মায়ের খেদমত নেয়ামত

‘মা’ দুনিয়ায় আসার পথ। ‘মা’ আল্লাহর রহমত। ‘মা’য়ের পায়ের নিচে সন্তানের জান্নাত। সফলতার সোপান ‘মা’য়ের খেদমত। ‘মা’ শব্দটি কোরআন করিমে এসেছে ৩৫ বার। এক বচনে ‘উম্ম’ (মা) ২৪ বার ও বহুবচনে ‘উম্মাহাত’ (মায়েরা) ১১ বার। আল্লাহ তাআলা তাঁর গুণাবলি সৃষ্টি ও বান্দার মাঝে প্রকাশ করতে এবং তার বিকাশ ঘটাতে চান। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের রবুবিয়াতের বা প্রভুত্বের যে তিনটি বৈশিষ্ট্য: ১) সৃজন, ২) লালন, ৩) সংরক্ষণ; এই তিনটি গুণের সমাহার দেখা যায় মায়ের মধ্যে। এ ছাড়া মহান আল্লাহ তাঁর যে দয়ার পরিচয় ‘রহমান’ ও ‘রহিম’ শব্দে বিসমিল্লাহ শরিফে দুবার উল্লেখ করেছেন এবং সুরা ফাতিহায়ও দুবার পুনরুল্লেখ করেছেন; যে বিষয়টি সমগ্র কোরআনে ৩২৯ বার পুনরাবৃত্তি করেছেন। যে ‘রউফ’ ও ‘রহিম’ উপাধি মহান রাব্বুল আলামিন প্রিয় হাবিব রাসুলে আকরাম ‘রহমাতুল লিল আলামিন’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উপহার দিয়েছেন; (সুরা-৯ [১১৩] তাওবাহ, রুকু: ১৬/৫, আয়াত: ১২৮, পারা: ইয়াতাজিরুন-১১, পৃষ্ঠা: ২০৮/৬)। সে ‘রহম’ ও ‘রহমত’ বা দয়া, মায়া, স্নেহ, করুণা, প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা, নমনীয়তা, কমনীয়তা, কোমলতা, ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার গুণ সৃষ্টিজগতে মায়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

মায়ের রক্তে-মাংসে আদম সন্তান। এই আদম সুরত তৈরির কারখানাও হলো ‘রেহেম’, যার বহুবচন ‘আরহাম’; যার সঙ্গে ‘রহম’-এর মিল রয়েছে, যার একমাত্র অধিকারী ‘মা’। এ শব্দটিও কোরআনে উল্লেখ হয়েছে ১৩ বার। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন: ‘আমি তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। জননী সন্তানকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বত্সরে; সুতরাং আমার (আল্লাহর) প্রতি এবং তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই নিকট।’ (সুরা-৩১ [৫৭] লুকমান, রুকু: ২/১১, আয়াত: ১৪, পারা: উতলু মা উহিয়া-২১, পৃষ্ঠা: ৪১৩/১১)। ‘আর আমি (আল্লাহ) মানবজাতিকে নির্দেশ দিয়েছি তারা যেন তাদের পিতা-মাতার সঙ্গে সুন্দর আচরণ করে; তার মা তাকে অতিকষ্টে গর্ভে ধারণ করেছে, অতি কষ্টে প্রসব করেছে এবং লালনপালন করেছে।’ (সুরা-৪৬ [৬৬] আহকাফ, রুকু: ২/২, আয়াত: ১৫, পারা: হামিম-২৬, পৃষ্ঠা: ৫০৪/২)।

মিরাজ রজনীতে যে ১৪টি বিষয় স্থির করা হয় তার প্রথমটি হলো: আল্লাহর হক তওহিদ বা একত্ববাদ এবং শিরক তথা অংশীবাদিতা থেকে মুক্তি। দ্বিতীয়টি হলো: পিতা-মাতার হক বা অধিকার এবং সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং করণীয় ও পালনীয়। মহাগ্রন্থ আল–কোরআনে বলা হয়েছে: ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত না করতে এবং মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন অথবা উভয় তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে উফ্ (বিরক্তিও অবজ্ঞামূলক কথা) বলবে না এবং তাদের ধমক দেবে না; তাদের সঙ্গে সম্মানসূচক কথা বলবে। মমতাবশে তাদের প্রতি নম্রতার ডানা প্রসারিত করো এবং বলো, হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া করো, যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছেন।’ (সুরা-১৭ [৫০] ইসরা-বনি ইসরাইল, রুকু: ৩/৩, আয়াত: ২৩ ও ২৪, পারা: সুবহানাল্লাহজি-১৫, পৃষ্ঠা: ২৮৫/৩)। আরও বলা হয়েছে: ‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক কোরো না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সুন্দর আচরণ কোরো।’ (সুরা-৪ [৯২] নিসা, রুকু: ৬/৩, আয়াত: ৩৬, পারা: মুহ্সনাত-৫, পৃষ্ঠা: ৮৬/৩)।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন: এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসুল! কে আমার উত্তম আচরণ পাওয়ার বেশি হকদার? তিনি বললেন ‘তোমার মা’; সে আবার বলল তারপর কে? তিনি বললেন, ‘তোমার মা’; সে পুনরায় বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, ‘তোমার মা’। সে আবারও বলল, এরপর কে? তিনি বললেন, ‘তোমার পিতা’। (বুখারি শরিফ ও মুসলিম শরিফ)। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, প্রিয় নবী (সা.) ইরশাদ করেন: ‘মায়ের পদতলে জান্নাত’। (নাসায়ি শরিফ)।

হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন, (একদা জুমার দিনে) রাসুলুল্লাহ (সা.) মিম্বারে আরোহণ করছিলেন; যখন তিনি প্রথম ধাপে উঠলেন তখন বললেন, আমিন! অতঃপর যখন দ্বিতীয় ধাপে উঠলেন তখন বললেন, আমিন! তারপর যখন তৃতীয় ধাপে উঠলেন তখন বললেন, আমিন! (উপস্থিত সাহাবিগণ) বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)! আমরা শুনতে পেলাম আপনি তিনবার ‘আমিন’ বললেন। (নবীয়ে কারিম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: যখন আমি মিম্বারে প্রথম ধাপে উঠলাম, তখন হজরত জিবরাইল (আ.) এলেন এবং আমায় বললেন, দুর্ভাগা সে বান্দা যে রমজান পেল এবং রমজান তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেল; কিন্তু তাকে ক্ষমা করা হলো না। তখন আমি বললাম, ‘আমিন’। তারপর বললেন, কমবখত সে বান্দা যে তার পিতা-মাতা উভয়কে বা তাদের কোনো একজনকে পেয়েছে; কিন্তু তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করায়নি। তখন আমি বললাম ‘আমিন’। এরপর বললেন, কমবখত সে বান্দা যার সম্মুখে আপনার (নাম) আলোচনা বা উল্লেখ হলো; আর সে আপনার প্রতি দরুদ শরিফ (নবীজির প্রতি শুভকামনা) পাঠ করল না। তখন আমি বললাম ‘আমিন’। (আদাবুল মুফরাদ, বুখারি: ৬৪০-৬৪৪)।

মায়ের সম্মান রক্ষার জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নবজাতক হজরত ঈসা (আ.)-এর মুখে ভাষা ফুটিয়ে দিলেন; তখন তিনি বলেছিলেন: ‘নিশ্চয় আমি আল্লাহর বান্দা, আমাকে কিতাব (আসমানি গ্রন্থ ইঞ্জিল) দেওয়া হয়েছে এবং তিনি (আল্লাহ) আমাকে নবী করেছেন। আমাকে বরকতময় করা হয়েছে আমি যেখানেই থাকব; আর আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সালাত ও জাকাত বিষয়ে, যত দিন আমি জীবিত থাকব। (হজরত ঈসা আ. আরও বলেন) আর আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আমি যেন আমার মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহার করি (অনুগত ও বাধ্য থাকি); আমাকে করা হয়নি উদ্ধত অবাধ্য ও দুর্ভাগা হতভাগ্য। আমার প্রতি সালাম (নিরাপত্তা ও শাস্তি) যেদিন আমি জন্ম লাভ করেছি, যেদিন আমি মৃত্যুবরণ করব এবং যেদিন আমি জীবিত হয়ে উঠব। (সুরা-১৯ [৪৪] মারইয়াম, রুকু: ২/৫, আয়াত: ৩০-৩২, পারা: কালা আলাম-১৬, পৃষ্ঠা: ৩০৮/৬)।

হজরত মুসা (আ.)-এর প্রতিও এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘আর আমি বনি ইসরাইল থেকে (বনি ইসরাইলের নবী হজরত মুসা আ.-এর মাধ্যমে) এই অঙ্গীকার নিয়েছি যে তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারও ইবাদত করবে না, পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে।’ (সুরা-২ [৮৭] বাকারা, রুকু: ১০/১০, আয়াত: ৮৩, পারা: আরিফ লাম মিম ১, পৃষ্ঠা: ১৩/১১)।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘যে সন্তান তার মায়ের দুচোখে চুম্বন করল, তা তার জন্য জাহান্নাম থেকে আবরণ হয়ে গেল; যে সন্তান তার মায়ের পদ চুম্বন (কদমবুচি) করল, সে যেন কাবা শরিফের চৌকাঠে চুম্বন করল। (শোআবুল ইমান বায়হাকি)। নবীজি (সা.) বলেন: ‘যেই নেক সন্তান তার মাতা-পিতার প্রতি রহমতের নজরে দেখবে; আল্লাহ তাআলা তার প্রতিবার নজরের বিনিময়ে একটি করে হজে মাবরূর তার আমলনামায় লিপিবদ্ধ করবেন। সাহাবাগণ বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! (সা.), যদি কোনো সন্তান দৈনিক এক শতবার তাকায়? তিনি বললেন: হ্যাঁ, আল্লাহ আরও অধিক ও উত্তম প্রতিদান ও বিনিময় দেবেন। (হাদিউর কুলুব, বায়হাকি)।

জীবিত ও প্রয়াত সব মা-বাবার জন্য সব সন্তানকে আল্লাহ তাআলা দোয়া করতে শিখিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, আর তোমরা বলো: ‘রব্বির হামহুমা, কামা রব্বাইয়ানি ছগিরা’। অর্থাৎ ‘হে আমার প্রতিপালক! তাদের উভয়ের প্রতি দয়া করুণা করো, যেরূপে তারা শৈশবে আমায় লালনপালন করেছেন।’ (সুরা-১৭ [৫০] ইসরা-বনি ইসরাইল, রুকু: ৩/৩, আয়াত: ২৪, পারা: সুবহানাল্লাজি-১৫, পৃষ্ঠা: ২৮৫/৩)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্‌ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম