মালিক কখন বলতে পারেন ‘আমি কি আগুন লাগিয়েছি?’

পোশাক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তাজরীন ফ্যাশনসের প্রধান ফটক বন্ধ ছিল। সজীব গ্রুপের হাসেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ কারখানার ফটকও বন্ধ ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। আগুন লাগার পর শ্রমিকেরা বের হতে পারলে এই মৃত্যুগুলো ঘটত না। সর্বত্র যেন এক বন্ধ ফটকের তালায় আটকে আছেন শ্রমিকেরা। জরুরি মুহূর্তে এই তালা ভেঙে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই শ্রমিকদের। হয় আগুনে পুড়ে, ভবনধসে চাপা পড়ে লাশ হও, নতুবা বেকার হয়ে অভাবকে সঙ্গী করে চলো।

আমাদের শিল্পায়নের গতি বাড়ছে। শিল্পায়নে শ্রমের জোগান দিতে গিয়ে এপিটাফের সংখ্যাও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। সর্বশেষ হাসেম বেভারেজের কারখানায় পুড়ে অঙ্গার হয়েছেন ৫২ শ্রমিক। এর মধ্যে শিশুশ্রমিকও ছিল। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, তাজরীনের ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নিইনি। এ কারণে দুর্ঘটনাও এড়ানো সম্ভব হয়নি নারায়ণগঞ্জের কারখানাটিতে।

কয়েক শতক আগে দাসদের কোমর ও পায়ে লোহার শিকল পরিয়ে আমেরিকার বিভিন্ন খনিতে কাজ করানো হতো। নির্যাতন ও অত্যাচারের মুখে দাস-শ্রমিকেরা যেন পালিয়ে না যান, সে জন্য আফ্রিকা থেকে ধরে আনা দাসদের এভাবেই বেঁধে রাখা হতো। কোনো কারণে খনিতে দুর্ঘটনা হলে সবার মৃত্যু অবধারিত ছিল। যুগ বদলেছে। দাসত্বের ধরনও বদলে গিয়েছে। শ্রমিকদের আর প্রকাশ্য শিকল পরিয়ে রাখা হয় না। এখন কেউ কারখানা থেকে পালিয়েও যান না। কিন্তু শ্রমিকেরা অদৃশ্য এক শিকলে বন্দী। তাঁদের শিল্পকারখানাগুলোয় তালা মেরে বন্দী করে রাখা হয়। এ যেন আধুনিক দাসযুগের নতুন বন্দিশালা। বিশ্বের সভ্য কোনো দেশে শিল্পকারখানায় এভাবে তালা মেরে শ্রমিকদের বন্দী করে রাখা হয় কি না জানা নেই। কিন্তু কারণে আমাদের দেশে তালা দিয়ে শ্রমিকদের কাজ করানো হচ্ছে।

দুর্ঘটনার পরপরই সজীব গ্রুপ ও হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের কর্ণধার মোহাম্মদ আবুল হাসেমের বক্তব্য পড়ে বিস্মিত না হওয়ার উপায় নেই। দেখা গেল এত বড় দুর্ঘটনার পরও তিনি ভড়কে যাননি। যেখানে তাঁর জবাবদিহি করার কথা সেখানে বরং তিনি জোর গলায় বলেছেন, ‘আগুন কি আমি লাগিয়েছি?’ তিনি শ্রমিকের ওপরও দায় চাপানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি না বুঝে এসব বলেছেন বলে মনে হয় না। প্রশ্ন হচ্ছে, কখন একজন মালিক এমন কথা বলতে পারেন? তিনি নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছিলেন যে তাঁর কিছুই হবে না। অন্তত অতীতের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা তাই বলে। শেষ পর্যন্ত সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইওসহ ৮ জন আটক হয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয় সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকব আমরা।

অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত বৈদ্যুতিক ত্রুটি থেকে হয়েছে বলে বিভিন্ন সময়ের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বৈদ্যুতিক ত্রুটিকে অগ্নিকাণ্ডের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সুবিধাজনক। কারণ, এতে কোনো পক্ষেরই দায় থাকে না। শেষ পর্যন্ত ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়।

যেকোনো শিল্পকারখানায় অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত সুবিধা থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বেশির ভাগ কলকারখানা এসব নিয়ম মানে না। সরকারি নজরদারিও দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত। শ্রমিকেরা ভয়াবহ ঝুঁকি নিয়ে শিল্পকারখানাগুলোয় কাজ করছেন। ফায়ার সার্ভিসকে উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, ছয় বছরে দেশের শিল্পকারখানায় ৬ হাজার ৮১টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। ক্ষতি হয়েছে ৩৭২ কোটি টাকার। অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা আশঙ্কার বিষয় ও আতঙ্কজনক। এ হিসাব অনুসারে প্রতিবছর এক হাজার অগ্নিকাণ্ড ঘটছে।

পরিসংখ্যান থেকে প্রমাণিত হয়, আমাদের শিল্পকারখানাগুলোর ত্রুটিপূর্ণ কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে। অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত বৈদ্যুতিক ত্রুটি থেকে হয়েছে বলে বিভিন্ন সময়ের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বৈদ্যুতিক ত্রুটিকে অগ্নিকাণ্ডের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সুবিধাজনক। কারণ, এতে কোনো পক্ষেরই দায় থাকে না। শেষ পর্যন্ত ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়। আবার নতুন কোনো শিল্পকারখানায় আগুন লাগে। সারি সারি পোড়া লাশ বের করে আনা হয়। কিছুদিন হাহুতাশ চলে। কিছুদিন পর আবার সব আগের অবস্থায় চলে যায়।

ঘন ঘন অগ্নিকাণ্ড সাক্ষ্য দেয় আমাদের শিল্পকারখানাগুলোয় পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণের সুবিধা নেই। সাধারণত, কয়েক ধরনের অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা থাকে শিল্পকারখানাগুলোয়। বিভিন্ন ফ্লোরে আগুন নেভানোর সিলিন্ডার রাখা হয়। এর পাশাপাশি প্রতিটি ফ্লোরেই পর্যাপ্ত পানি সরবরাহের ব্যবস্থা থাকে। এসব পদ্ধতি থাকলে আগুনের সূত্রপাত হলে কর্মীরা সিলিন্ডারের রাসায়নিক ও পানি ব্যবহার করে আগুন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন। এ জন্য প্রতিটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ারি নিয়ম রয়েছে। পরিকল্পনা করে কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা। প্রতিটি ফ্লোরে প্রতিটি শিফটে কয়েকজন করে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়।

আরেকটি পদ্ধতি আধুনিক ও ব্যয়বহুল। এ পদ্ধতিতে শিল্পকারখানাগুলোয় সেন্সর স্থাপন করা হয়। এই সেন্সর আগুনের সূত্রপাত চিহ্নিত করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অগ্নিনির্বাপক পদার্থ ও পানি ছিটাতে শুরু করে। ধারণা করা হয়, আমাদের অধিকাংশ শিল্পকারখানাতেই আধুনিক ব্যবস্থা নেই। আগুন লাগলে দ্রুত বেরিয়ে আসার মহড়াও নিয়মিত হয় না। হাতে চালিত সিলিন্ডার পদ্ধতিই একমাত্র ভরসা। এই সিলিন্ডারগুলোর আদৌ কোনো অগ্নিনির্বাপক পদার্থ আছে কি না, তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে। লোক দেখানোর জন্য এসব সিলিন্ডার ও পানির পাইপ রাখা হতে পারে। বলা যায়, কোনো ধরনের নিয়মনীতি না মেনেই নিয়ন্ত্রণহীনভাবে শিল্পকাঠামো গড়ে উঠছে।

কিন্তু এসব শিল্পকারাখানাকে নিয়ন্ত্রণ করবে কারা। সরকারই তো জনসাধারণের নিয়ন্ত্রণে নেই। সরকারকে উদাসীন না বলে বরং বলা উচিত নাগরিকের প্রতি সরকারের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। কারণ, আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতায় জনসাধারণের কোনো অবস্থানই নেই। দেশে যেহেতু নির্বাচনের বালাই নেই, তাই সরকারকেও জনসাধারণের ভোটের ওপর নির্ভর করতে হয় না। সবকিছুই এখন আমলাদের হাতে চলে গিয়েছে। এ নিয়ে কয়েক দিন আগে কয়েক বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আহাজারিও করেছেন। এক অদ্ভুত নিয়মে চলছে দেশ।

