মার্কিন সেনা প্রত্যাহার বিপজ্জনক হতে পারে

মার্কিন সেনারা ২০১১ সালে ইরাক থেকে সরে গিয়েছিল। কিন্তু ইসলামিক স্টেট দেশটির উত্তর ও পশ্চিমের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করার পর ইরাক সরকারের আমন্ত্রণে ২০১৪ সালে তারা আবার ফিরে আসে। ছবি: রয়টার্স
মার্কিন সেনারা ২০১১ সালে ইরাক থেকে সরে গিয়েছিল। কিন্তু ইসলামিক স্টেট দেশটির উত্তর ও পশ্চিমের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করার পর ইরাক সরকারের আমন্ত্রণে ২০১৪ সালে তারা আবার ফিরে আসে। ছবি: রয়টার্স

ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের একটি প্রস্তাব ইরাকি পার্লামেন্টে পাস করার এক মাসের বেশি সময় পর দেশটিতে মার্কিন বাহিনী থাকবে কি থাকবে না, সে সম্পর্কে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের কুদস বাহিনীর কমান্ডার কাশেম সোলাইমানি এবং ইরাকের পপুলার মবিলাইজেশন ইউনিটগুলোর উপপ্রধান আবু মাহদি আল-মুহান্দিস নিহত হওয়ার পর মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের এ প্রস্তাব ইরাকি পার্লামেন্টে পাস হয়।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও গত ১০ জানুয়ারি প্রস্তাবটি খারিজ করে দিয়েছেন, কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের জন্য চাপ অব্যাহত রেখেছেন। জানুয়ারির মাঝামাঝি ইরাকি শিয়া নেতা মুকতদা আল-সদর দেশটিতে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ‘মিলিয়ন-ম্যান মার্চ’ নামের এক বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করেন। ২৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ওই সমাবেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ যোগ দেয়। সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ইরাকি প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আল্লাবি এ বিষয়ে প্রকাশ্যে নিজের মতামত প্রকাশ করেননি, তবে সম্ভবত তাঁদের সঙ্গেই সহমত প্রকাশ করবেন, যাঁরা তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করেছেন। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি চাপ দিচ্ছে, তারপরও এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো জাতীয় ঐকমত্য হয়নি। এ দেশের সুন্নি ও কুর্দি নেতৃত্ব উভয়ই এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন এবং এ ইস্যুতে দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

পার্লামেন্টে এ প্রস্তাব প্রায় একচেটিয়াভাবে শিয়া দলগুলোর (ফাতাহ, সায়রুন, হিকমা, সাদিকুন) ভোটে পাস হয়েছে। পার্লামেন্টের ওই অধিবেশন কুর্দি ও সুন্নি সদস্যরা বর্জন করেছিলেন। অথচ ১৭ বছর আগে শিয়া ও কুর্দি সম্প্রদায় ইরাকে মার্কিন অভিযান এবং সাদ্দাম হোসেনের পতনকে ব্যাপকভাবে স্বাগত জানিয়েছিল। এর বিপরীতে সুন্নি সম্প্রদায় এটিকে একটি বিপর্যয় হিসেবে দেখেছিল। তারা আশঙ্কা করেছিল যে সুন্নি অভিজাতরা যে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে, তা আর থাকবে না। তাদের এ আশঙ্কা ইরাকের সরকারি অফিস থেকে বাথ পার্টির সদস্যদের সরিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাস্তব রূপ পেয়েছিল। তবে ইরান ইরাকের ঘরোয়া রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করায় গত কয়েক বছরে এ মনোভাবে পরিবর্তন এসেছে। অনেক শিয়া দল তেহরানের সঙ্গে জোট বেঁধেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধ যত তীব্রতর হচ্ছে, ততই তারা মার্কিনবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছে। সুন্নি সম্প্রদায়ের মনোভাবেও পরিবর্তন এসেছে। যদিও অনেক সুন্নি ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের বিরোধিতা করেছে, কিন্তু বিগত কয়েক বছরে অনেক সুন্নি মার্কিন সেনাদের উপস্থিতিকে ইরাকে স্থিতিশীলতার কারণ হিসেবে মনে করছে। তাই মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের আলোচনা সুন্নি সম্প্রদায় ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বেশ উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

 মার্কিন সেনারা ইরাক ত্যাগ করলে সুন্নি চরমপন্থী দলগুলো শক্তিশালী হবে। আইএসআইএল বহু সুন্নি অঞ্চলে আবার সংগঠিত হচ্ছে; ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনী ও শিয়া মিলিশিয়ারা এ হুমকি মোকাবিলায় সক্ষম নয়। সুন্নি অঞ্চলে ইরানের প্রভাবের বিরুদ্ধে মার্কিন সামরিক বাহিনীকে ভারসাম্যের শক্তি হিসেবেও দেখা হচ্ছে। ইরান–সমর্থিত পপুলার মবিলাইজেশন ইউনিটগুলো (পিএমইউ) এখনো আইএসআইএল থেকে মুক্ত হওয়া সুন্নি অঞ্চলজুড়ে মোতায়েন রয়েছে। তাদের উপস্থিতি স্থানীয়দের মধ্যে প্রচুর উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে; রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষগুলোকে এ অঞ্চলে প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ইরাকের কুর্দি দলগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ২০০৩ সালে ইরাকে অভিযানের আগে থেকেই বিদ্যমান। ১৯৯০–এর দশকের শেষ দিকে ইরাকি কুর্দি রাজনৈতিক ক্ষেত্রের দুই বৃহত্তম খেলোয়াড় কুর্দিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (কেডিপি) এবং প্যাট্রিওটিক ইউনিয়ন অব কুর্দিস্তানের (পিইউকে) মধ্যে একটি অস্ত্রবিরতি চুক্তির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র কুর্দি স্বশাসনের পক্ষে সমর্থনকারী প্রধান বিদেশি শক্তি হিসেবে বিবেচিত। এ জন্য কুর্দিরা ইরাকে মার্কিন সেনাবাহিনীর উপস্থিতিকে কুর্দি স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজনীয় গ্যারান্টি হিসেবে দেখছে।

ইরানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিয়া দলগুলো যদি ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের জন্য চাপ অব্যাহত রাখে, তাহলে ইতিমধ্যে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে; কেন্দ্রীয় সরকারে রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দিতে পারে। এ ধরনের পদক্ষেপ কুর্দি নেতৃত্বকে ভেঙে ফেলতে পারে। ইরানের সঙ্গে পিইউকেসহ বেশ কয়েকটি কুর্দি দলের সুদৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। সামগ্রিকভাবে কুর্দি ঐক্য ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বহু ভাগে বিভক্ত সুন্নি দলগুলো মার্কিন বাহিনীকে বহিষ্কারের একতরফা সিদ্ধান্তের পক্ষে কোনো গুরুতর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে না। তবে ইরাকে শক্তিশালী ইরানের উপস্থিতি অনিবার্যভাবে সাধারণ সুন্নিদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি সৃষ্টিতে অবদান রাখবে। অসন্তুষ্টি অন্য একটি সশস্ত্র বিদ্রোহের উত্থান ঘটাতে পারে। একতরফা মার্কিন সেনা সরিয়ে দেওয়ার বিপজ্জনক পরিণতি এড়ানোর একটি উপায় দেশের সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটি খোলামেলা ও সৎ আলোচনা। এ ক্ষেত্রে শিয়া দলগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সুন্নি, কুর্দি, খ্রিষ্টান এবং ইয়াজিদিদের মতো সংখ্যালঘুদের যাদের আন্তর্জাতিক সুরক্ষা প্রয়োজন, তাদের উদ্বেগের অবসান করতে হবে। বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, একদল লোকের সংকীর্ণ রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক স্বার্থের জন্য নয়।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
কামারান পালানি: মিডল ইস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক