মার্কিন রক্ষণশীলদের নতুন কৌশল

মার্কিন মুলুকে রক্ষণশীল বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদেরা জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে তাঁদের আগের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছেন। আগে জলবায়ু পরিবর্তনকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করলেও তাঁরা এখন বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু মানুষের কার্যকলাপ এর জন্য কতটুকু দায়ী, সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে কৌশল বদল করলেও রক্ষণশীলদের উদ্দেশ্য একই আছে, আর সেটা হলো, জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে মানুষের মনে সন্দেহ তৈরি করে জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর অর্থনীতিকে আরও চাঙা করা। কারণ, কার্বন উদ্গিরণকারী কোম্পানিগুলোর সঙ্গে তাদের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এতে কার্বন নির্গমন কমানোর যে প্রচেষ্টার কথা জোরেশোরে বলা হচ্ছে, তা মুখ থুবড়ে পড়বে।
মুনাফার জন্য এই ‘সন্দেহ আছে’ কৌশল গ্রহণ নতুন বিষয় নয়। এ প্রসঙ্গে বড় সিগারেট কোম্পানিগুলোর কথা বলা যায়। তারা বিজ্ঞানকে অস্বীকার ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল। ১৯৫৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর সিগারেট কোম্পানিগুলো নিউইয়র্ক শহরের প্লাজা হোটেলে একটি বৈঠক আয়োজন করে। উদ্দেশ্য ছিল, এমন একটি কৌশল বের করা যা দিয়ে সিগারেট যে ক্যানসার ও অন্যান্য রোগের কারণ, তার তথ্য–প্রমাণ ভুল প্রমাণিত করা। মূল কৌশলটা ছিল এ রকম—এটা ‘প্রমাণিত’ নয় যে, সিগারেট রোগব্যাধির কারণ। সুতরাং এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের সুযোগ আছে। সিগারেট কোম্পানিগুলো প্রতিশ্রুতি দেয়, তারা
এর সত্যতা বের করতে গবেষণায় অর্থায়ন করবে। কিন্তু গোপনে স্বীকার করে নেয়, ‘সন্দেহই আমাদের পণ্য’ (এ বিষয়ে ১৯৬৯ সালের কুখ্যাত ব্রাউন ও উইলিয়ামসন দলিলপত্র দেখতে পারেন)। এরপর সিগারেট কোম্পানিগুলো মৌলিক বায়োমেডিকেল গবেষণায় লাখ লাখ ডলার ঢেলেছে। তারা দেখিয়েছে, কীভাবে জেনেটিক, ভাইরাসজনিত বা পেশাগত কারণে ক্যানসার হয়।
শর্ত একটাই, তামাক ছাড়া ক্যানসারের আর সব কারণ উদ্ঘাটন করা যাবে। এসব অর্থায়নে স্বনামধন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের জার্নালে সাত হাজারেরও বেশি নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। এ ছাড়া স্বীকৃতিস্বরূপ ১০ জনকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবার্ট প্রক্টর গবেষণায় দেখিয়েছেন, অন্তত ২৫ জন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী গত অর্ধশতকে সিগারেট কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন।
নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তনকে চীনাদের ধাপ্পাবাজি মনে করেন। সংগত কারণেই প্রশাসনে তাঁর আদর্শের লোকেরা একই রকম মনোভাব পোষণ করেন। ফলে রক্ষণশীল মার্কিন রাজনীতিক ও নীতিনির্ধারকেরা জলবায়ু পরিবর্তনকে অস্বীকার করতে অসংখ্য আগ্রাসী পদক্ষেপ নিয়েছে। মার্কিন পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা বন্ধ করে দেওয়া, তার নিয়মনীতি বদলানো, জনবল কমানো, আঞ্চলিক কার্যালয়গুলো বন্ধ করে দেওয়া এবং সংস্থার তত্ত্বাবধায়ক ভূমিকাকে চিরতরে দুর্বল করে দেওয়াসহ অনেক দাবি তারা করেছে। এ ছাড়া আন্তসরকার জলবায়ু পরিবর্তন প্যানেল, জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন বা ইউএনএফসিসিসি ও সবুজ জলবায়ু তহবিলে অর্থ প্রদান বন্ধ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভায় প্রস্তাবও উত্থাপন করা হয়েছে।
মার্কিন পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা বা ইপিএর প্রধান করা হয়েছে স্কট প্রুইটকে। তাঁর নিয়োগ চূড়ান্ত করার শুনানিতে সিনেটর এড মারকে প্রুইটকে জিজ্ঞেস করলেন, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে তিনি একমত কি না। উত্তরে তিনি ট্রাম্পের অবস্থানকে অস্বীকার করেন। কিন্তু সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স যখন জানতে চাইলেন, মানুষের কার্যকলাপের কারণে জলবায়ু কতটা পরিবর্তন হচ্ছে, তখন তিনি তা বলতে চাইলেন না। কিন্তু স্যান্ডার্স যখন বললেন, প্রুইট ৯৭ শতাংশ বিজ্ঞানীর সঙ্গে একমত কি না যাঁরা মনে করেন, মানুষের কাজের জন্যই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। তখন তিনি বললেন, এ বিষয়ে আরও বিতর্ক প্রয়োজন। আরও বিতর্ক প্রয়োজন—এর মানে হলো এখনো সন্দেহ আছে, মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী কি না।
প্রুইট জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সন্দেহ পোষণ করবেন, এ ব্যাপারে সন্দেহ থাকার কারণ নেই। তিনি কার্বন উদ্গিরণকারী তেল-গ্যাস উৎপাদকদের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। এরই মধ্যে ওকলাহোমার একজন বিচারক প্রুইটকে বলেছেন, তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোর নির্বাহী কর্মকর্তাদের সঙ্গে আদান-প্রদান করা ই-মেইলগুলো যেন দ্রুত প্রকাশ করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনকে নিয়োগের শুনানিতে যখন একই প্রশ্ন করা হলো যে, তিনি জলবায়ু বিষয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে একমত কি না, তখন তিনিও একই উত্তর দেন। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কতটা, তা অনুমান করার ক্ষমতা খুবই সীমিত। এতেই বোঝা যায়, বিশ্বের অন্যতম কার্বন উদ্গিরণকারী কোম্পানি এক্সন মবিলের সাবেক এই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও নতুন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ‘সন্দেহ আছে’ কৌশল চালিয়ে যাবেন।
এ ধরনের উত্তরের পেছনে তাঁরা যে যুক্তিটা দিচ্ছেন তা হলো, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। সুতরাং এ বিষয়ে নীতি গ্রহণ করা যাবে না। কিন্তু এ রকম অবস্থান কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে—এ ব্যাপারে সবাই একমত। তবু শত শত বিজ্ঞানী এখনো মহাকর্ষ শক্তি নিয়ে গবেষণা করছেন। এখন কি বলা যায়, গবেষণা তো চলছে তাই নিশ্চিত করা বলা যাবে না পৃথিবী আসলেই সূর্যের চারপাশে ঘোরে কি না!
২০১৫ সালে ইউনিয়ন অব কনসার্নড সায়েন্টিস্ট নামে একটি পরিবেশবাদী সংগঠন জলবায়ু প্রতারণার দলিলপত্র প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, ১৯৯৮ সালে আমেরিকান পেট্রোলিয়াম ইনস্টিটিউটের একটি মেমোতে জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর শিল্পের জন্য বহুমাত্রিক প্রতারণা কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছিল। মূল উদ্দেশ্য ছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে সন্দেহ তৈরি করা এবং তা গণমাধ্যম, জনগণ ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। সেখানে এও বলা ছিল, ‘মানুষের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে এবং বিজ্ঞানীদের মধ্যে এ ব্যাপারে সর্বসম্মত ঐকমত্য রয়েছে। কিন্তু তবু যদি সাধারণ নাগরিক ও গণমাধ্যমের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সন্দেহ ঢোকানো যায়, তাহলে সেটাই হবে “বিজয়”।’
কথা হচ্ছে, এই অস্বীকারের রাজনীতি এমনই ভয়ানক যে পৃথিবী নয়, মুনাফাই এখানে মুখ্য বিষয়। তাই সাধারণ মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে, যেন এই মুনাফালোভীরা পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে না পারে।
খলিলউল্লাহ্: সহকারী সম্পাদক, প্রতিচিন্তা।
[email protected]