মায়ের গর্ভে গুলিবিদ্ধ শিশু সুরাইয়ার স্কুলযাত্রা ও ছাত্রলীগ-সমাচার

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠানে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়ান ছাত্রলীগের কর্মীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি: প্রথম আলো

৫ জানুয়ারির প্রথম আলোর দুটি সংবাদের শিরোনাম: ‘দুই পক্ষের সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে সাধারণ সম্পাদক আহত’ এবং ‘স্কুলজীবন শুরু হলো সেই সুরাইয়ার’। যথাক্রমে দ্বিতীয় ও শেষ পৃষ্ঠায় ছাপা হওয়া সংবাদ দুটির মধ্যে দূরতম সম্পর্ক থাকারও কোনো আভাস পাওয়া যায় না। কিন্তু ‘ছাত্রলীগ’ কথাটি উচ্চারণমাত্র আমাদের স্মৃতির বন্ধ দুয়ারে কড়া পড়ে। আস্তে আস্তে দুয়ার খুলে মনের পটে ভেসে ওঠে ‘মাগুরা’, ‘ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মারামারি’, ‘মায়ের গর্ভে গুলিবিদ্ধ শিশু’, ‘অস্ত্রোপচার’...

২০১৫ সালের ২৩ জুলাই মাগুরা শহরের দোয়ারপাড়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলি লাগে অন্তঃসত্ত্বা নাজমা বেগমের। এতে তাঁর গর্ভে থাকা শিশুটিও গুলিবিদ্ধ হয়। রাতেই জেলা সদর হাসপাতালের ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্রোপচারে জন্ম নেয় শিশুটি। সুরাইয়া নামের সেই শিশু গত রোববার প্রথমবারের মতো স্কুলে গিয়েছিল। সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হওয়ার কারণে সুরাইয়ার ডান চোখে দৃষ্টিশক্তি নেই। শক্তি নেই দুই পায়ে। অন্য শিশুরা হেঁটে স্কুলে গেছে, সুরাইয়া গেছে মায়ের কোলে চড়ে। শিশুটির ডান হাতও অকার্যকর।

সাড়ে ছয় বছর পর সেই সুরাইয়া ও সেই ছাত্রলীগ একই দিন সংবাদ হলো এবং কী আশ্চর্য, সেদিনের মতো এদিনও ছাত্রলীগ তার খাসলতগুণে সংবাদপত্রের পাতা ‘দখল’ করেছে, আর সুরাইয়া অতীতের অন্ধকার ফুঁড়ে হাজির ‘আলোর বার্তা’ নিয়ে। ‘সুরাইয়া’ শব্দের অর্থ নক্ষত্রবিশেষ; নক্ষত্র তো আলো ছড়াবেই।

ছাত্রলীগ সেদিন যে কারণে ছাত্রলীগ ছিল, সেই একই কারণে ছাত্রলীগ এখনো ছাত্রলীগ। দলাদলি, অন্তঃকোন্দল, চাঁদাবাজি, সংঘাত-সংঘর্ষ, এমনকি খুনোখুনি। ৪ জানুয়ারি ছিল ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এদিনও স্বরূপে ছিলেন সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার সামনে সংগঠনটির দুই পক্ষ সংঘাতে জড়ায়। সেই সংঘাত থামাতে গিয়ে আহত হন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক। সুরাইয়া ও ছাত্রলীগের একই দিন সংবাদ হওয়ার শাব্দিক ও আত্মিক—উভয় অর্থই তাই কী নিদারুণভাবে যুগপৎ ভিন্ন ও অভিন্ন!

অথচ এই ছাত্রলীগের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, শিক্ষার অধিকার, বাঙালির স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা, গণ-অভ্যুত্থানসহ স্বাধীনতা ও স্বাধিকার আন্দোলনে হিস্যা আছে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও সংগঠনটির ভূমিকা বিরাট, প্রশংসনীয়।
মায়ের গর্ভে গুলিবিদ্ধ হওয়া সেই শিশু সুরাইয়া বিদ্যালয়ে পা রেখেছে
ছবি: প্রথম আলো

গণমাধ্যমের হিসাবে, গত এক দশকে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ২৪টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। বলাই বাহুল্য, এর প্রায় সব কটির সঙ্গেই ছাত্রলীগের জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। এসব হত্যাকাণ্ডের ১৭টিই ঘটেছে সংগঠনটির অন্তঃকোন্দলে। সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে; গত ১০ বছরে সেখানে প্রাণহানির সংখ্যা ৮।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু বকর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা জুবায়ের, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরী ও ছাত্র তাপস সরকার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিম, পুরান ঢাকার দরজি তরুণ বিশ্বজিৎ দাশ—কত প্রাণ অকালে চলে গেছে।

বুয়েটের আবরার ফাহাদ হত্যার ক্ষত এখনো জনমনে দগদগে। এ হত্যা মামলায় অধস্তন আদালতের রায়ে ২০ ছাত্রের ফাঁসি আর ৫ জনের যাবজ্জীবন দণ্ড ঘোষিত হয়েছে। উচ্চ আদালতে এ রায় কতটা বহাল থাকবে কি থাকবে না, সেটা অন্য কথা, কিন্তু এ ঘটনার সরল তরজমায় দাঁড়ায়, ছাত্রলীগ ‘খুনি’ও তৈরি করে। মারপিট বা অঙ্গহানি তো মামুলি ঘটনা। সর্বশেষ খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) এক শিক্ষকের মৃত্যুর ঘটনায়ও অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে, এ কারণে চারজনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ গেছে ১২ বছরের শিশু রাব্বির। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নির্যাতনে চোখ হারাতে বসেছিলেন এহসান রফিক। ছাত্রলীগ নেতার চাপাতির এলোপাতাড়ি কোপে মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে এসেছেন সিলেটের কলেজছাত্রী খাদিজা বেগম।

অথচ এই ছাত্রলীগের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, শিক্ষার অধিকার, বাঙালির স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা, গণ-অভ্যুত্থানসহ স্বাধীনতা ও স্বাধিকার আন্দোলনে হিস্যা আছে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও সংগঠনটির ভূমিকা বিরাট, প্রশংসনীয়। এর আগে বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল ও জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের হাতেও রক্তের দাগ কম লাগেনি; তাঁরাও ছিলেন অনেক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কারণ। তাঁদের সেই অপকর্মগুলো বলতে গেলে গত এক যুগের আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনে অনেকটা ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে, এখন যেহেতু ছাত্রলীগের ‘জয়জয়কার’ চারদিকে।

মাতৃগর্ভে সুরাইয়ার গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় লিখেছিলাম—‘মাতৃজঠরে সময়ের পূর্বাভাস/ পাঠাল বুলেট/ সে-ও ভারী কাজের কাজ হলো একখানা— / শিশুটির জন্মদাগ হয়ে রইল/ সময়ের অফুরান ক্ষত।’ ‘কলি-ছেঁড়ার কাল’ শিরোনামের গুচ্ছ কবিতার ‘বেবি অব বেঙ্গল’-এর বাকি অংশটা ছিল—‘সতর্কসংকেত উপেক্ষা করে তুই আসলি কেন?/ পথে পথে সীমারি-ঠোক্কর খেয়ে খেয়ে— / অপঘাত মৃত্যু ছাড়া থেকে ফেরার পথ নেই কোনো!’ (এনটিভি অনলাইন, ১০ মার্চ ২০১৬)

হ্যাঁ, সেদিনের ছাত্রলীগ এখনো তেমনই আছে। কত কিসিমের হালুয়া-রুটির স্বাদ তাদের মুখে, অন্তরে তাই ‘ক্ষমতা’র উপাসনা। যখন আদর্শের অবশেষও থাকে না, তখন পথ ও বেপথের ফারাক ঘুচে যায়, যা থাকে তার নাম ‘অন্ধকার’। আর যা-ই হোক, অর্থবল, পেশিশক্তি বা ক্ষমতার দম্ভ কিছুই অন্ধকার ঘোচাতে পারে না। অন্ধকারে পথ চলতে দরকার আলো। সুরাইয়ারা সেই আলোর দিশা ও দিশারি। হ্যাঁ, পথে পথে হয়তো ‘সীমারি-ঠোক্কর’ অপেক্ষা করে আছে, কিন্তু আলোয় ঠিক পথ চিনে নেবে ওরা। কেননা, অঙ্গহানি হলেও ওদের অন্তরে অন্ধকার নামেনি।

হাসান ইমাম সাংবাদিক। [email protected]