মায়ের জীবন বাঁচাবে ডিজিটাল বালা

এই বালা সেই বালা নয়। ডিজিটাল বালা। শক্ত প্লাস্টিকের। ভাঙে না। মচকায় না। রান্নাবান্নার সময় পানিতে ভিজলে কিছু হয় না। চুলার তাপেও অবিকল কাজ করে। একে উঁচু মানের ভাষায় ব্রেসলেটও বলা যায়। বালাটা বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে সন্তানসম্ভবা মায়ের জন্য। যিনি দূরের কোনো গ্রামে থাকেন। সারা দিন ঘরসংসারের কাজ করেন। ঢেঁকিতে পাড় পাড়েন। চুলার সামনে দিনের সাত-আট ঘণ্টা থকেন। তঁার সন্তান প্রসবের কথা ভাবার অবসরও নেই।

ডিজিটাল বালা তার গ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় সপ্তাহে দুবার পরামর্শ দেবে, সুস্থ সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য প্রসূতি মায়ের কী করতে হবে। কী খেতে হবে। কোন অবস্থায় করণীয় কী ইত্যাদি। চুলা থেকে বেশি ধোঁয়া বের হলে ডিজিটাল ব্রেসলেট সক্রিয় হয়ে উঠবে। সে সাবধান করে দেবে, কারণ ধোঁয়ার কার্বন মনোক্সাইড পেটের সন্তানের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে।

এর নাম ‘ডিজিটাল ব্যাঙ্গল’ বা ‘ডিজিটাল বালা’। ‘কোয়েল’ নামে পরিচিত। দাম ১২ থেকে ১৫ ডলার, মানে হাজার-বারো শ টাকা। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যদি গ্রামের গরিব প্রসূতি মায়েদের জন্য বিনা পয়সায় এই বালাটি সরবরাহ করে, তাহলে সন্তান জন্মদানের সময় সমস্যার কারণে অনেক মায়ের অকালমৃত্যু রোধ করা সম্ভব।

খবরটি আমাদের অনেকেরই জানা ছিল না। এই বালা নিয়ে গত বছর ২৯ নভেম্বর প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। ইন্টেল করপোরেশন ও গ্রামীণ ট্রাস্ট মিলে এটা বানিয়েছে। যদিও আমাদের গ্রামে গ্রামে মোবাইল এবং মোবাইলে মাতৃমৃত্যু রোধে বেশ কিছু সেবা পাওয়া যায়। কিন্তু সমস্যা হলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মোবাইলগুলো থাকে স্বামীর মুঠোয়। প্রয়োজনের সময় তিনি হয়তো হাটে-বাজারে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারছেন। তাহলে বিপদে কে তাকে বঁাচাবে?

ডিজিটাল বালাটি শুধু মায়েদের হাতে পরার উপযুক্ত করে তৈরি করা হয়েছে। ওটা স্বামীর কাজে লাগবে না। আবার এটা বেশ মজবুত। একজন মা ব্যবহার করার পর পাশের বাসার আরেকজন সন্তানসম্ভবা মা সেটা ব্যবহার করতে পারবেন। ব্যাটারিও বেশ টেকসই।

খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যু রোধে অনেক দূর এগিয়েছে। এবার ডিজিটাল বালা শুধু বাংলাদেশ নয়, সমস্ত দক্ষিণ এশিয়ায় মাতৃমৃত্যু রোধে ভূমিকা রাখবে।

২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস উপলক্ষে ২৭ মে প্রথম আলো ও ইউনিসেফের উদ্যোগে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকের মূল আহ্বান ছিল ‘নিরাপদ প্রসব চাই, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চলো যাই’। শিশু জন্ম দিতে গিয়ে বিশ্বে প্রতিদিন ৮৩০ জন মা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। বাংলাদেশে প্রতিদিন ১৪ জন প্রসূতি মায়ের মৃত্যু হয়। বছরে অন্তত ৫ হাজার ২০০ জন মারা যাচ্ছেন। তার মানে বছরে প্রতি ইউনিয়নে অন্তত একজন প্রসূতি মায়ের চলে যেতে হচ্ছে।

মাতৃমৃত্যু হার কমিয়ে আনতে হলে দরকার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিডওয়াইফ। বাংলাদেশে এখন প্রতি লাখ জীবিত জন্মে ১৭৬ জন মায়ের মৃত্যু হয়। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে এই হার কমিয়ে আনতে হবে ৫৯-এ। এটা সম্ভব যদি আমরা ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে দক্ষ মিডওয়াইফ ও জরুরি প্রয়োজনে অপারেশন করতে হলে একজন করে অবেদনবিদের (অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট) ব্যবস্থা করতে পারি। ২০২১ সালের মধ্যে ২২ হাজার মিডওয়াইফ দরকার।

এটা কি সরকার একা পারবে? না, কখনো না। এখানে বেসরকারি সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে। তবে সরকারের একটা কাজ করতে হবে। নির্দেশ দিতে হবে, প্রত্যেক বেসরকারি ক্লিনিক বা হাসপাতালে মিডওয়াইফ থাকতে হবে। তাহলেই মিডওয়াইফের চাহিদা সৃষ্টি হবে এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক মিডওয়াইফ প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে উঠবে।

বাজারে চাহিদা সৃষ্টি করা এখন সবচেয়ে জরুরি। সরকার আইনের মাধ্যমে এ বিষয়ে সাহায্য করতে পারে।

আবার দেখতে হবে, সরকারি হাসপাতালে তো প্রায় বিনা পয়সায় গরিব মায়েরা সেবা পান। কিন্তু বেসরকারি ক্লিনিকে তো গলাকাটা দাম। তাহলে গরিবের কী হবে? সরকারি হাসপাতালে তো সবার জায়গা হবে না।

তাই সরকার একটা কাজ করতে পারে। যুক্তিসংগত দাম বেধে দিতে পারে। সরকার যদি রমজান মাসে মাংসের দাম, বাসের ভাড়া বেধে দিতে পারে, তাহলে শুধু প্রসূতি মায়ের জন্য কেন পারবে না। বেসরকারি হাসপাতালগুলো তো সিএসআর হিসেবেও প্রসূতি মায়েদের জন্য খুব কম দামে প্রসবের ব্যবস্থা করতে পারে।

আরেকটি সমস্যা হলো সিজারিয়ান অপারেশন। অনেক সময় ডাক্তাররা ঝুঁকি নিতে চান না। সামান্য সমস্যা থাকলেই সিজারিয়ানে চলে যান। আবার অনেক মা নিজেও ঝুঁকি নিতে চান না। বলেন সিজারই ভালো।

ইউনিয়ন পর্যায়ে যদি সন্তানসম্ভবা মায়ের নিয়মিত চেকআপের ভালো ব্যবস্থা, আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ লেবার রুম (সন্তান প্রসব ব্যবস্থা) থাকে, যদি জন্মের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত বাচ্চার অবস্থান জানার সুব্যবস্থা থাকে এবং জরুরি প্রয়োজনে সিজারিয়ানের জন্য উপজেলা হাসপাতালে পাঠানোর জন্য অ্যাম্বুলেন্স থাকে, তাহলে ডাক্তার ও আস্থা বাড়বে, সিজারিয়ান কমবে।

হাসপাতালে নাকি অবেদনবিদ পাওয়া যায় না। প্রশিক্ষণের জন্য বিজ্ঞপ্তি দিলেও নাকি প্রার্থী পাওয়া যায় না। অথচ জরুরি প্রসবের জন্য অবেদনবিদের দরকার খুব বেশি। অবেদনবিদ হলেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। তিনি যে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে অপরিহার্য, সেটা আমাদের মতো সাধারণ মানুষ অনেকেই জানে না। তাই অবেদনবিদের প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা, চাকরি ক্ষেত্রে বেশি ও বিশেষ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার। তাহলে অবেদনবিদের অভাব হওয়ার কথা নয়।

আমরা কেন সিজারিয়ানের হার কমাতে চাই? কারণ, স্বাভাবিক প্রসব হলে বাচ্চা বেশি সুস্থ-সবল থাকে ও তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও অনেক বেশি থাকে। বিবর্তনের ধারায়ই শিশুর জন্মপথ এমন সরু। কারণ, ওই সরু পথে জন্মলাভের সময় শিশু এমন কতগুলো স্তরের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে, যা তাকে পরবর্তীকালে বেঁচে থাকার অতিরিক্ত সুবিধায় সজ্জিত করে। স্বাভাবিক জন্মের শিশুদের মাথার আকার তুলনামূলক ছোট এবং প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য বেশি উপযোগী বলেই শিশুর জন্মনালি (বার্থ ক্যানেল) এমন সরু। সিজারিয়ান শিশুদের অনেকে এই বাড়তি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। তাই ডাক্তার ও প্রসূতি মা, সবারই এ বিষয়ে সচেতন থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে জরুরি ক্ষেত্রে অবশ্যই সিজারিয়ানে যেতে হবে।

ডিজিটাল বালায় আবার আসি। আমরা যদি সব গ্রামে সব প্রসূতিকে নিরাপদ প্রসবের জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে চাই, তাহলে সেখানে সবকিছুর আয়োজন ঠিক রাখতে হবে। আর ডিজিটাল ব্যবস্থায় তাদের খোঁজখবর রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। একজন প্রসূতিকে কখন কী করতে হবে, সেটা তার নিজে এবং পরিবারের কর্তাব্যক্তিদের সব সময় জানিয়ে রাখতে হবে।

মা ও শিশুমৃত্যুর হার আমরা অনেক কমিয়ে আনছি। আরও কমিয়ে আনব নিশ্চয়ই। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করলে সত্যিই মা ও শিশুর জন্য একটা বিপ্লব হয়ে যাবে।

আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।