নাগরিকের মতামত, ভোটকে এক পাশে সরিয়ে রেখে এক অদ্ভুত উন্নয়ন দর্শন সামনে নিয়ে এসেছে। অগ্নিকাণ্ড, শ্রমিকের লাশের সারি, রানা প্লাজায় ধ্বংসস্তূপে চাপা লাশের আর্তনাদ, সড়ক দুর্ঘটনায় বছর বছর শত শত মানুষের মৃত্যু সীমিত গণতন্ত্রের কুফল। উন্নতি হচ্ছে বটে দেশের, নতুন নতুন অবকাঠামো গড়ে উঠছে। উন্নয়নের সূচক ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু নাগরিকের না পাওয়ার বেদনা, আহাজারিও বাড়ছে। এই উন্নয়নের সুফল নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তসহ সমাজের বড় একটি অংশের দুয়ারে পৌঁছাতে পারেনি। তাই ঘোর করোনাকালেও শ্রমিকেরা কারখানায় যান। রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন চালক। কাজের আশায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন দিনমজুর।

নাগরিকের মতামত, ভোটকে এক পাশে সরিয়ে রেখে এক অদ্ভুত উন্নয়ন দর্শন সামনে নিয়ে এসেছে। অগ্নিকাণ্ড, শ্রমিকের লাশের সারি, রানা প্লাজায় ধ্বংসস্তূপে চাপা লাশের আর্তনাদ, সড়ক দুর্ঘটনায় বছর বছর শত শত মানুষের মৃত্যু সীমিত গণতন্ত্রের কুফল।

এই আহাজারির উন্নয়ন নতুন কিছু নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই গত শতকে এ ধরনের নির্মম উন্নয়নের ধারা লক্ষ করা যায়। গত শতকের শেষ দিকে চীন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো নোংরা ও বিপজ্জনক উন্নয়ন ধারার জন্য কুখ্যাত। বিশেষ করে চীনের শিল্পকারখানাগুলো ভয়াবহ বায়ু, পানি ও ভূমিদূষণের জন্য দায়ী। চীনের উন্নয়নকে দূষিত উন্নয়নের নমুনা হিসেবে উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন। এ দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধির পেছনে ছুটে শ্রমিক ও পরিবেশের নিরাপত্তার সঙ্গে সমঝোতা করেছে। তবে এই দেশগুলো ওই সময়কে অনেকটাই পেছনে ফেলে এসেছে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়গুলো গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে।

কিন্তু আমরা ওই নোংরা, অনিরাপদ উন্নয়নের ফাঁদে আটকা পড়েছি। ফি বছর দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যু, শিল্পবর্জ্যে দূষিত বুড়িগঙ্গার দূষিত থকথকে কালো পানিই এখন আমাদের উন্নয়নের অপর পিঠের চিত্র। দেশে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দূষিত উন্নয়ন নমুনার সঙ্গে ৬০ দশকে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানের অনিরাপদ শ্রমব্যবস্থার ধারাও যুক্ত হয়েছে। আমাদের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হবে, মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি অর্জন করতে হবে, রপ্তানি বাড়াতে হবে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ফুলেফেঁপে ওঠা চাই। এত সব হিসাব-নিকাশ মাথায় রাখার কারণে শ্রমিকের পোড়া লাশের গন্ধ, বুড়িগঙ্গার পূতিগন্ধময় শিল্পদূষিত পানির গন্ধ আমাদের নীতিনির্ধারকের নাকে যায় না। বরং নীতিনির্ধারকেরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হোটেলে সভা-সেমিনারে বসে প্রবৃদ্ধির উন্নয়নের হিসাব মেলান।

এ সব করতে গিয়ে পরিবেশ, শ্রমিকের নিরাপত্তা, বেতন-ভাতা অনেক কিছুর সঙ্গেই সমঝোতা করতে হয়। কিন্তু এই সমঝোতা একদিকে যেমন দূষণ বাড়ায়, আরেক দিকে শ্রমিকের আহাজারিতে বাতাসকে ভারী করে তোলে। কোনোভাবেই এই উন্নয়নকে জনবান্ধব, টেকসই বলা যায় না।

ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক