মিথ্যাই সুন্দর, মিথ্যাতেই মঙ্গল!

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সিদ্দিকুর
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সিদ্দিকুর

সিদ্দিকুরের চিকিৎসা চলছে এখন ভারতে। তার এক চোখ ইতিমধ্যে অন্ধ হয়েছে। আরেক চোখের আলো ফিরবে কি না, বলা যাচ্ছে না তাও। সিদ্দিকুর এবং ঢাকার সাতটি কলেজের শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড়ে জড়ো হয়ে রুটিনসহ পরীক্ষার সময়সূচি প্রদানের জন্য দাবি তুলেছিল।

শান্তিপূর্ণ এই মিছিলের দিকেই হঠাৎ ধেয়ে যায় রাষ্ট্রের পুলিশ। তারা শিক্ষার্থীদের হাত থেকে ব্যানার কেড়ে নেয় এবং খুব কাছে থেকে একজন পুলিশ বিক্ষোভকারীদের দিকে সরাসরি টিয়ার গ্যাসের শেল ছোড়ে। সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়ে সিদ্দিকুর।

ভিডিও ফুটেজ দেখলে যেকোনো মানুষের বোঝার কথা, পুলিশের সরাসরি টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপে চোখে শেলের আঘাতে লুটিয়ে পড়ে সিদ্দিকুর। এ দৃশ্য দেখা যতটা কষ্টকর, তা নিয়ে ভাবা তার চেয়ে অনেক বেশি যন্ত্রণাদায়ক। একটা দেশের পুলিশ কীভাবে সরাসরি টিয়ার গ্যাসের শেল ছুড়তে পারে একজন ছাত্রের চোখে। এতটা বেপরোয়া, এতটা পৈশাচিক, এতটা বর্বর কী করে হয় পুলিশ? ভাবতে ভাবতে হতাশা-ক্ষোভ আর বেদনায় বুক উত্তাল হয়ে ওঠে। কী হবে সিদ্দিকুরের শেষ পর্যন্ত! কেমন করে এ শোক সইবে তার পরিবার। সিদ্দিকুরদের ট্যাক্সের টাকায় যাঁদের বেতন হয়, সিদ্দিকুরদের নিরাপত্তা দেওয়ার কাজে যাঁরা চাকরি পান, তাঁরা কীভাবে সরাসরি টিয়ার গ্যাস ছুড়তে পারেন সিদ্দিকুরদের দিকেই।

এই প্রশ্নের ভার বহন করা যায় না বেশিক্ষণ। এই ভার বহনও করতে হয় না বেশিক্ষণ। পুলিশ আমাদের এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছে। তারা জানিয়েছে, টিয়ার গ্যাসের শেলে নয়, সিদ্দিকুরের চোখ থেঁতলে গেছে ফুলের টবের টুকরোর আঘাতে!

কীভাবে পুলিশের দিকে মুখোমুখি হয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের ফুলের টবের আঘাতে একই দিকে তাকিয়ে থাকা সিদ্দিকুর আহত হলো? পুলিশ তার ব্যাখ্যা দেয়নি। আমরা তাই কল্পনা করি, ধেয়ে আসা পুলিশের দিকে তাকানো অবস্থায় দুই শিক্ষার্থী পুলিশের দিকে টবের টুকরো ছুড়েছে। সেই টুকরো পুলিশের দিকে কিছুদূর গেছে। টবের টুকরোর মনে কী ছিল কে জানে! সব গতিসূত্র অগ্রাহ্য করে তারপর তা হঠাৎ পেছন ফিরে সিদ্দিকুরের দুচোখে আঘাত করেছে—একই সময়ে, একই গতি ও শক্তিতে। আর পুলিশের নিরীহ টিয়ার গ্যাসের শেল কয়েক হাত দূরের সিদ্দিকুরদের বাঁচাতে উড়ে গেছে আকাশে বা ডাইভ দিয়েছে মাটিতে!

দোষ তাই শিক্ষার্থীদের! এ জন্যই হয়তো হাজারখানেক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে পুলিশ। না, সিদ্দিকুরের চোখ থেঁতলে দেওয়ার জন্য নয়। মামলা দিয়েছে এই টবের টুকরো মেরে দুর্ভেদ্য বর্ম ভেদ করে পুলিশকে হত্যার উদ্দেশ্যের কারণে। এই শিক্ষার্থীরা অজ্ঞাতনামা। শুধু একজনের নামই জানি আমরা। সে সিদ্দিকুর। সে কি মামলার আসামি হয়েছে? হয়নি। মহান হৃদয়ের পুলিশ হাতেনাতে ধরা সিদ্দিকুরকে পুলিশকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ থেকে রেহাই দিয়েছে। পুরোটাই পুলিশের মহত্ত্বের গল্প।

পুলিশের এই গল্প কি মিথ্যা হতে পারে? পারে হয়তো। কিন্তু তা নিয়ে আমাদের তর্ক করার দরকার নেই। কারণ, এই মিথ্যাটাই সত্যের চেয়ে সুন্দর, স্বস্তিকর! এটা বিশ্বাস করতে পারলেই মনের যন্ত্রণা কমে। আমাদের টাকায় নিয়োগ, প্রশিক্ষণ আর বেতন পাওয়া পুলিশ আমাদেরই একজন সন্তানের চোখে টিয়ার গ্যাসের শেল ছুড়ে মারেনি। সে আহত হয়েছে তার বন্ধুদের অলৌকিক ঢিলে তেলেসমাতিতে। এই রূপকথাটা মেনে নিলে মনের ক্রোধ আর কষ্ট কি কমে যায় না আমাদের? কমে। ধন্যবাদ পুলিশ ভাই।

২.

ক্রোধ আর কষ্ট প্রশমনের আরও ঘটনা আছে। মাত্র গত সপ্তাহেই ঘুষ না পেয়ে জ্যান্ত মানুষের দুই চোখ স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে নাকি তুলে নিয়েছে পুলিশ। এই অভিযোগ হতদরিদ্র পরিবারের হতভাগা মানুষটির স্ত্রীর। পুলিশি নারকীয়তার গা ছমছম করা বিবরণ দিয়েছেন তিনি সাংবাদিকদের কাছে। এই বিবরণ পড়ে কি চোখের পানি আটকে রাখা যায়? বুকের আগুন ঢেকে রাখা যায়?

তার চেয়ে পুলিশের বিবরণ কিছুটা হলেও কম কষ্টের। পুলিশ বলেছে, চোখ হারানো এই মানুষটি নাকি ছিলেন ছিনতাইকারী। খেপে গিয়ে রাস্তার মানুষই চোখ তুলে নিয়েছে তাঁর। কেউ দেখেনি এটি, কোনো পত্রিকায় আসেনি। কেবল পুলিশই দেখেছে আর জেনেছে এই চোখ তোলার কাহিনি। এই কাহিনিতে সবজি বিক্রেতা চোখও হারাবেন, ছিনতাইকারী হিসেবে ঘৃণিতও হবেন। তাতে কী! এই কাহিনি তবু মেনে নিলে অক্ষম ক্ষোভের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাই আমরা। ঘুষ না পেলে পুলিশ তুলে নেয় মানুষের চোখ—এটি জেনে না হলে ঘুমাই কীভাবে আমরা শান্তিতে? কীভাবে প্রশমিত থাকেন মানবাধিকার রক্ষার জন্য পদবি, বেতন, পুরস্কার, প্রাসাদ পাওয়া মানুষজন?

এক সপ্তাহে দুই ঘটনা। ঢাকায় পুলিশ চোখে টিয়ার গ্যাসের শেল মেরেছে, খুলনায় পুলিশ নাকি চোখই তুলে নিয়েছে। এসব দাবি করে, আর এসব বিবরণ ছেপে যাঁরা আমাদের মনের শান্তি বিনষ্ট করেছেন, তাঁদেরই বরং শাস্তি হোক। যাঁরা এসব কর্মের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন, আর নাগরিকদের বিভ্রান্ত করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলাই হোক বরং। তথ্যমন্ত্রী এ জন্যই না বহাল রাখতে মরিয়া এই ধারাকে।

সত্য জেনে লাভ নেই এই পোড়া দেশে! তার চেয়ে পুলিশের বিবরণ শুনে কষ্টের ভার কিছুটা হলেও কমুক আমাদের!

৩.

মিথ্যাই শান্তি, মিথ্যাই স্বস্তি—এই মন্ত্র আগেও ছিল। তুচ্ছ এক জজ মিয়াকে আবিষ্কার করে, তার ওপর ২১ আগস্টের বোমা হামলার দোষ দেওয়া হয়েছিল। এই গল্প পুরোপুরি মিথ্যা ছিল। কিন্তু এই গল্প বহাল থাকলে কী শান্তিই না থাকত দেশে! এক নেত্রীকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করেন আরেক নেত্রীর লোকজন—এটি না জানলে নেত্রীদের মনে শান্তি থাকত, আমাদের মধ্যেও হানাহনি কমত। জজ মিয়াকে ফাঁসি দিয়ে আমরা কি পারতাম না বিনা ঝামেলায় শান্তি আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কাজটি করতে?

শান্তি দেয় এ ধরনের গল্পই তাই বিশ্বাস করা উচিত আমাদের। বিশ্বাস করা উচিত যে এ দেশে কোনো খুনে-গুমে জড়িত না পুলিশ, র‌্যাব। এ দেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট থেকে টাকা পাচারে জড়িত নেই ব্যাংক বা সরকারের কোনো বড় কর্তা। এ দেশের লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়, ব্যাংক থেকে লাখ কোটি টাকা নিয়ে ফেরত দেওয়া হয় না—সরকারের কেউ জড়িত থাকে না এসবে। এসব মিথ্যা হলেও, শান্তি কেবল এগুলো বিশ্বাস করলেই। এ দেশে শেয়ারবাজার লোপাট হয়, ভুয়া প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হয়, নির্মাণকাজে পুকুরচুরি হয়, চাকরির নামে ক্যাডার নিয়োগ হয়, প্রশ্ন ফাঁস হয়, উত্তরপত্রে জোচ্চুরি হয়, মুক্তিয়োদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে বাণিজ্য হয়, ভোট ছাড়া নির্বাচন হয়। এসব সত্যি ভেবে লাভ কী আমাদের? লাভ কি সত্যের অসীম যন্ত্রণা বুকে বহন করায়?

৪.

এ দেশ থেকে অসংখ্য মানুষ মরিয়া হয়ে কাজ খুঁজতে যান বিদেশে, লাশ বা বন্দী হন সেখানে। এ দেশের রথী-মহারথীরা সম্পদ ও সন্তান পাচার করেন বিদেশে। সামান্য বৃষ্টিপাতে ভেনিসে পরিণত হয় এ দেশের বড় বড় শহর। দুঃসহ যানজটে শুধু ঢাকা শহরেই এক দিনে নষ্ট হয় ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শ্রমিকের অধিকার, রাজধানীর সমৃদ্ধি—সবকিছুতে তলানিতে থাকে এ দেশ।

কিন্তু তাতে সমস্যা কী? সরকার তো বলেছে যে এ দেশ উন্নয়নের রোল মডেল! এ দেশের দিকে নাকি অবাক বিস্ময়ে
তাকিয়ে থাকে পৃথিবীর মানুষ! এই বিবরণ বিশ্বাস করতে পারলে প্রশান্ত কি হয় না আমাদের হৃদয়–মন?

সবচেয়ে ভালো তাই সরকারের সব বিবরণ মেনে নেওয়া। মিথ্যা নাকি সত্য—এ প্রশ্ন না তোলা। নিজেদের রোল মডেল ভেবে ভেবে সব অনাচার অগ্রাহ্য করা। জীবন বাঁচবে তাতে, শান্তি আর স্বস্তিও তাতেই।

এ দেশে মিথ্যাই জয়ী। মিথ্যাই সুন্দর। মিথ্যার ইয়াবায় কেন তাহলে ভেসে যাই না আমরা সবাই!

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।