেন। এখন বিএনপির বিরুদ্ধে লবিংয়ের অভিযোগ এনে নানা ধরনের হাবিজাবি কথা বলে মাঠ গরমের চেষ্টা করছেন। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তা মনে হয় মন্ত্রী-এমপিরা অনুধাবন করতে পারছেন না। নিষেধাজ্ঞার গুরুত্ব ও গভীরতাকে বুঝতে না পারার ব্যর্থতা তাঁদের রাজনৈতিক অপরিপক্বতার বহিঃপ্রকাশ।

নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের পর সরকারের দায়িত্বশীলদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। প্রথমেই সরকারের মন্ত্রীরা লাগামহীনভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা শুরু করলেন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর কত মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়, তার হিসাব নিয়ে এলেন সামনে। সহযোগীরাও এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত দিতে শুরু করলেন। কয়েক দিন তারা কথার তুবড়ি ছোটালেন রীতিমতো। কিন্তু সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় ড্রোন হামলা করে আট লাখের বেশি বেসামরিক মানুষকে হত্যার বিষয়ে কিন্তু তাঁরা কিছু বললেন না। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করতেই হয়, তবে এসব বেসামরিক নৃশংস হত্যার বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। কিন্তু আমাদের সরকারের লোকেরা এ বিষয়ে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেননি। কারণ, এই তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সুবিধাভোগী তাঁরাও। যুক্তরাষ্ট্রকে কেউ মানবাধিকারের পরম বন্ধু বলে মনে করে না। যেমন আমাদের দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে সরকারি প্রেসনোট কেউ বিশ্বাস করেন না। যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বেই শান্তি ও মানবাধিকারের জন্য যা করে বা করতে চায়, তা তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক এজেন্ডার অংশ।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন যদি মনে করেন, তাঁদের মুচলেকা নেওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র নজরদারি করছে না, তবে তা মহা ভুল হিসেবে বিবেচিত হবে। তাঁরা যদি ভেবে থাকেন, এসব মুচলেকা নিয়ে জাতিসংঘ বা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সরকার জমা দেবে এবং নিজেদের সাফসুতরো হিসেবে প্রমাণ করবে, তাহলে সেটা সরকারের জন্য খুবই বোকামি হবে। এতে বরং বিপদ আরও বাড়বে; কমবে না কিছুতেই।

যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনার পাশাপাশি যা শুরু হলো, তা আরও ভয়াবহ। এত বছর পর হুট করেই গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের কাছ থেকে মুচলেকা নিতে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন। স্বজনদের তরফেই এমন অভিযোগ উঠেছে। নির্বুদ্ধিতার একটি সীমা থাকে। অবস্থাদৃষ্টে বোঝাই যাচ্ছে, নিষেধাজ্ঞার পর বিভ্রান্ত হয়েই এসব করা হচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন যদি মনে করেন, তাঁদের মুচলেকা নেওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র নজরদারি করছে না, তবে তা মহা ভুল হিসেবে বিবেচিত হবে। তাঁরা যদি ভেবে থাকেন, এসব মুচলেকা নিয়ে জাতিসংঘ বা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সরকার জমা দেবে এবং নিজেদের সাফসুতরো হিসেবে প্রমাণ করবে, তাহলে সেটা সরকারের জন্য খুবই বোকামি হবে। এতে বরং বিপদ আরও বাড়বে; কমবে না কিছুতেই। সরকারের পক্ষ থেকে আরও একটি কথা বলা হয়েছে র‌্যাব নিয়ে। সেটি হচ্ছে, জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাস দমন র‌্যাব উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু তারা বুঝতে পারছে না সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ তার উপযোগিতা হারিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে নীতিকৌশল তৈরি করছে। এমনও হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদ দমনের নামে বেসামরিক লোককে হত্যার অভিযোগ এনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পৃথক অভিযোগ উত্থাপন করতে পারে। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে কথা বলতে হবে ও কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।

নিষেধাজ্ঞায় জেরবার অবস্থার মধ্যেই মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে সরকারের যুক্তরাষ্ট্রে লবি নিয়োগের কিছু তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ওই সব প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সরকার গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ সামাল দিতে ওই সব লবি সংস্থাগুলোকে নিয়োগ করেছিল। এ জন্য সরকারের ২ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে। সরকারের লবি নিয়োগ নিয়ে আগেও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য এসব প্রতিষ্ঠানকে লবিস্ট না বলে পাবলিক রিলেশনস বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে।

সরকারের বিরুদ্ধে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ ধামাচাপা দিতে লবিস্ট নিয়োগের তথ্য প্রকাশের পর বিএনপির বিরুদ্ধেও লবিস্ট নিয়োগের অভিযোগ করা হয়েছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সম্প্রতি সংসদে বলেছেন, বিএনপি লবি করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দুই মিলিয়ন টাকা দিয়েছে। এই অর্থকে তিনি অবৈধ ও কালোটাকা উল্লেখ করে বলেন, টাকা দেওয়ার প্রমাণ তাঁর কাছে আছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। কিন্তু পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হয়তো খেয়াল করেননি তিনি কাচের ঘরে বসে বিএনপির দিকে ঢিল ছুড়ছেন। উল্লেখ্য, ২০০৪ ও ২০০৫ সালেও আওয়ামী লীগ যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট কোম্পানি নিয়োগ করেছিল। এসব মনে হয় সরকারের মন্ত্রীরা জানেন না বা ভুলে গেছেন।

বিএনপির লবি নিয়োগের অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করার পাশাপাশি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ২০০৪ ও ২০০৫ সালে আওয়ামী লীগের লবি নিয়োগে অর্থের উৎস নিয়েও তথ্য প্রকাশ করা দরকার ছিল। বিএনপিকে প্রশ্ন করার আগে আওয়ামী লীগের নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করা প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, উভয় দলেরই লবি নিয়োগের তথ্য প্রকাশ্যে আসা প্রয়োজন।

শুধু আওয়ামী লীগ বা বিএনপি নয়, যে কেউ বিদেশে লবি নিয়োগের অধিকার রাখেন। বৈধভাবে অর্থ পাঠিয়েও লবি নিয়োগে সমস্যা থাকার কথা না। মন্ত্রীরা বিএনপির আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, লবি নিয়োগের অর্থ বিএনপি কোথায় পেয়েছে? নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া আর্থিক বিবরণীর সঙ্গে লবি নিয়োগের অর্থ সংগতিপূর্ণ কি না, এসব বিষয়ে মন্তব্য করেন। নিজেদের অর্থ কোথায় ও কীভাবে ব্যয় করবে, এটা বিএনপির নিজস্ব বিষয়। বিএনপির বিষয়ে তাদের বক্তব্য যৌক্তিক। কিন্তু বিএনপির লবি নিয়োগের অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করার পাশাপাশি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ২০০৪ ও ২০০৫ সালে আওয়ামী লীগের লবি নিয়োগে অর্থের উৎস নিয়েও তথ্য প্রকাশ করা দরকার ছিল। বিএনপিকে প্রশ্ন করার আগে আওয়ামী লীগের নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করা প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, উভয় দলেরই লবি নিয়োগের তথ্য প্রকাশ্যে আসা প্রয়োজন।

আরও প্রশ্ন করা প্রয়োজন, সরকারি অর্থ ব্যয়ে কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হলো। লবিস্ট নিয়োগ দেওয়ার এ বিষয়ে সংসদে আলোচনা করা হয়েছিল কি না? জানা মতে হয়নি। তাহলে কীভাবে ও কোন প্রক্রিয়া অবলম্বন করে জনগণের টাকায় এসব প্রতিষ্ঠানকে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত করতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তা জনসাধারণকে জানাতে হবে। এটা সরকারি অর্থের অপচয় মাত্র। এ বিষয়ে সরকারের জবাবদিহি করা প্রয়োজন।

হালকা ও লঘু কথাবার্তা বলে আত্মপ্রসাদ ভোগ করা যায়। কিন্তু পরিণতি ভালো হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর জাতিসংঘের শান্তি মিশনে র‍্যাবকে নিষিদ্ধ করার জন্য বিশ্বের ১২টি মানবাধিকার সংস্থা জাতিসংঘে চিঠি দিয়েছে। এই মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পরিচয় ও নাম দেখলেই তাঁদের সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে। এসব প্রতিষ্ঠান আমেরিকা ও ব্রিটেনের লোকজনই পরিচালনা করেন। তাঁরা হচ্ছে ইঙ্গ-মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অগ্রবর্তী বাহিনী। মনে করার কোনো কারণ নেই যে ১২টি মানবাধিকার সংস্থার চিঠি জাতিসংঘের কর্মকর্তারা টেবিলে ফাইল চাপা দিয়ে রাখবেন অনন্তকালের জন্য। ওদিকে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নও ধীরে ধীরে সক্রিয় হচ্ছে।

সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বোঝা উচিত, বাংলাদেশের মতো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। দেশের রাজনীতিতে যাচ্ছেতাই করা যায়, বিএনপিকে চাপে রেখে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে রাজনীতিবিদদের চোখ রাঙানি নিয়ে বসিয়ে দেওয়া যায়। আজেবাজে বকে চরিত্র হননের চেষ্টা করা যায়; কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশ এখনো ছোট মাছ। যার তার বিরুদ্ধে ইচ্ছা করলেই যা খুশি তা বলা যায় না। সরকারের দায়িত্বশীলদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, পরিস্থিতি এখনো তাঁরা অনুধাবন করতে পারছেন না। সাহস ধরে রাখা ভালো। কিন্তু সাহস দেখাতে গিয়ে আবোলতাবোল বকা ও কাজ করা সমীচীন নয়। এতে বিপদ বাড়ে বই কমে না।

ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক